সাত জন চিত্রকরের ২০টি ছবিতে কিছু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল। শিল্পীরা নিজের মতো ছবি করবেন, প্রয়োজনে কিছু শর্ত মানবেন, না-ও মানতে পারেন। আধুনিকতা কোথায় কতটা কী ভাবে প্রকাশ হচ্ছে বা হচ্ছে না, তা বড় কথা নয়। শিল্পী কী ভাবে নির্দিষ্ট মাধ্যমে প্রকাশ করছেন, কেমন করে দেখাতে চেয়েছেন, দেখানোর মধ্যে কি প্রদর্শনীর নামকরণের কথা মাথায় রেখে কাজ সম্পন্ন করতে হবে? কতটা সাযুজ্য থাকলে তবে তা সার্থক? গান্ধার আর্ট গ্যালারির উপস্থাপনায় ‘মেটাফরিক আইডেন্টিটি’ নামক প্রদর্শনীটি এমনই কিছু প্রশ্ন তুলে দিল।
শিল্পীদের ভাবনায় বৈচিত্র ছিল, প্রয়োগে মুনশিয়ানা ছিল, রচনায় চমৎকারিত্ব ছিল, মাধ্যম-গুণেও এক নিরীক্ষামূলক লক্ষ্য ছিল। তবু কোথাও কিছু দুর্বলতা ঢুকে পড়েছিল। সব একসঙ্গে সুবিন্যস্ত হতে পারে না। প্রশ্ন হল, সবটাই কি উপমাত্মক বা রূপকাত্মক পরিপূর্ণ সাদৃশ্য বা স্বরূপত্বের দিকটিকে উন্মোচিত করেছে? কেন তবে ‘মেটাফরিক আইডেন্টিটি’?
ছবি সব সময়ে রূপক হবে, এমন নয়। কয়েক জনের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, অনেকে যেমন একটা ভারসাম্য বা ঐক্য রক্ষা করতে চান— আবার অসমতা, অনিশ্চিতিও ভালবাসেন কেউ কেউ। বেশি ব্যালান্স ছবির স্পিডটিকে ব্যাহত করে, টেনশন নষ্ট হয়। টোটাল কম্পোজ়িশনই লক্ষ্য হওয়া উচিত— কম্পোজ়িশনের আলোচনায় ধীমান দাশগুপ্তর এই উক্তি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
যে কোনও কিছুর একটা অংশ নিয়েই একটি নাটকীয় দৃশ্যকল্প তৈরি হতে পারে। প্রদর্শনীতে তার নমুনাও গভীর ও আনুপাতিক ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। কাজের বেশির ভাগই বেশ অন্য ধরনের একটা দৃশ্যকল্পের অভিঘাতে দর্শককে আকৃষ্ট করেছে।
শেখরবরণ কর্মকার জলরঙে স্বচ্ছতার আবহে, বর্ণের ওভারল্যাপিং ও অতি তরলায়নের মুগ্ধতায় অবয়বী ছবির প্রত্যঙ্গ বা শুধু মুখ, অন্তর্গত শিরা-মাংসপেশি ও অ্যানাটমিকাল কিছু দিকে বস্তুরূপের চরিত্র-দ্যোতক একটা ফলপ্রসূ দিককে উন্মোচিত করেছেন। ওই ফর্মেশন ও ধরে ধরে বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণের প্রয়োগ প্রশংসনীয়। কোলাজটি যথেষ্ট রূপকাত্মক ও অভিঘাতময়। যদিও মাতিসের প্রভাব এড়াতে পারেননি।
