তুলিকলা: শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তের শিল্পকর্ম Sourced by the ABP
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সুবোধ দাশগুপ্তর নির্বাচিত শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। শিল্পীর জন্ম ১৯৩০ সালে, প্রয়াণ ২০০৯-এ। প্রদর্শনীটি রূপায়িত হয়েছিল তাঁর পুত্র এবং কন্যার উদ্যোগে।
যৌবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সুবোধ। প্রায় চার বছর তাঁকে কাটাতে হয়েছে হাসপাতালে। সেখানে থাকাকালীন শিল্পী ফেলে দেওয়া ভাত খেতে আসা কাকের স্কেচ আঁকা শুরু করেন। ধীরে ধীরে ছবি আঁকাই হয়ে ওঠে তাঁর নেশা এবং পরে সেটা এতটাই তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, সুস্থ হওয়ার পরে তাই চাকরি ছেড়ে আলিঙ্গন করে নেন ছবি আঁকার অনিশ্চিত পেশাকে।
স্বশিক্ষিত শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ, কার্টুন, পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং, লেটারিং, বইয়ের ভিতরের অলঙ্করণ, লেখাঙ্কন ও সচিত্রকরণের যে বিপুল কর্মকৃতি এবং শৈলী প্রদর্শনীতে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হল, তা মুগ্ধকর। দর্শক নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে, যে সময়ে শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত এত সব কাজ করেছেন, তখন কোনও ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যার আমাদের কাছে ছিল না। সুবোধের কাজ অতি উচ্চ মানের হলেও দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওই সব অলঙ্করণ যে সব গল্প, উপন্যাসকে নতুন রসে সমৃদ্ধ করেছে, তাদের প্রকাশকেরা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলা ভরে শিল্পীর নাম বাদ দিয়েছেন!
কখনও আর্ট কলেজে না গিয়েও সুবোধ নিজেকে দক্ষ অলঙ্করণ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। সে সময় জন্মভূমি পত্রিকায় সমরেশ বসুর লেখা ‘গঙ্গা’ উপন্যাস থেকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘কুবেরের বিষয়-আশয়’-এর মতো কালজয়ী সব রচনায় শিল্পীর অঙ্কনশৈলীর কথা অনেকেই আজও মনে করেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের মতো শিল্পীও সুবোধ দাশগুপ্তের শিল্পকর্মের কদর করেছেন, দিয়েছেন শ্রদ্ধা ও সম্মান। সব সময়েই সংশ্লিষ্ট কাহিনির মর্মস্থলে ঢুকে সেটির অলঙ্করণকে স্বকীয়তায় বিশিষ্ট করে তুলতে জানতেন শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত।
‘গঙ্গা’ উপন্যাসের যে ছবিগুলি প্রদর্শনীতে দেখা গেল, তার মধ্যে একটি ছবি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই ছবিতে মোটা ব্রাশের টানে বেশ কয়েকটি নৌকোর গতি এবং গঙ্গার অভিনব একটি ছবি দেখা গেল। এ ছাড়া হিমানীশ গোস্বামীর ‘টিকিট’ গল্পটির অলঙ্করণও খুবই অন্য রকম, যা শিল্পীর তুলির মুনশিয়ানার পরিচয়বাহী।
শিল্পীর মোটা এবং সরু তুলির কাজে দর্শক এক সাইকেলচালকের ছবি দেখতে পেলেন এখানে। সাদা-কালোয় ছবিটি, তার মধ্যে গতিটি খুব সুন্দর ভাবে ধরেছেন শিল্পী।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘সাপের খোলস’ বইটির প্রচ্ছদ ডিজ়াইনও খুব আকর্ষক। ‘কুবেরের বিষয়-আশয়’ রচনাটিতে যে সব অলঙ্করণ ছিল, সেগুলি বিশেষ ভাবেই তাঁর অঙ্কনক্ষমতার পরিচয় রাখে। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হায় ছায়াবৃতা’ বইয়ের প্রচ্ছদের অলঙ্করণটিও অত্যন্ত মনোগ্রাহী।
তখনকার দিনে যাঁরা বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজ়াইন এবং অলঙ্করণ করতেন, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা চলতি ধারাকে অনুসরণ করে চলতেন। অনেকেই যথেষ্ট ভাল কাজ করেছেন সে সময়ে, কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে বেশির ভাগ শিল্পীই মোটামুটি এক ধরনের কাজ করেছেন। কিন্তু সুবোধ দাশগুপ্ত ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার। সব সময়েই চেষ্টা করতেন নতুন কিছু করার। তাই তাঁর কাজে বরাবরই একটা পরীক্ষানিরীক্ষার ছাপ পাওয়া যায়, যা তাঁকে সেই সময়কার অলঙ্করণ শিল্পীদের মধ্যে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে।
সুবোধ দাশগুপ্ত চারুশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাংসারিক প্রয়োজনে সারা জীবন অলঙ্করণ করেই কাটিয়েছেন। সময়ে সময়ে ফর্ম ভেঙেছেন, রেখার জোরও ছিল শক্তিশালী। নানা ভাবে টেক্সচার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন সফল ভাবে এবং বিভিন্ন স্থানে স্বকীয়তার ছাপও রেখেছেন। তাঁর পারিবারিক উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনীটি খুবই জরুরি ছিল, একই সঙ্গে উপভোগ্যও।