বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে সম্পর্ক আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।
আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন লেখকই হবেন। শুধু মাত্র লেখার প্রয়োজনে বস্তিতে থাকতে পর্যন্ত কার্পণ্য করেননি। বরাবর বিশ্বাস করেছেন, সমস্ত মতামতের মধ্যেও শিল্পীকে অবিচল থাকতে হবে, পরের সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ফেসবুক-ধ্বস্ত যুগে যে সাহিত্যদর্শন বিলুপ্তপ্রায়! তিনি জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।
ভাল লাগার শব্দ, দৃশ্যগুলো...
মাঝখানে একফালি রাস্তা পুকুরঘাটে যাওয়ার। রাস্তা ঘেঁষে পুঁইমাচা। ওই মাচার কাছেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সে। দু’চোখ ভরে যে কী দেখছে কে জানে! চার বছর তো মাত্র বয়স। মা এসে এক বার ডেকে গেল, ‘কী রে কী দেখছিস!’ এক এক করে ঠার্কুদা-ঠানদি-কাকা-পিসিরা। কিন্তু মুখে রা নেই ছেলের।
ছোটকাকা বললেন, ধনু আকাশ দেখছে। অন্যরা বললেন, ফড়িং দেখছে ও। শুধু মা-ই বুঝতে পারছে ছেলের মন ভাল নেই। মা-রা আসলে সব কিছু বোঝেন! কিন্তু মন খারাপ কেন ধনুর?
আসলে যে যে কারণ আর গন্ধ থেকে ভাললাগা তৈরি হয়, তখনও ওই ছোট্ট ছেলের জগতে তা তৈরি হয়নি। ছোটবেলার ধনু, বড় হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী নিজের সেই বিস্ময় নিয়ে লিখবেন, ‘আজ আমি বুঝি তখনও আমার ভাল লাগার বোধ জন্মায়নি। ...কোন্ দৃশ্য, কোন্ শব্দ— কিসের গন্ধ আমাকে আনন্দ দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল তখনও জানতে পারিনি, বুঝতে পারিনি।’ আর সেই না বোঝাকেই আজীবন বুঝতে চেয়েছিলেন লেখক জ্যোতিরিন্দ্র, একের পর এক লেখায়। কখনও তাঁকে বলা হয়েছে যে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখেন, কখনও বলা হয়েছে লেখার মাধ্যমে আদর্শ প্রচার করছেন। কিন্তু সে সব কিছুকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুধু বিশ্বাস করেছেন, ‘মনে হয়, কোনো রচনাই ‘নিখুঁত’ হল না ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর’ হল না— আরও ভাল করে লেখা উচিত ছিল।’
প্রাতর্ভ্রমণের নেশা ছিল ঠার্কুদার। ঠার্কুদার হাত ধরে রেললাইন পার হয়ে একদম শহরের শেষ সীমায় এক খালের কাছে সে দিন চলে গিয়েছিল ধনু। তার পর সেখান থেকে খালের ধারে হেলিডি সাহেবের বাংলোর কাছে এক ফুলবাগানে। বুড়ো দারোয়ান ঠার্কুদাকে খুব ভালবাসতেন। দারোয়ান গেট খুলে দিলেন। কিন্তু বাগানে ঢুকেই চমকে উঠল ধনু। এই, এই বুঝি সেই অবিশ্বাস্য! ধনুর মাথার সামনে একটা গাছের দুটো ডালে দুটো সদ্য ফোটা গোলাপ। একটু একটু শিশির লেগে রয়েছে পাপড়ির গায়ে। সূর্য উঠছে সবে। তার রক্তাভ আলো এসে পড়েছে পাপড়িতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি নীল প্রজাপতি একটা কলির বোঁটায় এসে বসল। পলক পড়ছে না ধনুর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভিতরটা কী রকম করছে যেন।
জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘ভাললাগা কাকে বলে, ভাল দৃশ্য কী সেদিন প্রথম টের পেলাম। আর গন্ধ। নির্জন ঊষার সেই বাগানে গোলাপের মৃদু কোমল গন্ধে আমার বুকের ভিতর ছেয়ে গেল। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। যেন একটা আশ্চর্য সম্পদ আহরণ করে বাড়ি ফিরলাম।’
গন্ধের সঙ্গে বন্ধুত্ব, আজীবন...
বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে সেই যে সম্পর্কের শুরু, তা আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। আমৃত্যু। আসলে এক এক জনের স্মৃতি এক এক জিনিসের অনুরণন নিজের মতো করে ধরে রাখে। কখনও কোনও দৃশ্য, কখনও গন্ধ, কখনও আবার রং, এক এক জনের ক্ষেত্রে স্মৃতির অনুষঙ্গের বিষয়গুলি এক এক রকম। জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে তা ছিল গন্ধ। তিনি প্রয়োজন মতো সেই সব স্মৃতির অনুষঙ্গে ডুব দিয়েছেন। ডুব দিয়ে কখনও ‘ভাদ্র মাসে জলে ডোবানো পাটের পচা গন্ধ থেকে বা অঘ্রাণের পাকা ধানের গন্ধ থেকে বা কখন আবার পুঁটি, মৌরলা মাছের আঁশটে গন্ধ’ থেকে সৃজনের প্রয়োজনীয় উপকরণটুকু নিয়ে উঠে এসেছেন। সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে বসে পড়েছেন নিজের লেখার খাতার সামনে। তার পর পাতা জুড়ে জন্ম নিয়েছে একের পর এক দৃশ্যাবলি। ‘বুটকি-ছুটকি’, ‘গিরগিটি’, ‘বনের রাজা’-সহ অনেক গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে ছোটবেলার নানা রকম গন্ধের স্মৃতি। জ্যোতিরিন্দ্রের নিজের কথায়, ‘সব ক’টা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সেই শৈশব থেকে আমার নাকটা অতিমাত্রায় সজাগ সচেতন। পরবর্তী জীবনে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে এই গন্ধ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’
অথচ যখন তা সৃষ্টি হচ্ছে, তখন পাশের জন, একান্ত জন ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না লেখার খাতায় কী জন্ম নিচ্ছে! এতটাই নিভৃত সে শব্দযাপন! শুধু মাত্র তাঁর কয়েকটি অভ্যেসে কাছের জনেরা বুঝে নিতেন লেখার কোথাও আটকেছে! লেখার কোথাও আটকালেই উঠে গিয়ে দু’তিন গ্লাস জল খেতেন, দুটো পান খেতেন, ঘরের মধ্যে পায়চারি করে নিতেন কয়েক বার, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেন। জটটা খুললেই আবার ফিরে আসতেন লেখার টেবিলে।
এসে আধশোওয়া হয়ে বসতেন কেদারায়। সামনের দক্ষিণ দিক পুরো খোলা। সেখান থেকে প্রচুর আলো এসে পড়ছে ছিপছিপে একহারা চেহারায়। তিনি ভাবছেন আর লিখছেন। হঠাৎ করেই হয়তো মেয়ে-স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘অমুক চরিত্রের কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?’’ তাঁরা হয়তো নাম বলতেন দু’-একটা। কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত হতো না তাঁর। স্ত্রী হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ওই গল্পটার নাম কী দিলে?’’ নিরাসক্ত গলায় উত্তর আসত, ‘‘সে পরে দেখবে’খন।’’ আসলে নিজের লেখা নিয়ে আগাম কিছু বলাটা মোটেই পছন্দ করতেন না।
স্ত্রী পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ,—‘তারপর যখন লেখাটা ছাপা হল, দেখলাম ফাইনাল চেহারাটা কী দাঁড়িয়েছে। বারান্দায় ঝুকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ বললেন, একটা ভাল প্লট মাথায় আসছে জান। ব্যস, ঐটুকুই। তারপর শুধু লেখা।’
