নাটকের একটি দৃশ্য
গত ২ মার্চ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে উপস্থাপিত হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত পূর্ব পশ্চিম নাট্যগোষ্ঠীর নতুন নাটক ‘জোছনাকুমারী’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এই উপন্যাস মানুষের অস্তিত্বের বিপন্নতার কথা বলে। মানুষের প্রকৃত পরিচয় কী? সে কি একটি ধর্মের প্রতিনিধি শুধু, একটি দেশের প্রতিনিধি? যদি একজন মানুষের কোনও ধর্ম না থাকে, যদি তার কোনও দেশ না থাকে, তাহলে কে সে? কী তার পরিচয়? আর এই মানুষটি যদি নারী হয়, তা হলে? কী দুঃসহ দুর্দশা হয় তার? জোছনাকুমারী এই সব প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলে। এই উপন্যাসটির নির্মেদ ও ঋজু নাট্যরূপ দিয়েছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত গড়বন্দীপুর গ্ৰামে এসে পড়ে একটি মেয়ে। তাকে সীমান্তরক্ষীরা ধর্ষণ করে। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। গাঁয়ের লোক ভাবে সে পরি বা প্রেতিনী! তাকে নিয়ে গল্পকথা তৈরি হয়। কেউ বলে সে ডাইনি, কেউ বলে সে জোছনাকুমারী। আকাশে উড়তে পারে। এ সবের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ভ্যানরিকশার চালক ত্রিলোচন ও তার বন্ধু বাবাজির। বাবাজির আসল নাম প্রাণকেষ্ট। সে রিকশা চালানোর পাশাপাশি তার গুপীযন্ত্র বাজিয়ে গান বাঁধে। ত্রিলোচনের বাবা কবিয়াল মনোহর সাঁতরা। তাই, ত্রিলোচন ভ্যানরিকশা চালালেও তার মধ্যে দয়া-মায়ার অনুভূতিগুলো রয়েছে। ত্রিলোচন তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে ত্রিলোচনের স্ত্রী জ্যামনি মেয়েটির শুশ্রূষা করে। অথচ গ্ৰামের লোক উত্তাল হয়ে ওঠে। কে এই মেয়েটি? কোথাকার? প্রথমে জানা যায় যে সে বীণা। পরে জানা যায় সে ফতিমা। এই নিয়ে গ্ৰামের মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আসলে মেয়েটি কে? হিন্দু না মুসলমান? ভারতীয় না বাংলাদেশি? এ সবের মধ্য দিয়েই জোছনাকুমারীর করুণ জীবন বয়ে চলে। দু’দেশের কাঁটাতারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, দু’টি ধর্মের কাঁটাতারে রক্তাক্ত হয়ে জোছনাকুমারী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এক অতল শূন্যতার ভিতরে।
‘জোছনাকুমারী’ নাটকটিতে প্রথমেই যে দু’জনের উল্লেখ করতে হয়, তাঁরা হলেন বাবাজির চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় ও ত্রিলোচনের ভূমিকায় মেঘনাদ ভট্টাচার্য। এই নাটকের এঁরাই প্রাণকেন্দ্র। দুই বর্ষীয়ান অভিনেতার যুগলবন্দি নাটকটির ভিতরে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ জাগিয়ে তুলেছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে দক্ষ দুই অভিনেতার পারস্পরিক বোঝাপড়া দেখার মতো। এঁদের আনন্দ, বিষাদ, হতাশা ও আবেগমথিত মুহূর্তগুলো নাটকটিকে তরঙ্গময় করে তুলেছে। জোছনাকুমারীর ভূমিকায় সুচন্দ্রা সাউ চরিত্রানুগ কাজ করেছেন। ধর্ষণের ফলে এক নারীর ট্রমা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, অসহায়তা ও উন্মত্ততা তাঁর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে। ত্রিলোচনের স্ত্রী জ্যামনি চরিত্রে জয়িতা চৌধুরী শক্তিশালী। গ্ৰামবাসীর উৎপীড়নের মুখে দাঁড়িয়ে, তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ ভাল লেগেছে। পরমজিৎ সিংহের চরিত্রে প্রণব দেব, ডাক্তার নবেন্দুর চরিত্রে অরূপরতন গঙ্গোপাধ্যায় ও গোষ্ঠবিহারীর ভূমিকায় তরুণ পাল সাবলীল। গ্ৰামীণ মাতব্বর-সমাজপতি রাজেন ঘোষের ভূমিকায় সৌমিত্র মিত্র যথাযথ কাজ করেছেন।
অভিজিৎ আচার্যের সঙ্গীত, সুদীপ সান্যালের আলো, মালবিকা মিত্রর পোশাক ও মহম্মদ আলির মেক-আপ যথাযথ মনে হয়েছে। দেবব্রত মাইতির মঞ্চ নির্মাণ, বিশেষত চেকপোস্ট ও কাঁটাতারের দৃশ্যায়ন ভাল লেগেছে। এই নাটকটি সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করেছেন সৌমিত্র মিত্র। নানা খুঁটিনাটির দিকে তিনি নজর দিয়েছেন। বিশেষ করে অভিনেতা নির্বাচনের কথা বলতেই হয়। তবে, সব শেষে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন— শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের গলার গানগুলো সরাসরি মঞ্চে গীত হলেই ভাল হত। মঞ্চে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে রেকর্ডেড ভয়েস বেজে ওঠাটা আরোপিত মনে হয়েছে, কানে লেগেছে।