কারও শেষ ইচ্ছের কথা জানা যায়, তাঁর মৃত্যুর ১৭৮ বছর পরে, সাগরজলে ভেসে আসা কাগজের টুকরোয়!
কেউ মৃত্যু-মুহূর্তে চেয়েছিলেন বন্ধুর ফোটোগ্রাফ। কেউ’বা চিৎকার করে ডাক পেড়েছেন প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিককে।
কারও জীবনের অন্তিম শব্দটিও বুঝিয়ে দেয় মানুষটি ছিলেন জন্মরসিক। কেউ’বা ‘প্রাণভয়ে’ ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিতে বলেন। কেউ নিশ্চুপে ডুকরে গিয়েছেন।
এঁদের কারও নাম পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তো কেউ বঙ্কিমচন্দ্র। কারও নাম চে গেভারা, তো কেউ উইন্সটন চার্চিল!
জীবনতরী ডুবছে
সময়টা আশ্বিনের মাঝামাঝি।
দার্জিলিং-এ বেড়াতে গিয়েছেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা, আর ভগিনী নিবেদিতা, ওঁদের পারিবারিক বন্ধু।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ভগিনী। বিজ্ঞানী ও তাঁর স্ত্রী দিনরাত এক করে যাবতীয় সেবাযত্ন করে চললেন তাঁদের ভারত-অন্তপ্রাণ বান্ধবীটির। কিন্তু অদৃষ্টের কী পরিহাস!
কাকভোর। মেঘে ঢাকা আকাশ। শেষ ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘‘আমার জীবনতরী ডুবছে, কিন্তু সূর্যের উদয় দেখবই।’’
আশ্চর্য! মেঘ কেটে যখন নতুন রোদের ছ’টায় ঝিকিয়ে উঠল আশপাশ, তখন তৃপ্ত প্রশান্ত মুখে চলে গেলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। তিনি তখন মাত্র ৪৩।
আর একজন বিখ্যাত মানুষের জীবনের শেষতম উচ্চারণের সঙ্গেও ‘সূর্য’ জড়িয়ে আছে। তবে তাতে সূর্য না-ওঠার পূর্বঘোষণা। ফরাসি এই পণ্ডিত মানুষটির নাম মিখায়েল নস্ত্রাদামুস। যাঁর মূল খ্যাতি ছড়িয়েছিল পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহাদেশেরই সহস্র বছরের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনার আগাম ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত ১০ খণ্ডের ‘লে প্রফেতিস’ তথা ‘দ্য প্রফেসিস’ গ্রন্থের জন্য। গাউট এবং ইডিমা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ বছর বয়সে দেহাবসানের ঠিক আগের দিন, তিনি ওঁর ব্যক্তিগত সচিব জঁ দ্যু শাভিগনি-কে ডেকে বলেন, ‘‘কাল সকালের সূর্য উঠবে যখন, আমাকে আর পাবে না।’’
ওঁর এই শেষ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। ১৫৬৬-র ২ জুলাই ওঁকে নিথর অবস্থায় ভূমিশয্যায় পাওয়া যায়। সূর্য উঠতে তখনও বেশ কিছুক্ষণ বাকি।
অন্তিম উচ্চারণ
মরে গিয়েই জানতে হয়
আড়াই হাজার বছর খুব কম কথা নয়। কিন্তু কমবেশি ঠিক ততটাই পিছিয়ে যেতে হবে এক মহামানবের মহাপ্রয়াণকালে পৌঁছতে হলে।
তথাগত তখন ইহলীলা সংবরণের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স আশি বছর। বহু জায়গা ঘুরে, বিল্বগ্রাম হয়ে বৈশালী ছেড়ে কুশীনগরে এলেন। অসহ্য দেহযন্ত্রণা শুরু হল। অথচ মুখে সেই চিরপ্রসন্ন হাসিটি। অতি কষ্টে হিরণ্যবতী নদী পার হয়ে সঙ্গী শিষ্য আনন্দকে একটি শালবৃক্ষতলে তাঁর শেষ শয্যা প্রস্তুত করতে বললেন।
এও মনে করিয়ে দিলেন, আশি বছর আগের এক বৈশাখী পূর্ণিমায় লুম্বিনী উদ্যানের এক শালবৃক্ষের নীচে তিনি যেমন পৃথিবীতে এসেছিলেন—ঠিক তেমন আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনেই এই বৃক্ষতল থেকেই পৃথিবী ছেড়ে যাবেন।
খবর পেয়ে অসংখ্য ভিক্ষু তাঁর চার পাশে এসে জড়ো হলেন। তাঁদের দিকে চেয়ে পূর্ণ আত্মজয়ী মানুষটি তাঁর জীবনের শেষতম বাণীটি উচ্চারণ করলেন: ‘‘বয়ধম্ম সংখার অপ্পমাদেন সম্পদেথ।’’ যার কাছাকাছি বাংলা তর্জমা দাঁড়াবে, ‘‘পঞ্চভূতে গড়া সবই নশ্বর। তাই আত্মমুক্তির জন্যই সচেষ্ট থেকো।’’
কথা ফুরোনোর নিমেষ-মধ্যেই দুর্লভ একমুখ তৃপ্তির হাসি নিয়ে চলে গেলেন সংসারত্যাগী রাজপুত্রটি!
