প্রকৃতি: শিল্পী অরুণিমা চৌধুরীর কয়েকটি কাজ প্রদর্শিত হল অনলাইনে
সেই কবেই তো কবি লিখেছিলেন, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি।’ বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে মানুষকে। সৃষ্টিশীলতা কোনও দুর্মর শক্তির কাছেই হার মানেনি কখনও। নির্মাণ ও সৃষ্টি যেন মানবতার শপথবাক্য। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মারাত্মক মহামারি, ভয়াবহ ভাইরাস, প্রবল প্রাকৃতিক প্রলয়, এমনকি নিশ্চিত নিয়তিও মানুষকে নিরন্তর নির্মাণের নিশ্চিন্ততা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সৃজনশীল সৃষ্টির স্মৃতি বরাবরই গর্বের, যা বহমান অর্বুদ বাধা পেরিয়েও। ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন’— তা সত্ত্বেও ছবি, ভাস্কর্য, কাব্য, সঙ্গীত, নাট্য, সাহিত্য-সহ আরও বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার স্রোত দ্রুতগামী। শিল্পী থামতে জানেন না, চিরন্তন এ সত্য বিশ্বব্যাপী। এ তো এক ধরনের লড়াই, যে লড়াই জিততে হবে এ প্রত্যয়ে সকল নির্মাণের সঙ্গে আরও নিবিড় ভাবে সৃষ্টিকর্তা নিজেই যেন নিরবচ্ছিন্ন আর এক যুদ্ধে অবতীর্ণ।
এই আলোচনার অবতারণা সময়ের এক দুঃসহ দুরবস্থা নিয়ে। যে দুঃসময়ে মানুষ বঞ্চিত বহু কিছুর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া এক আশ্চর্য আবহে। কিন্তু কত দিন? অনেক সংস্থা, ব্যক্তি, সংগঠন এই কঠিন সময়ের বিরুদ্ধে তাঁদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করছেন মানুষের সৃষ্টি মানুষের কাছেই পৌঁছে দিতে। এই সফল উদ্যোগের পথে অনলাইনকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। ইমামি আর্ট এমন ভাবনা থেকেই শুরু করেছে কয়েকটি শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন, যা দেখা যাবে তাদের ওয়েবসাইটে। অবশ্যই অনলাইন প্রদর্শনী। বর্তমানে কমবেশি অনেকেই এমন ভাবনায় কাজ করছেন।
‘নেচার অ্যাজ় আই সি’ শিরোনামের প্রদর্শনীর শিল্পী অরুণিমা চৌধুরী। সত্তর বছরেও তাঁর ধারাবাহিক চর্চা ও বিবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁকে সচল রেখেছে। প্রদর্শনীর জন্য তিনি মোট আটটি কাজ রেখেছেন, সঙ্গে আরও চারটি ছোট কাজ নিয়ে একটি কাজের বিন্যাস। বরাবরই তাঁর কাজে প্রকৃতি ও মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। নিসর্গের পরিচিত ‘রূপ’কে বিন্যস্ত করেছেন নিজস্ব আঙ্গিকে। যেখানে বৃক্ষ-পুষ্প-পল্লবিত শোভা তার বৈচিত্র নিয়ে কাগজে, ক্যানভাসে আর এক রকম আলঙ্কারিক বিন্যাসে প্রতিফলিত। এখানে তিনি যে কাজগুলি করেছেন, প্রকৃতিকে সেখানে কখনও জননী, পত্রপুষ্প, নারী ইত্যাদি নানা ভাবেই কল্পনা করেছেন। উল্লেখ্য যে, এক সময়ে নন্দলাল বসুর বিশিষ্ট গ্রন্থ ‘শিল্পচর্চা’ অরুণিমাকে ভীষণ ভাবেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। হয়তো ওই সব আলোচনা ও শিক্ষণপদ্ধতি তাঁকে পরবর্তী কালে শিল্পের বিবিধ প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে। যার ফলস্বরূপ তিনি বহুকাল ধরেই বিভিন্ন ভেষজ রং দিয়ে ছবি আঁকছেন। এখানেও ওই ভেষজ রঙের মাধ্যমেই ছবিগুলি এঁকেছেন। সবই নতুন কাজ, দু’-তিনটি সামান্য আগের।
ভেষজ রং বলতে অরুণিমা অনেক রকম ফুল ও বৃক্ষপত্রের রস থেকে রং তৈরি করেন। অবশ্যই তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণে এক-একটি রং সম্পূর্ণ হয়। প্রদর্শনীর কাজগুলিতে নারী বা জননীর রূপকে প্রাধান্য দিয়ে, বর্ণকে কখনও তিনি তরলায়িত স্বচ্ছতার বাতাবরণ তৈরি করেছেন, পাশাপাশি অনচ্ছ বর্ণের আভাসও দিয়েছেন কিছু কাজে। আপাতস্থূল অবয়বী ছবিগুলিতে লৌকিক সারল্য ও গ্রামীণ লোকজ আঙ্গিকের ধারণা স্পষ্ট। কখনও বর্ণের দ্বৈত উপস্থাপনার মাঝের সরু অংশ যেন অ্যান্টিলাইনের অনুভূতি জাগায়। শ্যাওলাবর্ণ মায়ের কোলে নাদুস সাদা শিশুটি এবং মায়ের দু’হাতের নিবিড় বন্ধন ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। ইতস্তত কয়েকটি পুষ্পের একক রচনা। একটি ছবির আপাতবিষণ্ণ বসে থাকা নারীর গোটা শরীরে খয়েরি ফুলের প্রতিচ্ছায়াসদৃশ ব্যঞ্জনা বেশ কাব্যিক আবহে আচ্ছন্ন।
স্বচ্ছ ও অনচ্ছ বর্ণের মাধ্যমে ফুল-লতাপাতাময় এক বিন্যস্ত পটভূমি কিছুটা আলঙ্কারিক। একাকী মেয়ের একটি মুখাবয়বের মাঝে রং ছেড়ে-রাখা সাদার বিস্তার ও হঠাৎ হালকা রঙের স্বল্প কাজ ছবিকে তেমন ভাবে বাঙ্ময় করেনি। এখানে কিছুটা দুর্বলতা লক্ষণীয়। ফুল-পাতার আলঙ্কারিকতার মাঝে পৌত্তলিকপ্রধান এক শিশুর লম্বা টানা চোখ ও অভিব্যক্তির নীরবতার ছবিটি ভাস্বর। ড্রয়িংসদৃশ দীর্ঘ মানব সম্প্রদায় ও মাঝে হঠাৎই তিন জায়গায় গোলাপি ফুলেল ড্রয়িং ছবিটিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করেছে। তাঁর চারটি ছোট কাজের সংগঠিত প্রয়াস, স্টাইল, রচনা এবং আধুনিকতা বেশ প্রাণবন্ত নিঃসন্দেহে।