বারো ঘর, এক উঠোন
১৯১২ সালে অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। বাবা অপূর্বচন্দ্র নন্দী ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল। কিন্তু উকিল বা অন্য কোনও পেশা নয়। লেখক হবেন, এটাই স্বপ্ন ছিল বরাবর। ১৯৮২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে স্বপ্ন পূরণে কার্পণ্য করেননি কখনও। এমনকি, লেখার জন্য বেছে নিয়েছিলেন বস্তি এলাকাও। এমনিতে সারা জীবনে সাত-সাত বার ভাড়া বাড়ি পাল্টেছিলেন। চাকরি পাল্টেছেন একাধিক বার। কিন্তু যেখানে গিয়েছেন সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন সৃজনী-উপকরণ। পারিবারিক সূত্র জানাচ্ছে, মেয়ের বয়স তখন মাত্র চার বছর। বেলেঘাটার বারোয়ারিতলায় একটা বস্তি দেখে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। হঠাৎ করেই স্ত্রীকে এসে বলেছিলেন, ‘‘ওই বস্তিতে থাকতে হবে আমাদের। লেখার প্রয়োজনে।’’ তার পরে লেখার তাগিদেই থাকা শুরু ওই বস্তিতে। বাড়ির মাঝখানে বড় উঠোন। ভাড়াটে সব মিলিয়ে মোট এগারো ঘর। সকলের ব্যবহারের জন্য ওই একটিই উঠোন। কেউ কাজ করতেন দোকানে, কেউ আবার ছিলেন নার্স। বেশির ভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গের। ওখানে থাকাকালীনই সকলের হাবভাব খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন। দেখতে থাকলেন আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা। সে সব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি তার পরে হ্যারিকেনের আলোয় বসে বসে লিখেছিলেন। জন্ম নিয়েছিল ‘বারো ঘর এক উঠোন’।
সাদামাঠা খুব, অথচ নিজেই যেন ঘড়ি
বিলাসিতা নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, আড্ডা নেই, অহেতুক সময় নষ্ট নেই। অন্তর্মুখী অথচ স্পষ্টবক্তা, গভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধ রয়েছে, যাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁদের কাছে এমন ভাবেই ধরা দিতেন তিনি। যেমন বিয়ের জন্য পাত্রী (পারুল নন্দী) দেখতে গিয়েছেন। পাত্রী দেখা শেষের মুখে। হঠাৎ কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই পাত্রীর দাদাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কত মাইনে পাই জানতে চাইলেন না তো!’’ পাত্রীর দাদা একটু বিব্রত। কিন্তু তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নিজেই বলে দিলেন, ‘‘আমি মাইনে পাই একশো তিরিশ টাকা।’’ মেয়ের বাড়ির সকলে একটু অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেননি জ্যোতিরিন্দ্র।
আবার পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, বিয়ে করতে গিয়েছেন তিনি। একরাশ ঝাঁকড়া চুল, সাজগোজের মধ্যে শুধু লন্ড্রি থেকে কাচানো নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি। ব্যস, ওইটুকুই। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনিই বর!
