উৎসারিত: তাপস কোনারের আঁকা চিত্রকর্ম Sourced by the ABP
স্বতঃস্ফূর্ততা শিল্পের এক বিশেষ উপাদান। চারুবাসনা গ্যালারিতে সম্প্রতি শিল্পী তাপস কোনারের চিত্র প্রদর্শনীতে ছিল তেমনই এক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার সুচারু চিত্রসমূহের উপস্থাপনা। ‘ইরেজ়িং দি এসেনশিয়ালস— জেসচারাল অ্যাক্টস অব তাপস কোনার’ নামাঙ্কিত ছোট ও মাঝারি মাপের ছবির সুদৃশ্য এই প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন সোমাদিত্য দত্ত, যিনি নিজেও একজন ভাস্কর, অধ্যাপক ও লেখক। কোনও ভাস্কর যখন চিত্র প্রদর্শনী কিউরেট করেন, তখন স্বভাবতই স্পেস ও তার বিন্যাস, ছবি সাজানোর ক্ষেত্রে এক বিশেষ দিক তৈরি করে। কারণ ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে যে স্পেস হয় ত্রিমাত্রিক, ছবির ক্ষেত্রে সেই স্পেস সচরাচর হয়ে থাকে দ্বিমাত্রিক। সুতরাং এই প্রদর্শনীটি সাজানো হয়েছিল সেই উপলব্ধি দিয়ে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী তাপস কোনার বহু দিন পরে তাঁর এই একক প্রদর্শনীতে অনেকগুলি কাজ একত্রে পরিবেশন করেছেন। ভাবনা, মাধ্যম ও বিন্যাসে তাই আমরা পাই বহুরূপী মাধুর্য। স্বতঃস্ফূর্ততার নিরিখে যা নাকি একান্তই কাম্য। শিল্পমাত্রেই যেমন এক কাঠামোগত ডিজ়াইন প্রয়োজন, তেমনই সংক্ষেপক ভাবনাকে সরাসরি তুলে ধরার কৌশলটিও একান্ত জরুরি। তাই মনন ও গঠনের যখন ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ আদানপ্রদান ঘটে, তখনই তা চিত্রের পরিভাষায় উৎকৃষ্টতা পেয়ে থাকে। এই ছবিগুলির ক্ষেত্রে সেটি বিশেষ ভাবে দর্শনীয়।
স্বতঃস্ফূর্ততার মূল বৈশিষ্ট্য হল, স্রষ্টার তাৎক্ষণিক মানসিক চিন্তনের প্রকাশ। অর্থাৎ শিল্পীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সংযম ও পর্যাপ্তের মিলিত যে যৌগিক স্মৃতি— তা থেকে জেগে ওঠে এক শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। শিল্পী তখন খুব অনায়াসে নিজের ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে আত্মিক চিন্তনের মিশ্রণ ঘটিয়ে, নিজেকে ভারমুক্ত করার এক সৃষ্টিময় পথ খুঁজে পান। এ ক্ষেত্রেও শিল্পীর ছবিগুলিতে সেই প্রকাশ বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সৃষ্টিমাত্রেই যে আবেগপূর্ণ আলোড়ন ঘটে থাকে এবং তা মুক্ত করেই যে আসল আনন্দ উপভোগ করা যায়, সেই অভিব্যক্তি প্রায় প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই নজর কাড়ে।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিল্পায়ন’ গ্রন্থে বলেছেন, “জড়তা থেকে মুক্তি দেওয়া, আনন্দ ও ভোগের অধিকার বাড়িয়ে দেওয়া, এবং মানুষকে ক্ষমতাবান করে তোলা রসসৃষ্টি ও রূপসৃষ্টি বিষয়ে, এই হলো শিল্পের কাজ।” এ ক্ষেত্রেও শিল্পী তাপস কোনার তথাকথিত রূপের জড়তা কাটিয়ে, তাকে এক নতুন সাজে ও ধাঁচে, ছন্দোময় রেখার বুনটে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। দীর্ঘকাল শিল্পচর্চায় ব্রতী থাকার ফলে কখনও সরলীকৃত, কখনও আধো-আবছা, কখনও বা পুনরাবৃত্ত সাঙ্কেতিক রেখার বিন্যাসে এক নিজস্ব চিত্রভাষা রচনা করেছেন। যেমন তাঁর ‘পারুল ডায়েরি’ সিরিজের মধ্যে আমরা দেখি যে, শুধু মাত্র কালো কালির খেলায় রূপ ও অক্ষরের এক অন্তর্জগৎ ফুটে উঠেছে। সেখানে স্পর্শশূন্য কাল্পনিক রূপগুলির মধ্যে নেই কোনও আলোছায়ার প্রকোপ, নেই পরিপ্রেক্ষিতের সমারোহ— আছে শুধুই এক সংলাপের সজীবতা।
এ ছাড়া, অন্য কিছু ছবির ক্ষেত্রে আমরা দেখি, অলীক সব ফুল-পাতার আয়োজন। এই ছবিগুলিতে চিন, জাপানের ক্যালিগ্রাফিধর্মী রেখার উপস্থাপনা, মনের ক্ষণস্থায়ী সেই সব উজ্জীবিত মুহূর্তের প্রকাশ ঘটায়। আবার যেমন ‘আই প্লে অ্যান্ড ফাম্বল’, ‘ওয়েট লাইজ়’ ইত্যাদি ছবির নামকরণগুলিতেও সেই অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য দর্শককে তাঁর কল্পনা বুনতে সাহায্য করে।
অহেতুককে মুছে ফেলে, তাৎক্ষণিক ও কাল্পনিক রূপের ভাণ্ডার দিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনী তাই খুবই উল্লেখনীয়। “সত্য শিল্পে নিয়মের বন্ধন, দস্তুরের সঙ্কীর্ণতা না থাকাই যে শ্রেয়”— এ কথা সকল বিদ্বজ্জনই স্বীকার করেছেন। তাপস কোনারের ছবিগুলি সেই উক্তির এক দীপ্ত ও বাঙ্ময় উপস্থাপন।
সোহিনী ধর