সুরজিৎ বিশ্বাস গ্রাফাইট ও ইঙ্কে কাগজে যৎসামান্য রেখা ও কাঠামোগত রূপ-কে ঘর, বাক্স, রোল করা ঝোলানো কাগজ, গৃহের বহিরঙ্গ ও অভ্যন্তরকে অতি সরলীকৃত ড্রয়িংয়ের সংক্ষিপ্ততায় ধরেছেন।
মিশ্রমাধ্যমে প্রকৃতির পাথুরে রুক্ষতার নিবিড় চিত্র দৃশ্যায়িত করেছেন সুরেশচন্দ্র সিংহ। ফেটে, ভেঙে, ক্ষয়ে যাওয়া বর্ণহীন ও বর্ণময় পাথুরে বিন্যাসকে তিনি এক-একটি স্পেস নিয়ে বাঁধতে চেষ্টা করেছেন। ইঙ্কের ড্রয়িংয়ে ঘাসের ক্ষুদ্র জমি ও ‘দ্য স্টোনস’ বেশ একটা সুপার ক্লোজ-আপ ছবি যেন! রুক্ষ মাঠে পড়ে থাকা পাথর ফিরিয়ে দেয় কবিকে— ‘ভাত নেই, পাথর রয়েছে।’
কাগজের টেক্সচারকে পিনবিদ্ধ করে আর একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডটসের উচ্চাবচ টেক্সচার তৈরি করে— রেডিশ ব্রাউনে পেন-ইঙ্কে ড্রয়িং-বেসড খোয়াইয়ের নির্জনতম ছবি করেছেন ঘনশ্যাম লাটুয়া। চতুর্দিকে অনেকটা স্পেস ছাড়া কাটআউট ছবির মতো খোয়াইয়ের বিচ্ছিন্ন অংশগুলির ড্রয়িং, টেক্সচার, টোন ও টোটাল ফর্মের এক সচেতন প্রয়োগ। ডেভিড মালাকারের ‘বেনারস’ কিছুটা কালচে ও লালচে খয়েরি বর্ণে মেঘ, ফুলের পাপড়ি, কুশন বা আসন সদৃশ কাজ করেছেন। দৃষ্টিনন্দন হলেও আহামরি নয়।
জলরঙে প্রচণ্ড ন্যারেটিভধর্মী কাজ করেছেন সপ্তর্ষি ঘোষ। একই ছবিতে মথ বা প্রজাপতির দিকে লক্ষ্য রেখে, নিরীক্ষণরত চতুষ্পদ প্রাগৈতিহাসিক জন্তু, পিছনে একলা একটি দণ্ডায়মান ধুতরো ফুল। কীসের রূপক? ‘সেটিং আউট টুওয়ার্ডস দি এন্ড অফ অ্যানাদার এজ’ জল ছাড়া মেঘের ফর্ম, বিস্তীর্ণ প্রান্তর। অতি হালকা বর্ণের কাজটি আপাত-রহস্যে অন্য রকম। ‘লাভেবল লাভ’-এর খোলা কাঁঠালকে নিরীক্ষণ সিংহের, পাশে বিরাট পুষ্পশোভিত একক ছোট বৃক্ষ। অনেকটা স্পেস ছেড়ে, পটভূমিতে নানা দৃশ্যের অবতারণায় স্বল্পবর্ণে তাঁর ড্রয়িং-বেসড নাটকীয় কাজগুলির মধ্যে একটা স্থির, অচঞ্চল, গভীর নিবেদন আছে। ‘দ্য ডেফনিং সায়লেন্স অব দ্য ভ্যালি অব ডেথ’, ‘আই নো দ্য থটস দ্যাট সারাউন্ড ইউ, কজ় আই ক্যান লুক ইনসাইড ইয়োর হেড’ বেশ উল্লেখযোগ্য। ড্রয়িং ও তার অন্তর্গত জায়গাগুলির বাস্তবিকতা ও চিন্তার অন্তর্ভেদী সারমর্মের অভিঘাত সাঙ্ঘাতিক আচ্ছন্নময়।
মিশ্রমাধ্যমে প্রমিতি হোসেন তাঁর ‘সায়লেন্ট থটস’ ও ‘কনজেস্টেড মাইন্ড’ কাজ দু’টিতে অ্যাক্রিলিক শিটে স্ক্র্যাচ করা ছায়া পিছনের কাগজে একটা অন্য ডায়মেনশন তৈরি করছে। মাঝখানে ড্রয়িং তার সূক্ষ্মতা ও রচনার রূপবন্ধের বিভিন্ন তারতম্যের সুন্দর প্রকাশ।