রং ও রেখা: দেবভাষায় আয়োজিত শিল্পী অতুল বসুর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি দেবভাষার উদ্যোগে পরিবেশিত হল প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী অতুল বসুর (১৮৯৮-১৯৭৭) বিরল প্রদর্শনী— ‘পারসিস্টেন্স অব টাইম’ অর্থাৎ সময়ের অধ্যবসায়।
‘প্রতিকৃতি আঁকিয়ে’র তকমা নিয়ে শিল্পী অতুল বসু শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করলেও, সারা জীবন যে সব স্কেচ, ড্রয়িং এবং জলরঙের ছবি করে গিয়েছেন, সেই অধ্যায় ছাড়া শিল্পীর সম্পর্কে জানা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না।
গ্যালারির বাঁ দিকের তুলনামূলক ছোট একটি ঘরে সাজানো ছিল মোট ৪২-৪৩টি ছবি। গ্যালারির দেওয়াল ছাড়াও, চারটি কোনায় ছিল সেই সময়ের সংরক্ষিত কিছু লাইফ স্টাডির কাজ। মানবদেহের খাঁজ, ভঙ্গি ও সূক্ষ্ম অ্যানাটমিক ডিটেলের আঁচড় ছিল দেখার মতো। স্বল্প রেখায় গোটা পরিবেশকে তুলে ধরার প্রবণতায় একটি কথাই স্পষ্ট হয়— চিত্রপটের ব্যবহার কী ভাবে করা উচিত, তা শিল্পীর প্রতি পদে শিক্ষণীয়।
রং ও রেখা: দেবভাষায় আয়োজিত শিল্পী অতুল বসুর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
অতুল বসুর স্টাডিভিত্তিক কাজ নিয়ে এর আগেও দেবভাষার নিজস্ব ভবনে প্রদর্শনী হয়েছে। এ বারের প্রদর্শনীর ছবিগুলিও প্রত্যক্ষ দর্শনের স্টাডিধর্মী কাজের প্রতিফলন। কতটা ফুটিয়ে তুলতে হবে আর কতটা হবে না, রেখার আয়ত্তে মূল ভাবকে কতখানি প্রকাশ করতে হবে, সে দিকে শিল্পীর প্রখর নজর।
কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মভিটে ছিল অবিভক্ত ভারতের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রসুনিয়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই প্রতিকৃতি আঁকার প্রবল ঝোঁক ছিল। পরবর্তী কালে রণদা গুপ্তের আর্ট স্কুল এবং সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন যামিনী প্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত প্রতিকৃতি চিত্রকরকে। কাজের জন্য সরকারি বৃত্তি পেয়ে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমিতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ভারতে ফিরে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩০ সালে বাকিংহাম প্যালেসের রাজপরিবারের সদস্যদের পোর্ট্রেট করার সুযোগ পেয়েছিলেন অতুল বসু।
রং ও রেখা: দেবভাষায় আয়োজিত শিল্পী অতুল বসুর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
মাত্র পনেরো মিনিটে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তুমুল সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এই শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি করা নিয়েও অনেক গল্প আছে। আর এক বিখ্যাত শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের লেখাতেই সে সব গল্প জানা যায়। শিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর ‘রং তুলির বাইরে’ বইয়ের একটি জায়গায় লিখছেন, “সেরা পোর্ট্রেট তখনই আঁকা হয়, যখন একটি প্রতিকৃতি একটি বিশেষ মানুষের নিছক চেহারার বর্ণনাকে ছাপিয়ে তাবৎ নান্দনিক গুণাগুণ সম্বলিত কালকে অতিক্রম করে থাকে... প্রতিকৃতি আঁকায় অতুল বোসের কথা নতুন করে আর কী বলব? এ কাজে তিনি তো সত্যিই অতুলনীয়।”
