রয়েছ নয়নে নয়নে

তাঁকে গান শেখাতে অপেক্ষায় থাকতেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়! তাঁর ছন্দের তালিম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। গানভুবনের মত্তপাগল বিক্রম সিংহ খাঙ্গুরা। তাঁর কাতর ক্ষুদ্র জীবনের গদ্য লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায়গেটের শব্দে দু’বার জানলার ধার থেকে ফিরলেন মোহর। ছেলেটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। পথে কোনও...! ভেবে ভেবেই আকুল। ভেবে ভেবেই টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। গোরাকে কি একবার এগিয়ে দেখতে বলবেন...। কার পথ চেয়ে ভাবছেন মোহর?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

গেটের শব্দে দু’বার জানলার ধার থেকে ফিরলেন মোহর।

Advertisement

ছেলেটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। পথে কোনও...! ভেবে ভেবেই আকুল। ভেবে ভেবেই টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। গোরাকে কি একবার এগিয়ে দেখতে বলবেন...। কার পথ চেয়ে ভাবছেন মোহর?

ফোন গেল অ্যান্ডুজপল্লির ‘আনন্দধারা’ বাড়ি থেকে ৮ নম্বর কোয়ার্টারে।

Advertisement

‘‘কই কবি এল না এখনও!’’

‘‘মোহরদি আপনার কবি তো বিনয়ভবনের মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছে। মাঠ-ফেরত ও আপনার কাছে যাবে গান শিখতে।’’

কে এই কবি, যাকে গান শেখাবার জন্য পড়ন্তবেলায় পথ চেয়ে রয়েছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়! এত উদ্বিগ্ন!

কবির নাম বিক্রম।

বাবা মোহন সিংহ খাঙ্গুরা।

একটু পরেই অ্যান্ড্রুজপল্লির পথ ও প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল রবিঠাকুরের গানের আলো।

আরেক রকমের আলো।

পিলু বারোয়াঁয় সারা পল্লি যেন ভেসে যাচ্ছে! বিক্রম গাইছে, ‘এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর’, কখনও সুর সরে গেলে মোহর ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।’

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে

‘কিছুই তো হল না’

অদূরে লালবাঁধ।

ডিয়ারপার্কের লাল কাঁকুরে পথ ছুঁয়ে মোহন সিংহের বাড়ি। ‘শাহানা’। স্মৃতির সুর সফরে হাঁটতে হাঁটতে বিক্রমের ছেলেবেলার কথা বলছিলেন মোহন।

এ বাড়ির এঘর-ওঘর, ছাদ-বাগান, আলো-বাতাস, সর্বাঙ্গ জুড়ে বিক্রমের গান। স্মৃতির নির্দয় ছোবল!

‘‘ওর জন্ম পঞ্জাবে। যখন জন্মায়, গায়ের রং ছিল গোলাপি! আমার স্ত্রী (শুচিস্মিতা) ওকে তাই ‘পিঙ্কু’ বলত। মনে আছে, ও প্রথম সা লাগিয়েছিল মাত্র এক-দেড় বছর বয়সে। আমার গুরুজি ওস্তাদ ওয়াঝেলওয়ার প্রায়ই আমার বাড়ি আসতেন। একদিন ওঁর কোলে বসিয়ে উনি ‘সা’-তে সুর লাগাতেই, বিক্রমও শুনে শুনে ‘সা’ লাগাল। ওস্তাদজি চমকে গেলেন ওর সুর লাগানো দেখে! বললেন, ‘এমন কখনও দেখিনি!’ মোহরদির বাড়িতে ওর যাতায়াত ছ’বছর বয়েস থেকে। মোহরদির কোলে বসে ও গান শিখেছে। কবিতা লিখত বলে, মোহরদি ওকে কবি বলে ডাকত।’’

তখন বিক্রমের স্কুলবেলা।

প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে।

বাগানপাড়া ছুঁয়ে সাইকেলে দৌড়।

মোহর খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘‘তোমার নাম আমি কবি রেখেছি, তুমি সার্থক করেছ!’’