সাদামাঠা ওই ভাব আজীবন সঙ্গী ছিল তাঁর। যেমনটা সঙ্গী ছিল নিয়মানুবর্তিতা। চূড়ান্ত আর্থিক কষ্ট, অনটনেও নিয়মানুবর্তিতায় কোনও খাদ ছিল না। সে এক মেয়ে ও দুই ছেলের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনই হোক কিংবা লেখাই হোক না কেন। লেখা আসুক আর না আসুক, রোজ নিয়ম করে লেখার খাতার সঙ্গে তাঁর সময় কাটানো চাই-ই চাই। পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, ‘লেখার সময়ও ছিল অত্যন্ত বাঁধা। যখনই মনে হল তখনই লিখতে বসলাম একদম পছন্দ করতেন না। যখনই মনে হল রাতে বাড়ি ফিরলাম একদমই পছন্দ করতেন না। আমার স্বামী নিজেই ঘড়ি হয়ে যেন নিজেকে এবং সেই সঙ্গে সংসারটিকে চালনা করতেন।’
সকালে ও বিকেলে দু’বেলা নিয়ম করে হাঁটতে যেতেন। কিন্তু ওই হাঁটার সময়ে খুব একটা কথাবার্তা পছন্দ করতেন না। মনে করতেন, সাধারণ কথা-গল্পের চেয়ে ওই সময়ে যদি কোনও গল্প-উপন্যাসের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে, তাতেই অনেক লাভ! লেখার জন্য এ ভাবেই নিজেকে একা করেছেন, বিযুক্ত করেছেন সকল কিছুর থেকে। ফেসবুক-ধ্বস্ত এ সময়ে লেখার জন্য নিজেকে নিঃসঙ্গ করার এই কৃচ্ছ্রসাধনের রীতি প্রায় বিরল। এ ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রের দুই পুত্র দীপঙ্কর ও তীর্থঙ্করবাবুর দু’জনেরই বক্তব্য এক। তাঁরা বলছেন, ‘‘শুধু লেখা নয়, তাঁর মতো এক জন ডিসিপ্লিনড মানুষ আমরা সারা জীবনে দেখিনি। স্নান-খাওয়া, বই পড়া থেকে শুরু করে লেখা, এমনকি, বাজার করাও ছিল ঘড়ি ধরে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন কী, তা তিনি জানতেন না।’’
‘গদ্য চাই! গদ্য!’
কবিতা লিখে শব্দ-সহবাস শুরু হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রের। কিন্তু কোথাও কিছুর একটা অভাব বোধ করছিলেন তিনি। কী যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। ‘গদ্য চাই। গদ্য খুঁজছি।’ তাই আতিপাতি করে বই খোঁজা শুরু হল। বাড়িতে কারও সাহিত্যচর্চা ছিল না সে ভাবে। ফলে বই খুঁজে পেতে প্রথমে একটু হোঁচটই খেতে হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার টেবিলের উপরে আইনের বইয়ের পাশেই মিলল সেই অমূল্য ধন! তিনটি উপন্যাস। তখন বয়স মাত্র এগারো থেকে বারো। রুদ্ধশ্বাসে পড়া হয়ে গেল রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা সে তিন উপন্যাস। তার মধ্য দিয়েই যেন সাবালক হল সাহিত্যপাঠ। ধনু আর এখন পুকুরঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশের পুঁইমাচার সামনে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে না। উপন্যাস-গল্পের বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে চরিত্রেরা তখন তার সঙ্গে যেন কথা বলে, গল্প করে। কিন্তু তাতে বিপদ হল এক দিন। বাবার বন্ধু বাড়িতে এসেছেন। তখন ধনু বসে উপন্যাস পড়ছে। সামনে আরও দু’-চারটে উপন্যাস-গল্পের বই ছড়ানো। বাবার বন্ধু তো দেখে অবাক। এগারো-বারো বছরের ছেলে এ রকম উপন্যাস পড়ছে! ‘‘এত অল্প বয়সের ছেলেকে এ সব উপন্যাস-টুপন্যাস পড়তে দেবেন না,’’ বলে তিনি চলে গেলেন। ‘অবাক হলাম বাবাকে দেখে। তিনি কিন্তু একবারও আমাকে বললেন না যে এখনও তোমার উপন্যাস পড়ার সময় হয়নি’, নিজের বাবা সম্পর্কে লিখছেন জ্যোতিরিন্দ্র। আবার তাঁর (জ্যোতিরিন্দ্র) পুত্র তীর্থঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘বাবার সঙ্গে লেখা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেছি। তিনি কথা শুনেছেন মন দিয়ে। মনঃপূত না হলে তখন নিজের মতটা বলেছেন।’’ আসলে নিজের বাবার কাছ থেকে মুক্তমনা সংস্কৃতির যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হননি জ্যোতিরিন্দ্র।