দেবভাষার এই প্রদর্শনীতে স্বল্প রেখার দু’-তিনটি রৈখিক পোর্ট্রেট ছাড়া ছিল তিনটি জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ ও ড্রয়িংয়ে তুলে ধরা অসাধারণ কিছু মুহূর্তের স্কেচ। প্রতিটি ছবি নিছক দেখার স্তরকে ছাপিয়ে, চিরমগ্নতার ক্লাসিক বিশেষণে অভিহিত হয়। চিত্রকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্তিকে আগাগোড়া মর্যাদার সঙ্গে বজায় রেখেছিলেন শিল্পী অতুল বসু। সে ক্ষেত্রে এক সময়ের শিল্প আন্দোলনের পরপর অস্থিরতার নির্মাণের দিকে তিনি যাননি। তাঁর লেখা ‘বাংলায় চিত্রকলা ও রাজনীতির একশ বছর’ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য উঠে আসে।
বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী মানুষ, ’৪৩-এর আকাল শিল্পীর কালি ও পেনসিলে যে ভাবে উঠে এসেছে, তার দর্শন শুধুই ছবির ফ্রেম নয়। ঠিক যেন সামনে চলে আসে সেই মন্বন্তর এবং সেখানকার অসহায় পরিবেশ।
রেখার বিন্যাসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসে অনায়াসেই তাঁর হাত ঘুরে বেড়িয়েছে মসৃণ রাস্তায়। তার মুখ্য প্রমাণ স্ত্রী দেবযানী এবং জে এন বসুর (দেবযানীর পিতা) অসামান্য হালকা শেডের নজরকাড়া দু’টি প্রতিকৃতি। এই প্রদর্শনীতে বিভিন্ন সময় ও জায়গার স্টাডিভিত্তিক কাজ দেখানো হলেও শিল্পী ছিলেন নিজেই একজন বলিষ্ঠ নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ ঠিক যতটুকু উনি চাইছেন, ঠিক ততটুকুই দেখবেন দর্শক। তাঁর ছবিগুলি দেখলে বোঝা যায়, ধরে ধরে কোনও স্টাডি নয়, বরং প্রত্যেক দিন স্কেচ করার স্কুলিং-কে বজায় রাখার একটা চেষ্টা ধরা পড়েছে। এ ছাড়া ছিল কলেজ জীবন ও তার পরবর্তী কালের কিছু ড্রয়িং। শিল্পীর শেষ কাজ হিসেবে দেখতে পাওয়া গেল কাগজের উপরে ক্রেয়নে করা রঙিন ফুলের একটি ছবি (১৯৭৬)।
প্রদর্শনীর অনেক ভাল ছবির মধ্যে কিছু কাজ বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। যেমন বিশ্রামরত উল্লম্ব প্রণালী ধরে দু’টি গরুর দু’রকম ভঙ্গি... অথচ একই বিশ্রামের গল্প। শুধু তো স্কিল নয়, এ যেন এক্সপ্রেশনকে বার করে আনা। আর একটি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় আঁকা ঘুমন্ত শিশুদের মুদ্রা। পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী রেখার টান ও খালি জায়গার অনুচ্চারিত রেখার ওজন... ভাবা যায় না!
দূর থেকে দেখা যায় ছোট্ট একটি নৌকা, অসম্ভব সুন্দর। গোপালপুর, বারাণসী, শিমলার কয়েকটি দৃশ্য আবার ইম্প্রেশনিস্ট স্টাইলের। ইউরোপীয় ঘরানার জলরঙের কাজের মতো কিছুটা, তবে প্রকৃতিতে অনেকটাই আলাদা।
ন্যূনতম ড্রয়িংয়ের মধ্যে আসল ভাবকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে যে দীর্ঘ প্রয়াসের ইতিহাস আছে, অন্ততপক্ষে তার অনুভব পেতে অতুল বসুর কাজ দেখা দরকার। সে দিক থেকে এই প্রদর্শনীটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়