যে দিন মোহর চলে গেলেন, শান্তিনিকেতনের ছায়াময় বিজন পথে একা একা ঘুরেছিল তাঁর কবি। মুখ নামিয়ে ছিল সারাটা দিন।

শোকসভায় গেয়েছিল তাঁরই শেখানো গান, ‘কিছুই তো হল না।/ সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকার রব...।’

ফর্টিফাইভ মাঠ পেরিয়ে ছায়ারা দিঘল হলে বিক্রম একা একা কবিতার খাতায় কালো কালিতে লিখেছিল শোকগাথা, ‘‘বর্ষাকাল ও শ্রাবণদিন/ তেমন করে ব্যথার থেকে গানে/ তুমি কি আর নতুন কোনো জন্ম লিখে দেবে।’’

বাল মুরলীকৃষ্ণর পাশে

‘না বুঝে কারে তুমি’

সে দিন ভূপালি।

তবলা-তানপুরা টেনেটুনে দু’টিতে বসেছে রেওয়াজে। তবলা বাজাচ্ছে ভাই আবীর সিংহ। আর বন্দিশে সুর লাগিয়ে গলা ছাড়ছে দাদা বিক্রম, ‘আজহু না-আয়ি সখিরি।’

হঠাৎ ঘরে চেনা অতিথি শান্তিনিকেতনের এস্রাজি রণধীর রায়। হাসতে হাসতে মজা করে বললেন, ‘‘তোমরা জানো, এ গান আমি তোমাদের বাবাকে শিখিয়েছি।’’

বিক্রম অবাক, ‘‘তাই বুঝি!’’

আবীর বলছে, ‘‘গাও দেখি।’’

গেয়ে শোনাচ্ছেন রণধীর। শেষ হতে ওরা দু’জন বলে ওঠে, ‘‘তোমার থেকে বাবা অনেক ভাল গায়!’’

হেসে ফেলেন রণধীর।

সেই তাঁর সঙ্গে সখ্য হয়ে গেল দুই ভায়ের। রণধীর রায় হয়ে গেলেন দু’জনের কাছেই ‘গান-কাকু।’

যে দিন চলে গেলেন রণধীর, খুব কষ্ট পেয়েছিল দুইভাই। বাসন্তিক রাতে আবীর ছড় টেনে বাজিয়ে চলেছে একনাগাড়ে গান-কাকুর শেখানো তিলক-কল্যাণ, ইমনের বিস্তার।

বিক্রম এলিজি লিখেছিল, ‘‘কোথায় রেখেছো পথিকের ঘুম/ পথের দু-ধারে শালবন কথা বলে?/ হৃদয়ে ঝরেছে আলোর শীর্ষ?/ জানো কি, বুকের গহনে দীঘল মেঘ খুলে যায়...!’’

লিখছে আর কাঁদছে!

নিজের ঘরে

‘চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে’

বকুলবীথি থেকে তিনপাহাড়ের দিকে ছেলেটা ছুটছে। দৌড়। যেন পাখির পিছনে দৌড় তার। দু’হাতের মুঠোয় উপচে পড়ছে রঙিন নুড়ি-পাথর।

পাঠভবন। কুয়াশা ভোরের মন্দির। ছাতিমের গন্ধ। দুপুরের তিনপাহাড়, হেমন্তে পাতা ঝরা শালবীথি। বসন্তের রাঙা পলাশতলি। আর ঘন শ্রাবণ দিনে জলরঙে আঁকা কোপাই। — এ সব ছিল বিক্রমের খুব প্রিয়।

যেমন তেমন ঘোর রঙের প্যান্ট। খাটো চাইনিজ কলারের ফতুয়া। সাইকেলে সে লাইব্রেরির পথে। বা, কোপাই, সোনাঝুরি।