প্রায় ছ’-দশক জুড়ে ৫০-টিরও বেশি মাস্টারপিস চলচ্চিত্র নির্মাণের চিহ্ন ফেলে রেখে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক যখন তাঁর আমেরিকার বাড়ির রোগশয্যায় শুয়ে—২৯ এপ্রিল ১৯৮০ তারিখে শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে অসহায় ভাবে বলে উঠেছিলেন, ‘‘শেষটা সবারই এত অজানা! তাই মরে গিয়েই জানতে হয়, মৃত্যুর পর কী ঘটে।’’
আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও
মৃত্যু মানে যে ভয়-ধরানো অন্ধকার, সে কথাই শোনা যায় কালজয়ী আমেরিকান ছোট গল্পকার ‘ও হেনরি’ তথা উইলিয়াম সিডনি পোর্টারের গলায়।
মাত্র ৪৮ বছর বয়সে দেহাবসানের ঠিক আগের মুহূর্তে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দিকে ফিরে উনি চেঁচিয়ে ওঠেন—‘‘চার্লি! আলোগুলো সব জ্বেলে দাও! অন্ধকারে ঘরে ফিরতে খুব ভয় করবে আমার!’’
অবশ্য চরম মুহূর্তে পৌঁছে সকলেই যে ভয়-ভাবনার কথা আউড়েছেন, তা নয়। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মুখে তাঁর বিদায়কালে যেমন একেবারেই বাস্তব-সম্পর্কহীন একটি অদ্ভুত কথা শোনা গিয়েছিল।
১৮৯৪-এর মার্চের মাঝামাঝি। কলকাতার বাড়িতে শয্যাশায়ী বঙ্কিম। আরও বাড়াবাড়ি হওয়ায় ৫ এপ্রিল থেকে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।
শেষে ৭ তারিখে জ্ঞান ফিরলে ওঁর এক অনুজপ্রতিম প্রিয়জন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত আসেন ওঁকে দেখতে।
এর পর শোনা যাক রমেশচন্দ্রেরই ভাষ্যে, ‘‘বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পূর্বদিন আমি তাঁহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। তিনি তখন প্রায় অজ্ঞান, কিন্তু আমার গলার শব্দ বুঝিতে পারিলেন। আমার দিকে চাহিয়া সস্নেহে আমার সহিত কথা কহিলেন, আমার একখানি ফটোগ্রাফ চাহিলেন। সে সময় কেন আমার ফটোগ্রাফ চাহিলেন, জানি না।’’ বিশিষ্ট বঙ্কিম-গবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য-র মতে, কোনও প্রিয়জনের সঙ্গে সেই ছিল সম্ভবত সর্বশেষ বঙ্কিম-আলাপ। পরদিন ৮ এপ্রিল শেষদুপুরে চিরবিদায় নেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের ‘চার্লস ডিকেন্স’!