ক্রমশ গদ্যই সঙ্গী হয়ে গেল জ্যোতিরিন্দ্রের। প্রথমে অমুক সমিতি, তমুক ক্লাব, এ পাড়া, ও পাড়ার হাতে লেখা কাগজে গল্প পাঠানো চলছিল নিয়মিত। ছোট হলেও একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছিল গল্পকারের পরিচয়। এই করতে করতে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে গেল। কলেজে পড়াকালীন মঁপাসার একটা গল্প অনুবাদ করে ঢাকার এক পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সেটি ছাপা হল। ছাপার হরফে সেই প্রথম নিজের নাম দেখলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সে কী আনন্দ! তার এক মাস পরেই ওখানে একটি মৌলিক গল্প পাঠালেন। ছাপা হল সেটিও। এর মধ্যেই ঘটল সেই ঘটনা। স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করার জন্য তাঁকে সন্ত্রাসবাদী অ্যাখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়! জ্যোতিরিন্দ্র লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। চার মাস জেলে আটক করার পর আমাকে স্বগৃহে অন্তরীন করা হয়।’ শুধু অন্তরিন করে রাখাই নয়, চাপল সরকারি নিষেধাজ্ঞাও—কোনও পত্রপত্রিকায় লেখা যাবে না। কিন্তু মাথার মধ্যে শব্দেরা যে ভর করছে, ভনভন করছে তারা। অতঃপর ‘জ্যোৎস্না রায়’-এর আগমন ধরণীতে! ‘জ্যোৎস্না রায়’ ছদ্মনামেই চলল সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। কিন্তু সে সব লেখার কিছুই নিজের কাছে রাখা গেল না। দেশভাগ হল। ও পার বাংলার আলমারিতেই পড়ে রইলেন ‘জ্যোৎস্না রায়’!
‘এবার উপন্যাসে হাত দাও!’
১৯৩৬ সাল। কলকাতায় চলে এলেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুরু হল লেখকজীবন। পাইস হোটেলে খাওয়া, পড়া, দু’-একটা টিউশন আর লেখা— এই ছিল নিত্যদিনের রুটিন। সিনেমা নয়, খেলা দেখা নয়, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা নয়। প্রত্যেক দিন শুধু নিয়ম করে লেখা চলত। পড়িয়ে আয় হত ওই বাইশ-তেইশ টাকা। হোটেলে থাকা-খাওয়া বাবদ বারো-তেরো টাকা দিতে হত। ধোপা-নাপিত-বিড়ি-পান সব মিলিয়ে যা আনুষঙ্গিক খরচ, ওই আয়ের মধ্যেই হয়ে যেত। প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের সাপ্তাহিক পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রের বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ছাপলেন। ‘পূর্বাশা’ ও ‘অগ্রগতি’তেও ছোটগল্প বেরোল। তার মধ্যেই এক সংবাদপত্রে সাব-এডিটরের চাকরি পেয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্র। অল্প কয়েক দিনের চাকরি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ‘দেশ’ পত্রিকায় আরও একটি গল্প বেরোল। একে একে ‘মাতৃভূমি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’-সহ একের পর এক পত্র-পত্রিকায় গল্প বেরোতে থাকল। বন্ধুদের মধ্য থেকে দাবি উঠল উপন্যাসের। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র তখনও প্রস্তুত নন। তাঁর কাছে ‘উপন্যাস তো একটা প্রকাণ্ড ইমারত। আর ছোটগল্প সেই ইমারতের ইট।’ ওই ইটগুলো একের পর এক সাজিয়ে উপন্যাস তৈরি করতে হয়।