বাড়ি ফিরেই মাকে বলত, ‘‘দু’পিস মাছ ভেজে দাও তো। খুব খিদে পেয়েছে।’’

রাতে হয়তো বায়না উঠল ফেঞ্চ টোস্টের। নিজেই কিচেনে ঢুকতে যাচ্ছে। মা নিষেধ করে বলছেন, ‘‘থাম তো, তুই যা, বানিয়ে দিচ্ছি।’’

নিখাদ আড্ডার দিনে ছবির গল্প নিয়ে বিক্রমের গানের সঙ্গে জুড়তেন যোগেন চৌধুরী। মঙ্গলবার হঠাৎ শ্রীপল্লি থেকে উড়ে আসত একটা টেলিফোন।

‘‘মোহন কাল তো তুমি রেওয়াজ করবে। আমাকে একটু টোড়ি শুনিও।’’

‘‘হ্যাঁ শান্তিদা। চলে আসুন।’’

রিকশা থামত মোহন সিংহের বাড়ির সামনে। নামতেন শান্তিদেব ঘোষ।

মোহন রেওয়াজ করতেন।

টোড়ি। কোনওদিন বিলাসখানি টোড়ি। ‌স ঋ জ্ঞ, ম জ্ঞ ঋ, জ্ঞ প...।

একটু পরে ঠিক পাশেই কীর্তনাঙ্গের গান গুনগুনাতেন শান্তিদেব। কখনও বা দিনুঠাকুরের শেখানো গান গাইতেন আপন খেয়ালে, ‘চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।’

শুনে শুনে নির্ভুল গান তুলে নিত বিক্রম। তার যে খুব ভাল লাগে শান্তিদেবের গায়কি! মায়ের কাছে, মোহরমাসির কাছে শেখা রবিঠাকুরের গান! তার পছন্দ জয়পুর ঘরানা আর আগরা ঘরানার গান-বাজনাও। পছন্দের শিল্পী উস্তাদ উলহাসজি, উস্তাদ আব্দুল করিম খান, উস্তাদ ফৈয়াজ খান সাহেবের কণ্ঠ। আবার সে ভক্ত সনাতন দাস বাউলেরও। শিল্পী শর্বরী রায়চৌধুরীর বাড়িতে সনাতন বাউল এলে, বিক্রমকে ঘরে আটকানো দায়! বাউল সুরে সুর মিলিয়ে পথে যেতে যেতেই বিক্রম গায়, ‘কাঁখের কলসি, গেল রে ভাসিয়া।’

হয়তো গাইতে গাইতেই সে বসল গিয়ে কালোর দোকানে। বাজারে পাঠিয়েছিল মা। তার কি আর মনে আছে! সনাতনের সুর যে ঘুরছে মাথায়। যখন ঘরে ফিরল, বেলা দ্বিপ্রহর! হাসতে হাসতেই ঢুকে পড়ল চানঘরে। গুনগুনাচ্ছে, সকালের বিলাসখনি। দম, জ্ঞঋ, জ্ঞঋ স...।

আচম্বিতে লেখা ছেড়ে

‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’

সন্ধেগুলো বাবার কাছে গল্প শোনার। মোহন পড়ছেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ থেকে। চুপটি করে শুনছে দুই ভাই।

‘‘প্রদীপের মৃদু আলোয় সেদিন রাত্রে সে ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইখানা খুলে পড়তে বসল। এই বইখানার একটা জায়গা তাকে বড় মুগ্ধ করে। ... কতবার ভেবেচে হের্ হাউপ্টমানের মতো সেও একদিন যাবে মাউনটেন্ অফ্ দি মুন্ জয় করতে। স্বপ্ন!’’

শুনতে শুনতে কত স্বপ্ন যে ভর করছে বিক্রমের চোখে!