শেষ মুহূর্তে মানুষের প্রিয় বস্তু বা প্রিয়জন-প্রত্যাশার এমন নানা উদাহরণ আছে।
১৯৪৫-এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার ক্ষণকাল আগে আমেরিকার এক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক থিওডর ড্রেজার শেষ বারের মতো চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘‘শেক্সপিয়র! আমি আসছি!’’
ওঁর থেকে কম করেও ৩৩০ বছর আগে লোকান্তরিত ওই প্রবাদোপম নাট্যকারের নামটি জীবনের অন্তপথে এসে কেন তিনি অমন পাগলের মতো উচ্চারণ করলেন?
হয়তো স্রেফ পরলোকে বিশ্বাস থেকেই এমন ধারণা তাঁর জন্মানো সম্ভব যে, ঊর্ধ্বলোকে পৌঁছলে প্রিয় নাট্যকারের সান্নিধ্যলাভ ঘটবেই!
নানা রসিকতা দিয়েও বাক্যন্ত্রের কাজ-কারবার গুটিয়েছেন অনেকে। ১৯৫৬-য় শেষ শয্যায় শোওয়া প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ওয়াল্টার ডি লা মারে যেমন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কী পেলে তাঁর একটু ভাল লাগবে—মারে মৃদু হেসে বলেন, ‘‘ফল দিতে চাইলে বলব, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর ফুল দিতে চাইলে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।’’
মৃত্যুকালেও অটুট দম্ভ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের গলায়।
৯০ পার করা বয়সে ১৯৬৫-র ২৪ জানুয়ারি সকালে তিনি যখন দুনিয়ার গণ্ডি পার করছেন—তখন সেরিব্রাল স্ট্রোকের ধাক্কায় ৯ দিন শয্যাশায়ী থাকা অবস্থাতেও ওঁর শুভানুধ্যায়ীদের হঠাৎই বলে ওঠেন, ‘‘ভগবান লোকটার সামনে বসতে তৈরি আমি। তবে জানি না, আমার সামনে বসার সাহস উনি এখনও জুটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না!’’
যতক্ষণ না অঙ্ক শেষ হচ্ছে
যাওয়ার বেলা ঘনিয়ে এলে কেউ রাগেন, কেউ হাসেন, কেউ বা অস্থির হয়েও ওঠেন। কিন্তু যদি একটি মানুষকে মানুষেরই দেওয়া মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কোনও শেষ কথা বলে যেতে হয়?
কী হতে পারে সেই অন্তিম ভাষণ?
১২০০ বছর আগের কোনও এক সকালে এক রোমান সৈন্যর হাতে দু’দিকেই ধার দেওয়া চওড়া তরবারি। অথচ তার সামনেই কারাগারের মেঝেতে বসে তখনও এক বৃদ্ধ দুর্বোধ্য কী সব অঙ্ক কষে চলেছেন একমনে!
মানুষটি পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আর্কিমিডিস। সৈন্যটির মুখে বধ্যভূমিতে যাওয়ার আদেশ শুনেও মুখ না তুলেই বললেন— ‘‘না! যতক্ষণ এই অঙ্ক শেষ না হচ্ছে, যেতে পারব না আমি!’’
পরমুহূর্তেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মাথাটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল তাঁর অশক্ত দেহ থেকে—মানুষের চিরকালীন মুর্খতার প্রমাণ হিসাবে।
তবে জ্ঞানীর সহজাত পাগলামো ছাড়াও যে প্রাণদণ্ডকে একই ভাবে উপেক্ষা করা যায়, তা অবশ্য দেখিয়ে গেছেন আর্জেন্তিনীয় বংশোদ্ভূত কিউবার মহাবিপ্লবী চে গেভারা।
১৯৬৫-তে কিউবার বহু বছরের সামরিক সরকারের পতন ঘটিয়ে—ফের বছর দুয়েকের মধ্যেই চে বেরিয়ে পড়েন বলিভিয়ার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা-যুদ্ধ চালাতে। ১৯৬৭-র ৮ অক্টোবর ১৮০০ বলিভিয়ান সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে আহত অবস্থায় তিনি ধরা পড়ে যান।
পরদিন ৯ অক্টোবর বিকেলে লা হিগুয়েরা গ্রামের এক ভাঙাচোরা গ্রাম্য স্কুলঘরে বন্দি অবস্থায় ওঁকে হত্যা করা হয়। মোট ৯টি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চে যখন পৃথিবী ছেড়ে যান—তার ঠিক আগের মুহূর্তটিতেই মৃত্যু আসন্ন জেনেও তিনি তাঁর ঘাতক মারিও টেরান নামের ৩১ বছর বয়সি বলিভিয়ান সৈন্যটিকে তীব্র শ্লেষের গলায় বলে উঠেছিলেন— ‘‘জানি, মারতে এসেছ আমায়! কাপুরুষ কোথাকার! মারো! কিন্তু মনে রেখো, স্রেফ একজন মানুষকেই মারছ!’’