অতঃপর সাগরময় ঘোষের সেই চিঠি। ছোটগল্প চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন সাগরময় ঘোষ। সঙ্গে লিখলেন— ‘এবার উপন্যাসে হাত দাও।’ ব্যস! জ্যোতিরিন্দ্র লাফিয়ে পড়লেন উপন্যাসে। এত দিন ছোটগল্প লিখে তিল তিল করে যে শব্দবিন্যাস তৈরি করেছেন, তাই উজাড় করে দিলেন নিজের প্রথম উপন্যাসে। ‘সূর্যমুখী’ সম্পূর্ণ হল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হল সে উপন্যাস। প্রকাশ হওয়ার পরে তা নিয়ে প্রশংসা জুটল, নিন্দা জুটল তার চেয়েও বেশি। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র থামলেন না। ‘সূর্যমুখী’র পরে ‘মীরার দুপুর’, তার পর ‘বারো ঘর এক উঠোন’। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ তাঁকে খ্যাতি দিল, পরিচিতি দিল, প্রতিষ্ঠা দিল। তবে অনেক সমালোচক জানালেন, লেখক ওই উপন্যাসে শুধু অন্ধকারই দেখেছেন। নিজে যেমন আলো দেখতে পাননি, তেমনই একটি চরিত্রকেও আলোয় উত্তরণ করাতে পারেননি। সমালোচকদের যাবতীয় আক্রমণ, নিন্দাপর্ব মেটার পরে, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর হয়ে কলম ধরেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। লিখেছিলেন, ‘আলো দেখাবার জন্য উত্তরণ দেখাবার জন্য আমি এ-বই লিখিনি। কেননা আমার দেখা ও জানা চরিত্রগুলির মধ্যে এমন একটি মানুষও ছিল না, যে এদের মধ্যে উপস্থিত থেকে মহৎ জীবনাদর্শের বাণী শোনাতে পারত। বিপন্ন, বিপর্যস্ত, অবক্ষয়িত সমাজের মানুষগুলি শুধু বেঁচে থাকার জন্য, কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কতটা অন্ধকারে, কতটা নিচে নেমে যেতে পারে আমি তাই দেখিয়েছি।’
আগুন ও নিরাসক্তি
‘পাঠকদের সমাদর বেশি পাননি বলে মনে মনে হতাশা ছিল কিনা বলতে পারব না। স্বভাবটা ছিল ভীষণ চাপা। এতদিন পাশে-পাশে থেকেও হতাশা-টতাশা কিছুই বুঝি নি। কেউ হয়ত বাড়ি এসেছেন কথায় কথায় তাঁকে বললেন, অ্যা—আমার বই টই বিক্রিই হয় না, আমি আর কি লিখব! তবু ভিতরে একটা আগুন ছিল নিশ্চয়ই, নইলে সারাজীবন এত লিখলেন কি করে?’ মৃত্যুর আগে নিজের স্বামীর সম্পর্কে এমনটাই লিখে গিয়েছিলেন পারুল দেবী। আগুন, সেই সঙ্গে চূড়ান্ত নিরাসক্তি। সাফল্য এবং ব্যর্থতা, উভয়ের প্রতিই নিরাসক্তি। হয়তো এই নিরাসক্তিই ছিল তাঁর চালিকাশক্তি। বর্তমানে যেখানে যে কোনও সৃষ্টিই যেমন ‘ফিফটিন মিনিটস অব ফেম’-এর আলোকবৃত্তে নিয়ে আসতে পারে কাউকে বা অশালীন আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে ওই সৃষ্টি ঘিরে— সেখানে জ্যোতিরিন্দ্র বহু কাল আগে যে কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, তা এখনও ভীষণ ভাবে সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক। জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘যুগটা বড় বেশি মুখর। অনেক কাগজ অনেক পাঠক অনেক মতবাদের সামনে আপনাকে অহরহ দাঁড়াতে হচ্ছে। ...একই সময়ে নিন্দা প্রশংসার ঝড়ের সামনে আপনাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। ...শিল্পীর জীবনে এ এক অভিশাপ। আবার পরীক্ষাও। আমি তাই মনে করি। পরীক্ষা হচ্ছে শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টিক্ষমতার উপরে অকাট্য বিশ্বাস রেখে তাঁর পরবর্তী রচনায় হাত দিচ্ছেন কিনা। ...প্রত্যয়ের হাত শক্ত করে ধরে হাজার রকম মতামতের ঢেউয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া শিল্পীর আর কিছু করার আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।’
মনে করেননি, তাই লিখেছেন আমৃত্যু। আর জীবনছোঁয়া সে সব শব্দ-অক্ষর ছড়িয়ে পড়েছে উঠোন জুড়ে, সাধারণ মানুষের সাধারণ কথা হয়ে...
ঋণ: আমার সাহিত্যজীবন, আমার উপন্যাস: জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী;
আমার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী: পারুল নন্দী