প্রায় দু’বছর হতে চলল এই দুঃসময় মানুষকে, সমাজজীবন, এমনকী বেঁচে থাকাকেও তছনছ করেছে। শিল্প-সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল মানুষেরা অসহায় হয়েও তাঁদের নিরন্তর নির্মাণপর্বকে কিন্তু থমকে যেতে দেননি। অনেক প্রতিকূলতার প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতেও নিজস্ব নির্মাণের নিরবচ্ছিন্ন ধারাটিকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আগলে রাখার। বহু শিল্পী-ভাস্করই যেন অলিখিত নিয়মে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ফি-বৎসর একটি করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থায়। অনেকে সিরিয়াস কাজ করেন, কেউ কেউ দায়সারা।
অতিমারির থাবায় এমনিতেই গ্যালারির ঝাঁপ বন্ধ বহু কাল। একক, দলীয় বা গ্যালারির নিজস্ব উদ্যোগে প্রদর্শনীর তাই অভাব। যাও বা কিছু হয়ে আসছে, তেমন প্রাণবন্ত নয়। তবে কিছু প্রদর্শনী নিঃসন্দেহে গত কয়েক মাসে দেখা গিয়েছে বেশ উন্নত মানের। সে দর্শক পাক বা না-ই পাক, কয়েকটি প্রদর্শনী বেশ মনে রাখার মতো। বিশেষত কলকাতা শহরে। বারাসতের চারুকলা গ্যালারি ভালমন্দ হিসেবের বাইরে গিয়েও প্রদর্শনীকে গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের পঞ্চম বাৎসরিক প্রদর্শনী ‘টাইম অ্যান্ড স্পেস’ সম্প্রতি শেষ হল। তবে ছোট গ্যালারি, সেই হিসেবে ৪২ জন শিল্পী-ভাস্করের কাজ রাখতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। সব দিক রক্ষা করা যায় না সব সময়ে, তবে প্রদর্শিত কাজের বাছাই পর্বটিকে তো গুরুত্ব দিতেই হয়। ঠিক এই জায়গাটিতেই বহু প্রদর্শনী চূড়ান্ত মার খেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীদের দেওয়া কাজই প্রদর্শনীতে রাখা হয়— যার বেশ কিছু কাজকে ‘ভাল’ বলা তো দূরের কথা, যথেষ্ট রকম ‘অযোগ্য’। কে বাছবেন? চলে এল দু’-একটি করে প্রচুর কাজ। স্থান পেয়ে গেল ওই সব অকাজ কিছু ভাল কাজের পাশে। এই প্রদর্শনীও তার খুব একটা ব্যতিক্রম না হলেও, সামগ্রিক ভাবে একটা মান ধরে রাখার চেষ্টা ছিল। অভাব ছিল নির্বাচনের। অভাব ছিল সংখ্যা নির্ধারণের। সে শিল্পী বা কাজ, দুই ক্ষেত্রেই।
রেল ইঞ্জিন নিয়ে সুদীর্ঘ কাল অনেকেই বিশেষত জলরঙে কাজ করেছেন। সাধারণত স্টাডিমূলক বা তার বাইরের কম্পোজ়িশনও দেখা গিয়েছে। সাদিকুল ইসলামের ‘হেরিটেজ’ সেই হিসেবে চমৎকার। তবে রেলের লাইনগুলো (প্রোপোর্শন অনুযায়ী) মানানসই নয়, হয়ওনি। সুশান্ত সরকারের ‘মাদার’ কিছুটা রিজিড, বিকাশ ভট্টাচার্যের ছায়া থেকে সরতে হবে। শ্যামল সোমের ‘কাবুল গার্লস ২০২১’ মন্দ নয়। রচনায় দুর্বলতা আছে। বিভা বসুর ক্যানভাসে করা স্প্রে পেন্টিংয়ে লালচে-কমলা পল্লবিত ছন্দের মধ্যে যেন কবিতার মেলোডি অনুরণিত। সাদা ছেড়ে রাখার ব্যবহার চমৎকার। বিপ্লবকুমার মিত্রের ব্রোঞ্জ ‘রামকিঙ্কর’ মন্দের ভাল। সাদৃশ্য থেকেও যেন নেই। অনিকেত চৌধুরীর সাদাকালো বলপয়েন্ট পেনে করা হাসিমুখের ‘রামকিঙ্কর’ হঠাৎ যেন মনে হয়, ফোটোশপের হালকা প্রিন্টের উপর পেনের কাজ। বিভ্রমটুকু বাদ দিলে বেশ ভাল। স্বপন রায়ের ‘লেডি উইথ ফ্লাওয়ার’-এ ইউরোপীয় ঘরানা অনুভূত হয়। ভাল কাজ। দেবব্রত দে-র ভাস্কর্যে বরাবর একটি কৌতূহল থাকে। দারুণ তৈরি হাত, ব্রোঞ্জের ‘আ ফেস’-এ সে বিস্ময়টুকু অব্যাহত।
ইন্দ্রজিৎ বেরার অ্যাক্রিলিক ‘বাইগন’ ভাল কাজ। অনেক প্রশ্ন বালকের চোখে। স্বপনকুমার রায়ের কালো টেরাকোটাটিও বেশ। যেমন সৌমেন করের ব্রোঞ্জের ‘মেমোরিজ়’। পাতিনার ব্যবহার সুন্দর। পলাশ পালের ‘কোয়ারান্টাইন ডেজ়’ অ্যাক্রিলিকে ক্যানভাসে করা কাজটি আধুনিক বিমূর্ততার মূর্ত প্রতীক, কিছুটা হলেও। ওই আশি ভাগ লালের সঙ্গে মডার্ন ফর্মেশনের বিন্যস্ত আননসদৃশ অবয়বী আভাস কৌতূহলোদ্দীপক। বেশ অন্য রকম কাজ। স্টাইলের দিক থেকেও। তন্ময় রায়চৌধুরীর ‘আনটাইটেলড’ সিরিজটিও বর্তমান সময়ের ঘৃণ্য রাজনৈতিক মৌলবাদকে প্রতিফলিত করে। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক। ইন্দ্রনীল ঘোষ ফাইবার গ্লাসে ‘লাভ’-এ মনুমেন্টালিটি ও জিয়োমেট্রিকাল প্যাটার্নের কম্পোজ়িশনটি বেশ ধরেছেন। প্রয়াত শঙ্কর ঘোষকে মনে পড়ে। দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। ফুল্ল মিস্ত্রির অ্যাক্রিলিকের চতুর্মুখী ‘থিঙ্কার’ মন্দ নয়।
এ ছাড়াও বর্ষীয়ান দীপক বর্মণ, দীপঙ্কর বিশ্বাস, চৈতালী চন্দ, দেবযানী ঘোষ, প্রশান্তকুমার বসু, গৌতম সরকার, শিপ্রা পাল বেরা, মলয়চন্দন সাহা, সুখেন্দু সাহু, রানি দাস, প্রীতম কাঞ্জিলাল, কিশোর মল্লিক প্রমুখ খুব চিত্তাকর্ষক না হলেও, ভাল কাজ করেছেন। যদিও আরও একটু ভাল আশা করা গিয়েছিল।
অতনু বসু