পরম্পরা: সঙ্গীতা জৈনের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী।
চিত্রকলা, ভাস্কর্য, বিবিধ প্রদর্শনীর বাহুল্যে অনেক শিল্পীর নাম হারিয়ে যায়। প্রদর্শনী চলতেই থাকে। শিল্পী-ভাস্করদের মধ্যে প্রবীণ থেকে সমকালীন, নবীন, এমনকি শিক্ষানবিশ পর্যায়েরও অনেকেই থাকেন। আসেন, চলেও যান। সকলেই শিল্পকলার এই ধারাবাহিক অনুশীলন-অভ্যাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার চেষ্টা করেন না। সে সব ক্ষেত্রে ভালবাসা বা লেগে থাকার প্রতি একটা সন্দেহ থেকেই যায়।
সঙ্গীতা জৈন একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। তাঁর শিক্ষক অমর দাসকে আমন্ত্রিত হিসেবে রেখে একটি প্রদর্শনী সম্পন্ন করলেন বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। এটি সঙ্গীতার প্রায় একক প্রদর্শনীর মতোই বলা চলে। শিক্ষকের মাত্র আটটি কাজ ছিল। আগেই ওঁর কাজ সম্পর্কে অনেকটাই আলোচনা হয়েছিল। এ বারেও দেখা গেল, আটটি কাজেই বড় বেশি পিকাসো, মদিগ্লিয়ানি, পরিতোষ সেনের প্রভাব। স্ট্র দিয়ে ডাবের জল খাওয়ার ছবিটি তো পরিতোষের ছবিকেই মনে করিয়ে দেয়। সবই অয়েল, অতি ফিনিশিংয়ের ফলে বেশ কাঠিন্য এসে গিয়েছে ছবিগুলিতে। তাঁকে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। ড্রয়িং বেশ ভাল।
সঙ্গীতার প্রায় পঞ্চাশের কিছু কম কাজ ছিল। কাগজে জলরং থেকে ক্যানভাসে অয়েল, অ্যাক্রিলিক ছাড়াও চারকোল, প্যাস্টেল, ড্রাই প্যাস্টেল, মিশ্র মাধ্যম... সবই। তিনি সব কাজেই চেষ্টা করেছেন একটা পরিমিত জায়গা পর্যন্ত কাজটিকে শেষ করার। বাহুল্যহীন, অনাবশ্যক বর্ণ বা রেখা, ব্রাশিংয়ের স্টাইলকে ভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত করার বাসনা নেই কোথাও। কিন্তু ড্রয়িং ও কম্পোজ়িশনের ক্ষেত্রে অ্যারেঞ্জমেন্টের দুর্বলতা চোখ এড়িয়ে যায় না। অনেক জায়গাতেই, কিছুটা কম হলেও... বেশ শিশুসুলভ প্রক্রিয়াও চোখে পড়ে। বিশেষ করে তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলিতে। নির্দিষ্ট একটি স্টাইল তৈরি হতে সময় লাগবে। যেখানে অবয়ব-ঘেঁষা ছবিতে একটা নিষ্ঠা দেখা যায়, আবার হঠাৎ একই ধরনের ভাবনায় অন্য শরীরী মুহূর্তের কাজে ক্যালেন্ডার মার্কা ছবির কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
‘স্টিল লাইফ’ কাজটিতে চারকোলের ব্যবহার চমৎকার। বিশেষত সাদা হাইলাইটের জায়গাগুলি বেশ জীবন্ত নাটকীয়তায় আচ্ছন্ন। হয়তো কোথাও গুরুমারা বিদ্যে না গুরুর প্রত্যক্ষ হাত কাজ করেছে, বুঝতে ধন্দে পড়তে হয়। এই ধরনের কাজে চারকোলেরই করা ‘ওয়েটিং’ অসামান্য। মহিলার সারা শরীরের আলোর বিচ্ছুরণ পটভূমির অন্ধকারকে আরও কাব্যিক ও মহিমাময় করেছে। এর রিয়্যালিজ়ম অন্য সবের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা রকম।
তবে তাঁর ‘রেড ফ্লাওয়ার’, ‘ফাদার অ্যান্ড চাইল্ড’, ‘মীরাবাঈ’, ‘রাগিণী’, ‘কৃষ্ণ-টু’, ‘ওম শান্তি’, ‘লোনলি আফটারনুন’, ‘আকাঙ্ক্ষা’ ইত্যাদি কিছু কাজে কাঠিন্য প্রবল। সে রঙের ব্যবহার থেকে স্টাইল, রচনা, ড্রয়িং, অ্যারেঞ্জমেন্ট সবেতেই। বিশেষ করে ‘ল্যান্ডস্কেপ-টু’, ‘ল্যান্ডস্কেপ-ফাইভ’, ‘থ্রি আমব্রেলাস’, ‘বুদ্ধ-টু’, ‘আফটারনুন ওয়াক’, ‘অরণ্যকন্যা’ ইত্যাদি কিছু কাজ এত বেশি শিশুসুলভ ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল যে, অন্যান্য কিছু ভাল মানের কাজের পাশে এগুলি না রাখলে ক্ষতি ছিল না। ‘হংসিনী’র বিশাল রকম স্ফীত হাত ও আঙুল, ‘ডিভোশন’-এর শিবলিঙ্গের গায়ের তিন অংশের প্রতীক, ‘রিফ্লেকশন’-এর সমগ্র রচনা বড় পীড়াদায়ক। তবে তাঁর ‘শিবা-ওয়ান’, ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’, ‘ফ্রিডম’, ‘শিবা-টু’, ‘ইন লাভ’ মন্দ নয়। এগুলিতে পরিশ্রম ও ভাবনার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, গুণগত মানের দিকটিও কিছুটা হলেও পালন করেছেন।
তবে সঙ্গীতা ঘোর অন্ধকার ও আপাত অন্ধকারাচ্ছন্ন পটভূমিতে যে কাজগুলি করেছেন, সেগুলির পেন্টিং কোয়ালিটি অনেক প্রখর। এখানে গুরুর হাত উপেক্ষণীয় নয়। তাঁর ফিনিশিং হাইলাইটস, ড্রয়িং স্টাইল... এগুলি প্রত্যক্ষ করলেই স্পষ্ট হয়।
শিষ্য-শিষ্যা গুরুর বিদ্যা আয়ত্ত করবেন, এ আর আশ্চর্য কি! তবে তাকে আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ নিজের মতো একটি বা একাধিক কাজে তার ছাপ থাকবে না? এই প্রদর্শনীতে তা নেই এমন নয়, তবে শিষ্যাকে আরও গভীরে যেতে হবে। বিশেষ করে ড্রয়িং, কম্পোজ়িশন ও ফিনিশিংয়ের দিকটিতে সচেতন ভাবে মনোনিবেশ ও চর্চা-অনুশীলন প্রয়োজন।
‘ফেস্টিভ্যাল’, ‘ডিভোশন’, ‘ইন লাভ-টু’ ইত্যাদি কাজে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ হাত থাকলেও ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক, অয়েল ও মিশ্র মাধ্যমের কাজগুলিতে চমৎকারিত্ব রয়েছে।