মেয়ের লেখার খাতা গুছোতে গিয়েই আবার মাথায় হাত রূপকথার। খাতার পিছনের প্রায় ১০-১২ পাতা জুড়ে রঙিন আঁকিবুকি। হাজারো নিষেধ সত্ত্বেও মেঘলা স্কুলের খাতার পিছনেই মনের সুখে এঁকেছে, রং করেছে।
আবার রোদ্দুরের মায়ের সমস্যাটা অন্য। তাঁর ছেলে স্কুলের খাতায় নোট নেওয়ার পাতাতেই মার্জিন বরাবর কত কী যে আঁকে! ছেলের পড়াশোনায় মন নেই মোটেও— এই ভেবে চলে রোজ বকাবকির পালা।
একতা আবার বরাবরই জানত যে, বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা থাকলে ঘরদোর তো নোংরা হবেই। কিন্তু তা বলে ফ্ল্যাটের সমস্ত দেওয়াল জুড়ে অভিষেক-অভীপ্সার আঁকা! ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য তো মাসে অন্তত চার বার রং পেনসিল, বই কিনতে হয়!
বাচ্চাদের আঁকা, রং করার প্রবণতা একটু বেশিই থাকে। ছোট বাচ্চাকে বড় করে তুলতে গিয়ে তাই এ ধরনের নানা ‘সমস্যা’র মুখে হয়তো পড়েন মা-বাবারা। কিন্তু বিষয়টাকে ‘সমস্যা’ বলে গণ্য করার আগে বরং প্রয়োজন তা নিয়ে খুঁটিয়ে জানার।
প্রথমত, বাচ্চাদের খামখেয়ালি আঁকিবুকি মানেই সমস্যা নয়। বরং বিজ্ঞান বলছে, ওই ছোট্ট ছোট্ট মস্তিষ্কে অবিরাম তোলপাড় করা হাজারো কল্পনার বহিঃপ্রকাশ হল ‘ডুডলিং’। এমনকী গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানীরাও জটিল থিয়োরি বা তত্ত্ব সহজে বোঝানোর জন্য কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ডুডলিংকেই হাতিয়ার করেন।
আবার ডুডলিং বা এই আঁকিবুকি আসলে ইনফ্যান্ট থেকে বড় ইন্ডাস্ট্রি— সকলের জন্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যখন কাউকে কোনও কাগজ আর পেন বা রং দিয়ে দেওয়া হয়, তখন মস্তিষ্ক এবং মনের মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবনা, অনুপ্রেরণা আর কল্পনার দরজা খুলে যায়। শুধু পড়াশোনার ক্ষেত্রেই নয়, অনেক সময়ে জীবনের নানা জটিল মোড়ে দাঁড়িয়ে এই ডুডলিং সাহায্য করে নতুন দিশা দেখাতে। এক টুকরো কাগজে নিজের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত না বলা কথার প্রকাশ ঘটাতে পারে ডুডলিং। এর ফলে হতাশা যেমন পাততাড়ি গোটায়, তেমনই জীবন ভরে ওঠে নতুন উদ্যম এবং ইচ্ছেয়।
ডুডলিং শেখার ও শেখানোর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। বিদেশে তো বটেই, এখানেও লেগেছে ডুডলিংয়ের জোয়ার। অনেক ক্ষেত্রে বহু মানুষই বলে থাকেন, ‘আমি তো আঁকতেই পারি না’। এখানেই শুরু ডুডলিংয়ের প্রথম পাঠ। প্রাথমিক ভাবে কিছু আকারের উপর ভিত্তি করা হয়। এর পর সেই শেপ বা আকারে সড়গড় হয়ে গেলেই নতুন আকারের সন্ধান দেওয়া হয়। এ বার এই সামান্য আকারগুলো থেকেই খুলে যায় ডুডলিংয়ের দুনিয়া। জানা গিয়েছে, মানুষ যখন সবচেয়ে কম কাজ করে, বা চিন্তাহীন হয়ে থাকে, আদতে নাকি তখনই তাঁর মস্তিষ্ক সবচেয়ে কার্যক্ষম হয়।
এ তো গেল ডুডলিং প্রসঙ্গে জটিল মনস্তত্ত্বের কথা। কিন্তু আপনি যদি আপনার বাচ্চার আঁকিবুকি নিয়ে সন্দিহান হয়ে থাকেন, তা হলে অবশ্যই বলব, আপনার খুদেটির কল্পনার নৌকোয় পাল লাগতে দিন। সে কী আঁকছে, কী লিখছে, তার কাজের মাধ্যমে ঠিক কী ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে— সে দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করুন। এ ভাবেই আপনি পেতে পারেন আপনার বাচ্চার মনের হদিস। কারণ, একটি বাচ্চার গভীর মনকে বুঝতে তার অবচেতন মনের শিল্পই সাহায্য করতে পারে আপনাকে।
দেওয়ালে আঁকিবুকি কাটার প্রবণতা থাকে অনেক বাচ্চারই। ফলে আপনি যদি বাচ্চার ঘরে ব্ল্যাক বা হোয়াইট বোর্ড লাগিয়ে রাখেন, তা হলে দেওয়ালে আঁকার ইচ্ছে অনেকটাই পূরণ হয়। অনেক মা-বাবাই আবার বাচ্চার সৃজনশীলতাকে উস্কে দেওয়ার জন্য দেওয়ালে এমন পেন্ট করান, যাতে সহজে রং তুলে ফেলা যায়।
বাচ্চা যত আঁকার বই চায়, কিনে দিন। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বোঝানোর চেষ্টা করুন, একটা বই শেষ হলেই পরেরটা মিলবে। আবার কখনও বলুন, বইয়ে শুধু রং করা নয়, তা দেখে দেখে আঁকার চেষ্টাও করতে হবে। নিদেন পক্ষে আঁকার খাতায় মনের মতো যা খুশি আঁকতে, রং করতে বলুন।
আপনার বাচ্চার রং করা, আঁকিবুকি সমস্যার তো নয়ই, বলা ভাল, এটা আসলে তার মনের রহস্য জানার চাবিকাঠি। অন্য দিকে তাকে ভাল রাখতেও সাহায্য করবে ডুডলিং। যে বাচ্চার হাত যত ব্যস্ত থাকবে, তার মন ও মস্তিষ্কও থাকবে সেই আঁকা নিয়ে জড়িয়ে। ফলে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ভিডিয়ো গেম বা টিভির অতিরিক্ত নেশা— অনেকটাই দূরে থাকবে।
আপনার বাচ্চার আঁকার প্রবণতা কী ভাবে সামলাবেন, সেটা নিতান্তই আপনার উপর নির্ভর করে। কিন্তু তার পরেও বলি, বিজ্ঞানের অথবা সাহিত্যের কোনও তত্ত্বে মন না বসলে আপনার বাচ্চা যদি ক্লাসনোটের খাতাতেই আঁকিবুকি কাটতে শুরু করে, তা হলে হতাশ হবেন না। কে জানে, এর মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের মাতিস কিংবা গঘ হওয়ার রহস্য!