চাকদহের নাট্যগোষ্ঠী হযবরল-এর প্রযোজনা ‘জাহানারা জাহানারা’-তে (রচনা/পরিচালনা : চন্দন সেন) মঞ্চ বিভক্ত দুই মেরুপ্রান্তিক দৃশ্যে – প্রধান দৃশ্যে একটি বেশ্যাপল্লির দুটি ঘর, একটি জাহানারার অন্যটি এক তথ্যচিত্র নির্মাতা ও গবেষক শুভঙ্করের। অন্য প্রান্তে বালিগঞ্জের এক সম্পন্ন বনেদি পরিবারের বাড়ি যার মালিক এক নিষ্ঠবান ব্রাক্ষ্মণ বৃদ্ধ। ক্যানিঙের পতিতা তরুণী জাহানারা বালিগঞ্জে উচ্চবিত্ত ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে পরিচারিকা, নাম তখন জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই মেরু-সংযোগে যে নাটক জমে ওঠে তাতে ধরা পড়ে ধর্ম, সংস্কার, দারিদ্র ও শ্রেণি বিভাজনের সমকালীন সমাজচিত্র, যদিও মূলত কাহিনি গরিব পিতৃমাতৃহারা জাহানারার বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই এবং তার পিতৃপরিচয়হীন মেয়েকে এক সুন্দর জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে।
বলা বাহুল্য, এমন প্রযোজনায় দৃশ্যে, ঘটনায়, দেহব্যাবসার পরিবেশের ক্লেদ-গ্লানি তিক্ততায় অবসাদে এবং বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে মঞ্চে আছড়ে পড়া জাহানারার স্বপ্নভঙ্গের করুণ আর্তিতে প্রবল নাটকীয়তা আছে এবং খুবই উচ্চগ্রামে বেঁধে দিয়েছেন পরিচালক। ফলে নাটকের কাহিনিতে এসেছে সাজানো ঘটনার এবং অভিনয়ে—বৃন্দা ঘোষের (জাহানারার) অতিনাটকীয়তার ঝোঁক। শুভঙ্কর (কৌশিক ঘোষ) চরিত্রটি প্রত্যয়যোগ্য হয়নি। তার পতিতালয়বাসের প্রয়োজন যে তার কাজের জন্যে ম়ঞ্চে তা আদৌ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। পতিতাদের মুখের ভাষা সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ করা যায় না বলেই মঞ্চে তাদের বাগধারা অতিরিক্ত শালা-নির্ভর। সান্যাল বাড়ির ছেলে আর বউমা চরিত্রের কোনও সক্রিয় নাটকীয় ভূমিকা নেই কেবল সান্যালদের বংশগৌরবের বড়াই আর তার অসারত্ব আলোচনা ছাড়া। এসব সত্ত্বেও প্রযোজনার সাংগঠনিক সৌকর্যে, মঞ্চসজ্জা, সাধারণভাবে একক ও দলগত অভিনয়ে নাটকীয় দৃশ্য ও মুহূর্তগুলির সফল অভিঘাতে নাটক আগাগোড়া দর্শককে টেনে রাখে।
চোখ বুজে থাকা নয়
‘বারোশিঙায় ফুঁ’ নাটকে। লিখছেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী
মানব সভ্যতা যতই বেড়ি পড়াতে চেয়েছে প্রকৃতির পায়ে, বাঁধন কেটে সে ততই বিপর্যয় ফিরিয়ে দিয়েছে সভ্যতাকে। এ এক অনিবার্য নিয়ম। প্রকৃতি বনাম সভ্যতার সেই চির-সম্পর্ক নিয়েই ‘গোবরডাঙা কথাপ্রসঙ্গ’-র নাটক ‘বারোশিঙায় ফুঁ’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘চিরদিনের ইতিহাস’ গল্পকে অবলম্বন করে বিকাশ বিশ্বাস এ নাটক নির্মাণ করেছেন। নাট্যকার দেবব্রত দাস।
জঙ্গলের নাম তরঙ্গিয়া। কাছেই দুন পাহাড়। তারই মধ্যে বারোশিঙার জলা। কিন্তু, পশুপাখিদের মধ্যে শান্তি নেই। চিতা বাঘ আর কেদো বাঘের খিদের জোগান দিতে গিয়ে তাদের অনেককেই সাবাড় হতে হয়েছে। প্রাণ বাঁচানোর উপায় খুঁজতে সকলেই তাই গেছো প্যাঁচা হুতুমের শরণাপন্ন হয়। দু’পেয়ে হিসেবে সে বোধ-বিবেচনায় নিজেকে মানুষের সমতুল মনে করে। উপায় একটা বাতলালো বটে হুতুম! দু’পেয়েদের গ্রাম থেকে তাদের জঙ্গলে নিয়ে আসার পরামর্শ। সেই মতো দুনের লাল নুড়ির লোভ দেখিয়ে মানুষ আনা হল জঙ্গলে। তারা এসে প্রথমেই চিতা ও কেদোর ভবলীলা সাঙ্গ করে। সকলে ভেবেছিল এতেই শান্তি ফিরবে জঙ্গলে। কিন্তু সে গুড়ে যে বালি ছিল। কারণ, দু’পেয়েদের কাছে এ বার লক্ষ্য হয়ে উঠল তারাই। অনেকেরই প্রাণ গেল। বাকিরা পালাল অন্যত্র। সাফ হতে শুরু হল জঙ্গল। পাহাড়েরও নিস্তার মিলল না।
মানুষের উপস্থাপনায় মাপেট ব্যবহার করেছেন নির্দেশক। হুতোম-সহ অন্যদের যে ভাবে তৈরি করেছেন মুখোশ-শিল্পী সুরজিৎ রায়, তা অনবদ্য। বরুণ করের আলো এবং নীলাঞ্জন ভৌমিকের হুতুম নজর কাড়ে।
শেষ হল ছাদনাতলায়
বৌদির বিয়ে নাটকে। লিখছেন পিয়ালী দাস
কথায় আছে সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে। নারীর উপস্থিতি ছাড়া কোনও সংসারই পরিপূর্ণতা পায় না। এই নিয়েই ‘এবং দ্বান্দ্বিক’-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল নাটক ‘বৌদির বিয়ে’। হাস্যরসে ভরপুর এই নাটক। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যেখানে কমেডি নাটকের প্রযোজনা প্রায় বিলুপ্ত, সেখানে এ বড় প্রাপ্তি। নাটকটি দর্শকের ভাল লাগে।
নারী বর্জিত চার ভাইয়ের সংসার। যুধিষ্ঠীর, ভীম, নকুল, সহদেব এবং পরিচারক কান্তা। বাড়ি অগোছালো। কোথাও প্রাণের ছোঁয়াটুকু নেই। অগত্যা সংসারে শ্রী ফেরাতে তিন ভাই মিলে ঠিক করে বড়দার বিয়ে দেবে। চাপও সৃষ্টি করে। কিন্তু তাদের হতাশ করে যুধিষ্ঠীর নিজের পছন্দ করা একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে আনে। আর তাতেই গোলযোগ। কিন্তু নববধূর বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতায় পুনরায় পরিবারে শান্তি ফিরে আসে। পরিবার একান্নবর্তী হয়। সকলের অভিনয়ই নজরকা়ড়া। যুধিষ্ঠীরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্দ্রনীল। যিনি একাধারে নাটকের নির্দেশকও। সমীর, অমিত, পলাশ এবং দীপঙ্কর যথাযথ। বৌদি ইস্পিতা অনবদ্য। নাট্যকার শৈলেশ গুহ নিয়োগী। আবহে শান্তনু মুখোপাধ্যায়।