আনন্দ পাঠশালা থেকে পাঠভবন। উত্তরশিক্ষা থেকে বিদ্যাভবন। ছেলেটাকে এখনও বেশ মনে করতে পারেন বাংলা বিভাগের প্রাক্তনীরা। বিক্রমের বন্ধুজন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি যেমন।

‘‘সেটা বোধহয় ১৯৯৩। আমাদের বাংলা বিভাগের শিমুলতলায় ফার্স্ট ইয়ারের নতুন নতুন মুখ। তারই মধ্যে একজন ছেলে পঞ্জাবির উপর গায়ে একটা শাল এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে ডান হাতটা তার সম্পূর্ণ মুক্ত। সেই হাত! যে হাত গান গাইবার সময় বিশেষ মুদ্রায় বেরিয়ে আসতে দেখেছি পরে কতবার! সেই হাত; যে হাতে সে মোটা মোটা কালো কালির আখরে কবিতা লিখেছে, রাত জেগে ছবি এঁকেছে নিতান্তই খুশির গরজে।’’

সে দিন সনেট পড়াচ্ছেন কেউ!

বিক্রমের কি মন আছে! তার ক্লাসনোটের খাতাগুলো ভরে উঠছে অসংখ্য কবিতা আর কাটাকুটির ছবিতে। সিলেবাস তো দূর, ভুলেই যেত পরীক্ষার দিন-ক্ষণ! টিফিন পিরিয়ড।

হয়তো সে দৌড়চ্ছে বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে। খাতা খুলে খুলে কবিতা আর ছবি মেলে ধরছে বন্ধুদের সামনে। ঠোঁটের কোণে লেগে দুষ্টুমির হাসি।

একবার সকাল ৮টার পরীক্ষা। দিতে এল বেলা ১০টায়!

তাকে নিয়ে কী যে চিন্তা মা আর ‘দোদো’র, মানে দিদিমার। কেবল তাঁদের জন্যই সে পরীক্ষার আগে হাজির হত পূর্বপল্লি বয়েজ হস্টেলে মানবের কাছে। নতুন লেখা কবিতা পড়ে বা রবিঠাকুর শুনিয়ে সিগারেট প্যাকেটের ফয়েলে খুদে অক্ষরে টুকে নিত সিলেবাস!

সেই সব মেহগনি স্মৃতি থেকে মানব বলছিলেন, ‘‘একবার প্রমথ চৌধুরীর গদ্যের উপর একটা ক্লাস-পরীক্ষায় ও ১০-এ ৬ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিল আমাদের! তা নিয়ে সে শিশুর মতো খুশি। বিক্রমের খাতাটা কাড়াকাড়ি করে পড়লাম। ‘সূদনসাপেক্ষ’ জাতীয় বিচিত্র শব্দ আর ভাষার কারিকুরি করেছে দেখলাম! প্রমথ চৌধুরীর গদ্য নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন গদ্য লিখেছে যে স্বয়ং চৌধুরী মশায় দেখলেও বোধহয় ঘাবড়ে যেতেন!’’

‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’

সিলেবাস সে যাতেই লিখুক, কবিতা লেখার সময় বিক্রমের দরকার পছন্দের পেন, মোটা কালো কালি।

উৎকৃষ্ট কাগজ ছাড়া তার চলত না।

প্রায়ই দেখা যেত। দেখাই যেত, বাংলা বিভাগের ছাতায় বসে সে লিখছে আর কাটছে। সবেতেই যে তার খুঁতখুঁতুনি! বিশেষ কলম, বিশেষ ব্র্যাণ্ডের সিগারেট চাই। কবিতার বানান নিয়েও বিক্রমের ছিল নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ! ‘সাদা’ বানানটা তার পছন্দের ছিল না। তার বানান ছিল ‘শাদা’।

মানব তাই মজা করে বলেন, ‘‘এ সব ব্যাপারে ও দ্বিতীয় বুদ্ধদেব। বলত, তালব্য-শ দিয়ে শাদা না-লিখতে পারলে শ্বেতত্বটা ঠিক ফোটে না। দন্ত্য-স দিয়ে লেখা সাদা যেন ফ্যাকাসে দেখায়! তাছাড়া তালব্য-শ-এর ভিজ্যুয়াল অ্যাপিল অনেক বেশি!’’

