Art Exhibition

হৃদয়ে ছিলে জেগে

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণবর্ষে, অর্থাৎ ১৯৪১ সালে অমল হোম সম্পাদিত ‘মিউনিসিপাল গেজেট’-এর পাতায় প্রথম এই শিল্পকর্মটির ছবি প্রকাশিত হয়েছিল।

Advertisement

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৯:১১
Share:

একটি হৃদয়, যেটির জন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। কী করে সেই হৃদয়-ভাস্কর্য জন্ম নিল? কবি একদিন একটি পাথরখণ্ডকে আপন হাতে খোদাই করে এই আকার দান করেছিলেন। ইতিহাস সূত্র বলছে, পাথরটি বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে কোয়ার্টজ়াইট শ্রেণিভুক্ত। এটির মাপ ৪.৫x৪x৩ সেন্টিমিটার। এ বার সেই হৃদয়-আকারে কবি নিজ হাতে খোদাই করলেন চারটি পঙ্‌ক্তি: ‘পাষাণ হৃদয় কেটে/খোদিনু নিজের হাতে/আর কি মুছিবে লেখা/অশ্রুবারিধারা পাতে’। শেষে কোনও যতিচিহ্ন নেই।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণবর্ষে, অর্থাৎ ১৯৪১ সালে অমল হোম সম্পাদিত ‘মিউনিসিপাল গেজেট’-এর পাতায় প্রথম এই শিল্পকর্মটির ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। একটি আলোকচিত্র, সেটির নীচে এমন একটি নোট ছিল, ‘... আ পিস অব কোয়ার্টজ়াইট স্টোন কাট ইন দ্য ফর্ম অব আ হার্ট বাই দ্য পোয়েট’স ওন হ্যান্ড অ্যান্ড দ্য ভার্স কম্পোজ়ড অ্যান্ড এনগ্রেভড বাই হিম হোয়েন হি ওয়জ় স্টেয়িং অ্যাট করওয়ার অন দ্য সি (বম্বে) উইথ হিজ় ব্রাদার, সত্যেন্দ্রনাথ ইন ১৮৮৩। ইট ওয়জ় প্রেজ়েন্টেড টু হিজ় ফ্রেন্ড, দ্য পোয়েট অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী’। এর পর সেই কবিতা ও তার ইংরেজি ভাষান্তরও সেখানে মুদ্রিত হয়। আবার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীতেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায়। আরও জানা যায় যে, ওই পর্বে সত্যেন্দ্রনাথই এই পাথর রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন, যে পাথর কবির হাতে হৃদয়ের আকার ধারণ করে। আবার, রবীন্দ্রগবেষক জগদীশ ভট্টাচার্যের ‘কবিমানসী’র প্রথম খণ্ডে কবির এই ‘হৃদয়’ সৃজনের আরও বিস্তারিত প্রবাহপট লক্ষ্য করি আমরা।

সব ক’টি মুদ্রিত তথ্যই জানাচ্ছে যে, কবি এই শিল্পকর্মটি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীকে উপহার দিয়েছিলেন, যে অক্ষয়চন্দ্রর কথা কবির ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় চিত্রিত আছে। সেই গ্ৰন্থে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়চন্দ্র সম্পর্কে লিখছেন, ‘বাল্যকালে আমার কাব্যালোচনার মস্ত একজন অনুকূল সুহৃদ জুটিয়াছিল। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী মহাশয় জ্যোতিদাদার সহপাঠী বন্ধু ছিলেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ.। সে সাহিত্যে তাঁহার যেমন ব্যুৎপত্তি তেমনি অনুরাগ ছিল।’ এখানেই থামেননি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সম্পর্কে আরও গভীর শ্রদ্ধায় বলছেন, ‘সাহিত্যভোগের অকৃত্রিম উৎসাহ সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের চেয়ে অনেক বেশি দুর্লভ।’

Advertisement

একই সঙ্গে এ-ও বলা প্রয়োজন যে, অক্ষয়চন্দ্রের সহধর্মিণী শরৎকুমারীও সাহিত্য সমাজের এক পরিচিত নাম। তাঁর লেখালিখি সম্পর্কেও কবি সম্যক অবহিত ছিলেন। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা উমারানীকে প্রদান করে যান তাঁরা, তাঁদের প্রাপ্ত এই অমূল্য উপহার। এর পর উমারানী তাঁর কন্যা দেবযানীকে দিয়ে যান কবির এই ‘হৃদয়’। শিল্পী অতুল বসুর সহধর্মিণী দেবযানী। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, অতুল বসু শান্তিনিকেতনে কবির সামনে বসে তাঁর প্রতিকৃতি রচনা করেছিলেন। এর পর দেবযানী এবং অতুল বসু এই উপহার তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ ইলোরাকে প্রদান করেন। তিনিই এই শিল্পকর্মটি এই ‘হৃদয়’ ভাস্কর্যটি ‘দেবভাষা: বই ও শিল্পের আবাস’কে প্রদর্শনীর জন্য দিয়েছেন।

আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের অবদান এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে, এ কথা আর নতুন করে বলার নয়। এ বার তাঁর ‘হৃদয়’ ভাস্কর্য আরও এক নতুন ইতিহাসের মুখোমুখি করাল আমাদের। এই শিল্পকর্মটি যখন রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ। আর জীবনের সান্ধ্যকালে আসার পরে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য গড়েছেন রামকিঙ্কর বেজ। সেই সময়ে রামকিঙ্করকে কবি মাটি দিয়ে নিজের ভাস্কর্য করানোর বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।

ইতিহাসের অন্তর থেকে আজ জেগে উঠল যে ‘হৃদয়’, তাতে রচিত হল এক নতুন অধ্যায়। ‘দেবভাষা’ আয়োজিত এই প্রদর্শনীর পরিচালক রবীন্দ্র চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ সুশোভন অধিকারীর নিরীক্ষা বলছে, কবি গড়েছিলেন একটিমাত্র ভাস্কর্য। “নিতান্ত তরুণ বয়সে, নিজের হাতে নিপুণ ভাবে একটি কাচমণি পাথর কেটে তাকে দিয়েছিলেন ভাস্কর্যের আকার। গড়নের আলঙ্কারিক ভঙ্গিমা আমাদের ‘হার্ট-শেপ’কে মনে করিয়ে দেয়। এটির গায়ে গোটা গোটা অক্ষরে সযত্ন খোদাই করেছিলেন চার পংক্তির একটি ছোট কবিতা,” বললেন সুশোভন।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, কবিতাটি এই হৃদয়-পাথরেই কবি একমাত্র খোদিত করেছিলেন। তাঁর রচনাসম্ভারে কোথাও এটি সংযুক্ত হয়নি, ফলে এই ‘হৃদয়’ হয়ে রইল আরও দুর্মূল্য।

এই হৃদয়-ভাস্কর্যের মূল্যায়ন হয়তো পুরোপুরি সম্ভব নয়। তবে এটি যে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শধন্য একটি অমূল্য রত্ন, তা শিহরন জাগায়। ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে বিরাট এক স্থান জুড়ে এটি অবস্থান করবে চিরকাল। এই ভাস্কর্যের অণুপরমাণুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক মহা ব্যক্তিত্বের স্পর্শ এবং তাঁর প্রেম। হয়তো এটি যে কোনও শিল্পানুরাগী মানুষকে খুব কাছ থেকে কবিসত্তাকে অনুভব করতে সাহায্য করবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement