হরিশ্চন্দ্র রায়। ভদ্রলোকের জমিদারি তখন পড়তির দিকে। বাড়িতে পাওনাদারদের নিয়মিত কড়া নাড়া। স্ত্রী ভুবনমোহিনীদেবী অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের গয়নার টাকায় কেনা জমিদারির তালুক বিক্রির কাগজে সই করছেন। তাঁদের কলকাতার বাসা উঠে গেল। ফিরলেন খুলনার গাঁয়ে। ছেলেরা উঠলেন হস্টেলে।
সেজো ছেলের (জন্ম, ২ অগস্ট, ১৮৬১) জীবনে এই দৃশ্যটি মনে থেকে গেল। কিছু দিন পরে সেই ছেলেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতের পথে রওনা দিতে উদ্যোগী হলেন। যাওয়ার আগে মা’কে বললেন, ‘জীবনে সাফল্য লাভ করলে, প্রথমেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও বাড়ির সংস্কার করব।’
সে কাজ বেশ কিছুটা করেওছিলেন। কিন্তু বাড়ির তুলনায় বাইরের জগৎ তাঁকে যে বেশি টানে। সেই টান আর দেশের কাজের জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আচার্য’। তিনিই প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু একটি বিষয়ই বলা যেতে পারে, তা হল— মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারকে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হলেও যৌগটির ‘অস্তিত্ব’ এখনও অধরা, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব, ‘জৈব নাইট্রাইট, গন্ধকযুক্ত বিবিধ জৈব যৌগ এবং ধাতব লবণের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়া, জৈব হ্যালোজেন যৌগ বিশেষত ফ্লোরিনযুক্ত এবং পারদের ধাতু যুক্ত জৈব যৌগ— এ সবের প্রস্তুতি ও পরীক্ষণের সূচনা’ করা। কিন্তু এ বিষয়গুলি বহুল চর্চিত। তাই জীবনভর নানা কাজ, জেদের মধ্য দিয়ে কী ভাবে প্রফুল্ল-চরিত্র তৈরি হয়েছিল, তা সন্ধানেরই চেষ্টা করব আমরা।
জেদের ছাত্রাবস্থা
জন্মস্থান রাড়ুলি গ্রামেই স্কুলছাত্র তখন প্রফুল্লচন্দ্র। ইতিহাস, ভূগোলের নানা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকেন। একদিন মনে হল, বাবার ভূগোলের জ্ঞান পরীক্ষা করলে কেমন হয়! শিশু প্রফুল্লচন্দ্রের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, সিবাস্টোপল কোথায়?’ মুহূর্তে বাবা হরিশ্চন্দ্রের উত্তর, ‘কী সিবাস্টোপলের কথা বলছ? ইংরেজরা ওই শহর কী ভাবে অবরোধ করল, তা যেন চোখে ভাসে!’ (‘সিজ় অব সিবাস্টোপল’, ১৮৫৪-৫৫) — প্রফুল্লচন্দ্রের মানসিক গঠনের প্রস্তুতি-পর্বে তাঁর বাবার ভূমিকা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বাড়িতে ডিএল রিচার্ডসনের ‘সিলেকশনস ফ্রম দ্য ব্রিটিশ পোয়েটস’-সহ দেশ-বিদেশের নানা বই, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘অমৃতবাজার’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-সহ নানা পত্রিকার বিপুল সম্ভার তাঁর। গ্রামে একটি ইংরেজি-বাংলা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এমনকি, তাঁরই উদ্যোগে এক বার গ্রামের স্কুলের পণ্ডিত পৈতেত্যাগী মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ বিধবা বিবাহেও সম্মত হলেন। লোকজনের বাধায় তা সম্পন্ন হল না। এমন প্রগতিবাদী হরিশ্চন্দ্র ও টাকীর কালীনাথ মুন্সিকে নিয়ে ছড়া কাটল গোঁড়ার দল: ‘‘হা কৃষ্ণ, হা হরি, এ কি ঘটাইল,/ রাড়ুলি টাকীর ন্যায় দেশ মজাইল।’’
বাবার পরিকল্পনাতেই কলকাতায় পড়তে আসা, ওঠা ১৩২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসা, চাঁপাতলায়। হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন। ১৮৭০-এর কলকাতায় তখন কলে জল সরবরাহ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান-মনের অধিকারী বালক প্রফুল্লচন্দ্র বিষয়টি অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকলেন। বারবার ছুটে যেতেন ময়দানে, অ্যালবার্ট হলে কেশবচন্দ্র সেনের ওজস্বী বক্তৃতা শুনতে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি অনুরাগ এই সময় থেকেই তৈরি হল। পাশাপাশি, ভোর তিনটে-চারটে থেকে উঠে পাঠ্যক্রমের বাইরের বই পড়াও চলতে থাকল নিয়মিত।
এর ফল হল মারাত্মক, কৈশোরে কঠিন রোগে পড়লেন প্রফুল্লচন্দ্র। স্কুলের পাঠে প্রায় দু’বছরের জন্য ইতি। ওই পর্বে ল্যাটিন ‘সামান্য কিছু’ শিখে ফেললেন। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পরে ভর্তি হলেন মূলত ব্রাহ্মদের দ্বারা পরিচালিত অ্যালবার্ট স্কুলে। এখানে যেন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ‘রেক্টর’ কেশবচন্দ্রের ভাই কৃষ্ণবিহারী সেনের ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোর প্রতি তৈরি হল বিশেষ মুগ্ধতা।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় শিক্ষকদের ‘আশানুরূপ’ ফল কিন্তু তাঁর হল না। এর পরে, বিদ্যাসাগরের কলেজ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হওয়া। সেখানে ইংরেজি সাহিত্য পাঠ শুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রসন্নকুমার লাহিড়ীর কাছে। চলল কালিদাসের কাব্য-পাঠও। কিন্তু এই পর্বেই প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘বাহিরের ছাত্র হিসেবে’ স্যর আলেকজ়ান্ডার পেডলারের প্রেরণায় রসায়নের প্রতি বিশেষ টান শুরু।
জীবনের মোড় ঘোরাও তখনই। পরিবারের আর্থিক অবস্থা পড়তির দিকে। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলেরা বিলেত যাক। সে জন্য এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে গোপনে ‘গিলক্রাইস্ট’ বৃত্তির জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। কিন্তু তা জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ‘কৃতী’ ছাত্রের বিদ্রুপ, ‘ওর (প্রফুল্লচন্দ্রের) নাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারের বিশেষ সংস্করণে বার হবে।’ প্রফুল্লচন্দ্রও আশা ছাড়লেন। কিন্তু একদিন কলেজে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর একটি সংবাদে দৃষ্টি পড়ল। গোটা দেশ থেকে সে বছর বৃত্তি পেয়েছেন বোম্বাইয়ের বাহাদুরজি আর বাংলার প্রফুল্লচন্দ্র!
বিলেতে স্বদেশিয়ানা
বৃত্তি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজে চড়ে লন্ডন গেলেন প্রফুল্লচন্দ্র। কিছু দিন থাকার পরে গেলেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গোল বাধল পোশাক নিয়ে। বিলিতি ওভারকোট, ‘টেইল-কোট’ তাঁর অপছন্দ। পছন্দ ছিল রাজা রামমোহন রায়ের চোগাচাপকান। তা-ই বানানো হল। কিন্তু দর্জির ভাষায় ‘সরু ও পাতলা’ হওয়ায় এ জিনিসও খুব একটা গায়ে আঁটল না।
এই পর্বে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর যৌবনে নারীর ভূমিকা নিয়ে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ লিখেছেন ‘আত্মচরিত’-এ। নারীর মাধুর্য ও সৌন্দর্যকে অনুভব করার ক্ষমতা থাকলেও কোনও তরুণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটলেই তিনি যেন গুটিয়ে যান। আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদি কয়েকটি কথা ছাড়া আর যেন রা সরে না তাঁর! বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনাতেই তাঁর তৃপ্তি!
আর তৃপ্তি রসায়ন গবেষণায়। কিন্তু এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। আচমকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টর স্ট্যাফোর্ড হেনরি নর্থকোট ঘোষণা করলেন, ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে ভারতের অবস্থা’ শীর্ষক বিষয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হবে। রসায়নের পাঠ কিছু দিনের জন্য তুলে রেখে ইংরেজি ও ফরাসিতে লেখা বিভিন্ন বইপত্র, অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রভৃতি পাঠ শুরু করলেন। ফলস্বরূপ, মোট সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করা প্রবন্ধ জমা দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। পুরস্কার না মিললেও এর মূল্যায়নে উইলিয়ম মুয়র ও অধ্যাপক ম্যাসন লিখলেন, ‘আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ, যেটিতে মোটো আছে।...ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এটি শ্লেষপূর্ণ আক্রমণে পূর্ণ।’ কিন্তু এই প্রবন্ধের জন্য প্রফুল্লচন্দ্র রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তবে ইতিহাসের পাঠ আপাতত মুলতুবি রেখে ১৮৮৭-তে রসায়নে মৌলিক গবেষণার জন্য ডিএসসি উপাধি পান তিনি।
তবে তার পরেও কিছু দিন বৃত্তির টাকায় বিলেতে থাকলেন বিজ্ঞানী। উদ্দেশ্য, ‘হাইল্যান্ড’ ভ্রমণ। লক ক্যাটরিনে সাঁতার কাটেন, রাত্রিবাস করেন লক লোমন্ডের তীরের হোটেলে। আর মনে মনে হয়তো আওড়ান ছেলেবেলায় পড়া উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘টু এ হাইল্যান্ড গার্ল’।
কিন্তু এ বার দেশে ফেরার পালা। দেশে ফিরে ভারতীয় শিক্ষা বিভাগে যোগ দেবেন, ইচ্ছে তেমনই। আলেকজ়ান্ডার ক্রাম ব্রাউন, উইলিয়ম মুয়রের সুপারিশ, চার্লস বার্নার্ডের চেষ্টা সত্ত্বেও তা সম্ভব হল না। শেষমেশ সেই সময়ে বিলেতে থাকা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি বাংলা শিক্ষা বিভাগে প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়োগের একটি সুপারিশপত্র পাঠালেন ডিরেক্টর আলফ্রেড ক্রফটের কাছে।
সেই চিঠির ভরসায়, কার্যত কপর্দকশূন্য অবস্থায় দেশে ফিরলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রথম কাজই হল, বিলিতি পোশাক ছেড়ে বন্ধুর কাছে ধুতি আর চাদর ধার নেওয়া!
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র
দেশে ফিরে কার্যত ১১ মাস কর্মহীন ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র! এই পর্বে বিশেষ ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন জগদীশচন্দ্র বসু ও বন্ধুরা। শেষমেশ ১৮৮৯-র মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সি কলেজে আড়াইশো টাকা বেতনের ‘সহকারী অধ্যাপক’-এর কাজ জুটল প্রফুল্লচন্দ্রের। তত দিনে তাঁর যোগ্যতার প্রতি সরকার অবিচার করেছে, ক্রফট সাহেবের কাছে সে কথা বলতে অপমানও হজম করতে হল তাঁকে। ক্রফট উদ্ধত ভাবে তাঁকে বললেন, ‘আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেউ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করছে না!’ পাশাপাশি, বাংলার শাসনকর্তা চার্লস ইলিয়ট ‘ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে’ ভারতীয়দের নিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দিলেন।
তবে প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারটি হয়ে উঠল প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মার সঙ্গী। ভারতীয় নানা খাদ্যদ্রব্য ও তার ভেজাল নিয়ে এই পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণটি করলেন তিনি।