স্ত্রীকে পূর্ণ সম্পত্তি দেওয়ার শর্ত
জীবনে শেষ দাঁড়ি নামার আগে অক্ষম আঁকাবাঁকা রেখায় মনের কথা লিখেও যান কেউ কেউ।
গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলকেই এ ক্ষেত্রে অন্তিমেচ্ছা লিখনের পথিকৃৎ ভাবা হয়। কেননা খ্রিস্টজন্মের ৩২২ বছর আগেই ৬২ বছর বয়সি এই মানুষটি মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়েও লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র।
যাতে তিনি তাঁর সমস্ত ক্রীতদাসকেই মুক্তি দিয়ে যান এবং জানিয়ে দেন, কী ভাবে কোথায় তাঁকে সমাহিত করতে হবে।
এই ইচ্ছাপত্র নিয়ে এক করুণ-মধুর কাহিনি রয়েছে আমেরিকায়।
আঠেরো শতকে মুষ্টিমেয় যে ক’জন মানুষের সাহস ও দৃঢ়তায় ভর দিয়ে ইংল্যান্ডের শাসন হটানো এবং আলাদা আলাদা কয়েকটি রাজ্যের বদলে মিলিত ভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়, গুভেরনিয়ার মরিস ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এমনকী আমেরিকার সংবিধানের মূল রচয়িতাও তিনিই।
তা, ১৮১৬-য় ৮৪ বছর বয়সে মরিস যখন মারা যান, তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে লেখা ছিল—‘‘আমার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকাংশ পাবেন আমার ৬২ বছর বয়সি স্ত্রী অ্যানি। অবশ্য একটি শর্তেই তিনি পূর্ণ সম্পত্তি পেতে পারেন। যদি তিনি আবার কাউকে বিয়ে করেন।’’
আসলে প্রচলিত কর্তব্যের সীমা-ডিঙোনো অমন এক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন শুধুই প্রিয়তমা স্ত্রীর একাকীত্ব দূর করতে চেয়ে।
যদিও ঘটনাক্রমে তাঁর ওই অন্তিমেচ্ছা পূর্ণ হয়নি। কেননা তাঁর কঠিনহৃদয় উকিল প্যাট্রিক হেনরি তৎকালীন আইনি ক্ষমতাবলে মরিসের সম্পত্তি হস্তান্তরের শর্তটিকে ‘সামান্য’ বদলে দেন এই মর্মে যে—একমাত্র পুনর্বিবাহ না-করলেই অ্যানি সমস্ত সম্পত্তি লাভ করবেন। নয়তো কানাকড়িও জুটবে না তাঁর বরাতে।
অন্য দিকে মৃত্যুর আলিঙ্গনকালে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার উজ্জ্বলতম উদাহরণ যদিও বিখ্যাত ফরাসি জীবাণুবিজ্ঞানী লুই পাস্তুর-এর কলমেই ধরা আছে।
যাতে সুভদ্র ও পরম অনুরাগী পাস্তুর লিখেছিলেন—‘‘...দেশের আইন অর্ধাঙ্গিনীকে যা-যা দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়, তার সবটুকুই দিয়ে গেলাম আমার প্রিয় স্ত্রী মেরি লরেঁত-কে। কেননা, আমার সন্তানেরা যেন তাদের মায়ের প্রতি কর্তব্যে অবহেলার কোনও সুযোগ না পায় কখনও। বরং তারা যেন আজীবন ওঁকে কোমল মমত্ব দিয়ে ঘিরে রাখে—যা ওঁর একান্ত পাওনা।’’
অনুরাগের একেবারেই বিপরীত অবস্থান যদিও বিরাগ ও বীতরাগের। শেষ ইচ্ছাপত্রে তার নিদর্শনও বড় কম নয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির এক ধনী জমিদার ফ্রান্সিস তাঁর স্ত্রীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন মাত্র ১ শিলিং! ভারতীয় টাকায় এখনকার বিনিময়-মূল্যে যা ৪ টাকারও কম। তার থেকেও বড় কথা, শেষ ইচ্ছাপত্রে এই আণুবীক্ষণিক অর্থ দানের কারণও উল্লেখ করে গিয়েছেন তিনি এক ঘৃণিত ভাষ্যে, ‘‘ট্রামভাড়া বাবদ এটি দিলাম, যাতে এই রাহাখরচ দিয়ে কোথাও গিয়ে ও ডুবে মরতে পারে!’’
আদালত কোনও ভাবেই মান্যতা দিতে পারেনি এমন ইচ্ছাপত্রেরও নজির আছে।
১৯৩৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্রতীরে একটি মুখবন্ধ বোতল ভেসে এসেছিল। যা খুলে জানা যায়, জাহাজডুবির পর ঢেউয়ের মাথায় চেপে অজানা কোনও খাদ্য-পানীয়হীন দ্বীপে পৌঁছনো এক নাবিক ফিলিপ সেগ্রানডেজ মৃত্যু আসন্ন জেনেই গাছের ছালের ওপর নিজের রক্ত দিয়ে এক শেষ ইচ্ছাপত্র লিখে, ওই বোতলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই ইচ্ছাপত্রে সেগ্রানডেজ স্পেনের লিসবন শহরের প্রান্তে থাকা ওঁর একমাত্র বসতবাড়িটিকে কয়েক জন নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, স্পেনীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বোতলটি নিয়মমাফিক পৌঁছে দেওয়া হলেও তাঁরা কিছু করতে পারেননি।
কেননা ইচ্ছাপত্রটি ছিল ১৭৮ বছর আগের!
মহাসমাধির আগে
‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকার ৩১ অগস্ট ১৮৮৬ সংখ্যার ঘোষণা অনুসারে: মহাসমাধি লাভের মুহূর্তটিতে পরমহংস তিন বার ‘কালী’ নাম উচ্চারণ করেছিলেন। একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় ঠাকুরের স্নেহধন্য কবি অক্ষয়কুমার সেনের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’ গ্রন্থেও: ‘আজি পূর্ণকণ্ঠে নাহি বিয়াধি যেমন/তিনবার কালী কালী কৈলা উচ্চারণ।’ যদিও স্বামী বিবেকানন্দের মতে (বাণী ও রচনা, ৮/ পৃ: ৩৯০) তিনি ‘ওঁ’ উচ্চারণ করতে করতেই মহাসমাধিস্থ হয়েছিলেন।
ভগবানকে দিয়ে গেছেন সব সম্পত্তি
অন্তিম লিপি যে শুধু পুরুষেরাই লিখে গেছেন, তা নয়। বরং নারীরাও যথেষ্টই লিখেছেন। এবং যথোপযুক্ত রসেবশেই লিখেছেন। তার মধ্যে দু’টিকে দেখা যাক।
ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল ঘেঁষা বোর্নমাউথ শহরের এক সুরসিকা মহিলা ব্রিজেট ফিলিসন ১৯৩৮-এ শেষযাত্রায় ভেসে যাওয়ার আগের দিন এক বিচিত্র ইচ্ছাপত্র লিখে যান।
তাতে তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তিকে দু’ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে যান স্বামীকে, আর এক ভাগ দেন নিজের বোনকে। তবে সবটাই একটি শর্তাধীনে। তা হল, স্বামীর অংশের অধিকারপত্রটি তিনি সরাসরি পাবেন না। পাবেন ব্রিজেটের বোনের মারফত। এবং তাও কীভাবে?
ইচ্ছাপত্রে ব্রিজেট বোনকে তারও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—‘‘আমাদের বাড়ির কাছেই যে ‘পাব’-টা রয়েছে, সেখানে গিয়েই ওর হাতে কাগজগুলো সব তুলে দেবে। আমার দুঃখ ভুলতে ও যে ঠিক ওখানে বসেই মদ খাবে, তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে!’’
তবে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে হাসির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা প্রদেশের চেরোকি কাউন্টির এক বিপুল ধনী মহিলার শেষ ইচ্ছাপত্রকে আইনি মান্যতা দেওয়ার সময়। আসলে একটু খ্যাপাটে ধরনের নিঃসঙ্গ ওই মহিলার মৃত্যুর পর ওঁর লেখা যে-ইচ্ছাপত্রটি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়—ওঁর সমস্ত সম্পত্তিই উনি ‘ভগবানকে’ দিয়ে গিয়েছেন!
ফলে, তাঁর উইলটি যখন নর্থ ক্যারোলিনার আদালতে পৌঁছয়, মহামান্য বিচারপতি এই সমস্যার কোনও কূলকিনারা করতে না পেরে শেষে চেরোকি কাউন্টির শেরিফকে ডেকে ওই সম্পত্তি-প্রাপককে ‘সমন দেওয়ার’ হুকুম দেন।
যথারীতি দিন সাতেক বাদে শেরিফ ভদ্রলোক সে বিষয়ে একটি রিপোর্টও জমা দেন আদালতে।
তা এই যে—‘‘দায়িত্ব সহকারে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালিয়েও গোটা চেরোকি কাউন্টির কোথাও ভগবানকে পাওয়া যায়নি।’’
নিষ্পলক চোখে জল শুধু
যত মন, তত বেশি পৃথক মনন। শেষ কথার ভাণ্ডারও ততই বিচিত্র।
এলভিস প্রেসলির ‘বই পড়তে যাচ্ছি’, ফ্র্যাংক সিনাত্রার ‘সব হারিয়ে ফেলছি’, নবোকভের ‘বড় অদ্ভুত আর আলাদা রকমের একটা প্রজাপতি উড়ছে’ কিংবা থমাস এডিসনের ‘কী অপূর্ব সুন্দর ওই দিকটা’র পাশেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘একটিও সার্থক কাজ করে যেতে পারলাম না মানুষের জন্য’ অথবা কার্ল মার্ক্সের ‘শুধু বোকারাই শেষ কথা বলে যেতে চায়’ শুনলে মনে হয়, কী সীমাহীন পার্থক্য একেক জনের চিন্তার বা দর্শনের!
যাঁরা বিদায়কালে কথা বলতে বা লিখে জানাতেও পারেন না তাঁদের দলটিও কম ওজনদার নয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন। শেষ মুহূর্তে যে-দেওয়ালে ওঁর মায়ের ছবি টাঙানো, হঠাৎ সেই দিকে ঘুরে গিয়ে নিষ্পলক চোখে ছবিটির দিকেই চেয়ে ছিলেন।
এর পর আমৃত্যু ওঁর চোখ থেকে অবিরল অশ্রু বয়ে গেছে।
ঋণ: ‘আমাদের নিবেদিতা’ (শঙ্করীপ্রসাদ বসু), ‘Stranger Than Science’ (Frank Edwards), ‘ভগবান বুদ্ধ’ (বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী), ‘বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী’ (অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য), ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ (ইন্দ্রমিত্র), ‘Mohammed Rafi: Golden Voice of the Silver Screen’ (Sujata Dev) ও তথাগতর অন্তিম ভাষ্যের উচ্চারণ-সহায়তা: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ (স্বামী প্রভানন্দ), ‘শ্রীমা সারদা দেবী’ (স্বামী গম্ভীরানন্দ), ‘পরম পিতা শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ’ (অঞ্জনকুমার রায়), ‘ভারতের সাধক’ (শঙ্করনাথ রায়)