পাশাপাশি, তাঁর অধ্যাপক-সত্তাও ক্রমে বিকশিত হতে শুরু করল। ১৯০৯ সাল ভারতের রসায়ন তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, রসিকলাল দত্ত-সহ একঝাঁক কৃতী ছাত্র পেল প্রেসিডেন্সি। ছাত্রেরা পেলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পরবর্তী সময়ে তৈরি হবে ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি’।
এই ছাত্রদের দিকে তাকিয়েই প্রেসিডেন্সি থেকে অবসর গ্রহণের সময়ে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর বক্তব্যে কর্নেলিয়ার গল্প শোনালেন। গল্পটা এমন— এক ধনী গৃহিণী নিজের নানা দামি অলঙ্কার দেখিয়ে কর্নেলিয়ার কাছে তাঁর রত্ন-অলঙ্কার দেখানোর অনুরোধ করলেন। কর্নেলিয়া বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন’। কিছুক্ষণ পরে তাঁর দুই সন্তান স্কুল থেকে ফিরলে, তাদের উদ্দেশ্য করে কর্নেলিয়া বললেন, ‘এরাই আমার অলঙ্কার।’ প্রফুল্লচন্দ্রও তাঁর ওই কৃতী ছাত্রদের কথা বলে বিদায়-ভাষণে বললেন, ‘এরাই আমার রত্ন’। এই রত্নদের টানেই হয়তো জানালেন তাঁর শেষ ইচ্ছের কথাও। ‘আমার বড় সাধ, মৃত্যুর পরে আমার এক মুঠো চিতাভস্ম যেন এই কলেজের পবিত্রভূমির কোথাও রক্ষিত থাকে।’
আসলে ছাত্র-রত্নদের চিনতে পারাটাই মাস্টারমশাইয়ের আসল কৃতিত্ব। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কথা বলতে হয়। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি। কিন্তু ‘ব্যবহারিক রসায়ন’-এ তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষাগারে কিছু দিন কাজ করেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে নিজের গবেষণা কাজে সহায়তার জন্যও ডেকে নিলেন। কালক্রমে, জিতেন্দ্রনাথ সরকারি আফিম বিভাগে বিশ্লেষকের চাকরি পান।
প্রেসিডেন্সির পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ১৯১৬-এ সায়েন্স কলেজে যোগ দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের দানে তৈরি এই কলেজ। কিন্তু সরকার এই কলেজ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। দ্বিধাহীন ভাবে বিলেতের মাটিতে দাঁড়িয়েই প্রফুল্লচন্দ্র বললেন, তাঁরা কলেজের জন্য অনুদান চাইলেই সরকার বলে ‘অর্থাভাব’। উল্টো দিকে, দেশের ধনী ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে মুখ ফিরিয়ে থাকারও সমালোচনা করলেন।
অথচ নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দশ হাজার টাকা দান, মাদ্রাজ, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাপ্য অর্থ সেখানেই দিয়ে আসা, কলকাতার সিটি কলেজ, এমনকি গ্রামে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির পাশে দাঁড়ানো— এমন নানা কাজ আজীবন করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র।
আসলে শিক্ষার জগতে প্রফুল্লচন্দ্র একটি ‘লেগাসি’। বিষয়টি তাঁর ছাত্র নয়, বরং তাঁর ‘ছাত্রের ছাত্র’র মুখে শোনা যাক। এই ছাত্রটি বলছেন, ‘আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছি যে, স্যর পিসি রায়ের ছাত্র হতে পারিনি। সে জন্য হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করেননি।...আমি তাঁর রাসায়নিক ‘প্রশিষ্য’ হয়েছি। পিসি রায়ের ছাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে আমি রসায়ন শিখেছি।’ বক্তব্যটি, ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার যাঁর নামে, সেই শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের!
স্বদেশব্রত
কলেজকে ক্লাসের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখতে চান না প্রফুল্লচন্দ্র। ১৯২১-এ খুলনায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা গেল। কিন্তু সরকার তা মানতে নারাজ। এমনকি, সরকারি প্রতিনিধি রূপে বর্ধমানের মহারাজা খুলনা পরিদর্শন করে এসে বললেন, ‘দুর্ভিক্ষের চিহ্ন নেই।’ স্থির থাকলেন না প্রফুল্লচন্দ্র। দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সংগ্রহ করলেন কয়েক লক্ষ টাকা।
১৯২২-এ বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিপুল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হল জনজীবন। সরকারি হিসেবেই প্রায় ১,৮০০ বর্গ মাইল এলাকা প্লাবিত। ১২ হাজার গবাদি পশু নিখোঁজ। শস্য নষ্ট, প্রায় ৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২১ নভেম্বর, ১৯২২-এর আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়, আমনদিঘি, নসরতপুরের গ্রামবাসী রেললাইনের কালভার্টের পরিবর্তে সেতুর দাবি জানিয়েছিলেন। তা মঞ্জুর করেনি রেলওয়ে। ঘটনাচক্রে, প্রফুল্লচন্দ্রও বন্যার জন্য এটিকেই কারণ বললেন।
শুধু কারণ চিহ্নিত করা নয়, ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’র ছাতার তলায় শুরু করলেন কাজ। সায়েন্স কলেজই হল তাঁর হেড কোয়ার্টার। কমিটির আর একজন সেনানি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রফুল্লচন্দ্রের আহ্বানে অন্তত ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রাথমিক কাজ শুরু করলেন। তাঁর আহ্বানে বোম্বাই, মাদ্রাজ-সহ দেশের নানা প্রান্ত, এমনকি জাপান থেকেও সাহায্য এল। সঙ্গে-সঙ্গে দেশবাসী ত্রাণের জন্য সায়েন্স কলেজে পাঠাতে থাকলেন রাশি-রাশি জামাকাপড়।
এই সময়পর্বেই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ‘চরকা-মন্ত্র’র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন আচার্য। প্রথম দিকে, বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ইতিবাচক ধারণা ছিল না তাঁর। কিন্তু পরে নিজেই হিসেব করে দেখলেন, বাংলাদেশের সাড়ে চার কোটি লোকের দেড় কোটি মানুষও যদি চরকা কাটেন, তবে মাসে এঁদের সামগ্রিক আয় হবে দেড় কোটি টাকা!
গাঁধীর সঙ্গে সখ্য আসলে বেশ কিছু দিন আগেই তৈরি হয়েছিল প্রফুল্লচন্দ্রের। তাঁরই উদ্যোগে অ্যালবার্ট হলে গাঁধীর জন্য এক সভা আয়োজিত হয়। সভার উদ্দেশ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত গাঁধীর কাছ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতীয়দের অবস্থা কলকাতাবাসীর কাছে তুলে ধরা। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনে আচার্যকে পুরোপুরি গাঁধীবাদী বলা যায় কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তাঁকে হিন্দু মহাসভায় বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। আবার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারত-সভ্যতায় ইসলামের অবদানও তুলে ধরেন তিনি। আসলে গাঁধী-দর্শনের সারল্যের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করেন প্রফুল্লচন্দ্র। সে অনুভব তাঁর স্বদেশচিন্তার ফসল। এই একই কারণে তাঁর সঙ্গে সখ্য গোপালকৃষ্ণ গোখলেরও।
এই স্বদেশ-ভাবনা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রের বিখ্যাত বই ‘এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ ও ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে আচার্যের ভাড়াবাড়িটিই এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আঁতুড়ঘর। এর নেপথ্যে ছিল বিদেশ থেকে নানা দ্রব্যের আমদানিতে লাগাম পরানো এবং বাঙালি তথা ভারতীয়কে কেরানি থেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ইচ্ছে।
তবে এর জন্য সবার আগে দরকার বিজ্ঞান-মানসটি তৈরি করা। প্রেসিডেন্সির রসায়নের ক্লাসে ছাত্রদের সামনে বার্নারে পোড়ানো হাড়ের গুঁড়ো রাখলেন প্রফুল্লচন্দ্র। তা মুখেও দিয়ে বোঝালেন, এই হাড়ভস্ম যে প্রাণীরই হোক, এটি একজন রসায়নবিদের কাছে ‘বিশুদ্ধ মিশ্রপদার্থ’, ক্যালসিয়াম ফসফেট।
এ ভাবে এক দিকে, বিজ্ঞান চেতনা তৈরি, অন্য দিকে কসাই মহল্লায় গিয়ে হাড় সংগ্রহের মতো নানা কাজ করতে করতেই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি শুরু করে দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতের পাশাপাশি, প্রফুল্লচন্দ্র বিশেষ জোর দিলেন বিপণনেও। কালক্রমে নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ডালপালা ছড়িয়ে দেশের বাজারে সমাদৃত তো হলই, সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজ সরকারকেও সহযোগিতা করল। এর কৃতজ্ঞতায় ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেয়। যদিও, এ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায়নি। কারণ, পরক্ষণেই দেখা গিয়েছে তিনি রাওলাট আইনের বিরোধিতায় সরব।
পাশাপাশি, রসায়ন-শাস্ত্রের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে করতেই এক দিন হাতে এল ফরাসি রসায়নবিদ মার্সিলিন বের্তেলোর একটি বই। তাঁর সঙ্গে পত্রালাপও শুরু হল। কালক্রমে, বের্তেলো তাঁর লেখা সিরিয়া, আরব প্রভৃতি দেশের রসায়ন সম্পর্কিত তিন খণ্ডের বইটিও পাঠালেন। এটি পড়েই প্রফুল্লচন্দ্রের পরিকল্পনা হিন্দু রসায়নের ইতিহাস লেখার। ভারতবর্ষের নানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার, লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস, বারাণসী-সহ নানা প্রান্ত থেকে সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ ও পাঠ করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। সাহায্য করলেন পণ্ডিত নবকান্ত কবিভূষণ। এরই ফল, দু’খণ্ডে ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’।
প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞান ভাবনা যা-ই হোক না কেন, তাঁর সব কিছু জুড়ে ছিল দেশ আর দেশের প্রকৃতি। তাই ১৮৯০-এ তৈরি করেন ‘নেচার ক্লাব’। নীলরতন সরকার, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, রামব্রহ্ম সান্যাল, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, বিপিনবিহারী সরকার ছিলেন এর সদস্য। পাশাপাশি, ‘কলকাতার ফুসফুস’ ময়দানে ঘুরতে যাওয়া, তা-ও করেছেন সমান ভাবে।
পরিবেশের সূত্রেই প্রাণী ও উদ্ভিদ-বিজ্ঞানেও প্রফুল্লচন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ। সেই আকর্ষণেই কখনও দেওঘরে গিয়ে ‘অনিষ্টকর’ ভেলার ফল খেয়ে বিপত্তিও বাধান। আবার কখনও গ্রীষ্মে গ্রাম রাড়ুলিতে গিয়ে গোখরো সাপ ধরিয়ে তার বিষদাঁতের পরীক্ষা করেন! কখনও বা শহর কলকাতায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা ভামের দেহ এনে তার ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন।
জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, মেঘনাদ সাহা ও অন্যান্যদের সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্র (মাঝখানে)
আসলে প্রকৃতির উপরে মানুষের কেরদানিটা সহ্য হয়নি প্রফুল্লচন্দ্রের। তাই রবীন্দ্র সরোবরে ছট করতে চাওয়া, জলাভূমি বুজিয়ে ইমারত তৈরি করার বর্তমান দেশে প্রফুল্লচন্দ্রের একটা কথা বিশেষ ভাবে মনে করা যায়— ‘‘পশ্চিমবঙ্গে পুকুর বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লীধ্বংসের কাহিনী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।’’ এই জন-বিজ্ঞানকে বোঝাতে বাংলা ভাষায় সাধারণের উপযোগী বইও লিখেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। আদতে তিনি চেয়েছিলেন স্থিতিশীল উন্নয়ন।
শেষ কথাটি
১৯৪৪, ১৬ জুন। প্রয়াত হন অকৃতদার এই মনীষী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পরে, এমনকি তাঁর জীবিত অবস্থাতেও বাঙালি, ভারতীয়রা কতটা রক্ষা করতে পেরেছে প্রফুল্ল-ঐতিহ্য? জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয় মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে। কিন্তু এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন। আর প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে সমসময়ে তাঁর সাধের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে!
তথ্যঋণ: ‘আত্মচরিত’ (দে’জ): প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র’ (চর্চাপদ): রবীন মজুমদার, ‘অন্বেষা’ (প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশেষ সংখ্যা), ‘প্রফুল্লচন্দ্র রে’ (এনবিটি): জে সেনগুপ্ত, ‘জার্নাল অব দি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’ প্রভৃতি।