রাতজুড়েও চলত লেখালিখি।

লেখা শেষ হলেই ভাই আবীরকে ঘুম ভাঙিয়ে বলত, ‘‘আচ্ছা এটা শোনো তো। কেমন হল বলো দেখি।’’

শোনাত সাহিত্যসভায়।

সে সময় বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা সুতপা ভট্টাচার্যের কোয়ার্টারে ছোট একটা সভা হত।

গানে কবিতায় সেই বন্ধুসভায় আড্ডাধারীদের একটি পত্রিকাও ছিল, ‘সজন’। বিক্রম তার দু’বার সম্পাদক হয়েছিল। একদিন সভা চলছে...

সুতপা বললেন, ‘‘আসরের চা-টা কেন শুধু মেয়েরাই বানাবে? যাও বিক্রম চা বানাও। জল ফোটার পরে চা-পাতা দিয়ে ভিজতে দিয়ো। পাঁচ মিনিট।’’

প্রবল উৎসাহ বিক্রমের। একটু ভয়ও! কিছুক্ষণ পরেই সে এ ঘর-ও ঘর ঘুরছে। দেওয়ালের দিকে তাকাচ্ছে।

ব্যাপারটা কী?

সে দিনের আড্ডাধারীদের একজন বলছেন সে দিনের স্মৃতি, ‘‘ওই যে পাঁচ মিনিট! বিক্রম বলছে, ‘ঘড়ি কোথায়? পাঁচ মিনিটটা বুঝব কী করে!’ ওর ঘড়ি খোঁজার কাণ্ড দেখে সবার সে কী হাসি! আসলে বিক্রমকে কখনও ঘড়ি পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সময়ের দাসত্বটাই ও কখনও মেনে নিতে পারত না। ওর ছিল নিজের নিয়মের একটা অদৃশ্য ঘড়ি! সে ঘড়ি কখনও তাড়া দেয় না বেলা বয়ে যাওয়ার। ও একেবারে সময়ছুট্‌ মানুষ। চলেও গেল বড্ড অসময়ে!’’

’৯৬-এ বাংলা বিভাগের পুরী এক্সকার্সন মনে করতে পারেন এখন কেউ কেউ! বালুকাবেলার স্মৃতি।

সমুদ্র যেন অপার এক আনন্দের ভুবন হয়ে উঠেছিল বিক্রমের কাছে। ভোর ভোর সে গিয়ে বসত সমুদ্র-কিনারে। জলের কাছে। ঢেউয়ের কাছে।

কখনও শুদ্ধ সারং, কোনও দিন নট বেহাগ। হুহু হাওয়ার ভিতর খই ছড়াত শ্যামকল্যাণ! কথার মধ্যেই গুনগুনিয়ে উঠত সুর। বড় বড় রাগের পকড়!

মায়ের সঙ্গে দুই ভাই

‘আমি বহু বাসনায়’

‘‘কোথায় চললে বিক্রম?’’

‘‘ডিপার্টমেন্ট, সন্ধেয় দেখা হবে ‘চতুর্দশী’র সাহিত্য সভায়।’’

ইন্দ্রজেঠুর ‘সুবর্ণরেখা’ বইয়ের দোকানের সামনে কাকে একটা বলতে বলতে হন্তদন্ত সাইকেল নিয়ে হাঁটছে বিক্রম। হাঁটছে কেন? সাইকেলের চেন পড়ে গেছে। লাগানোর সময় নেই তার!

পথে কত যে তার বন্ধু।

হাঁটছে আর নতুন লেখা কবিতাটার কথা ভাবছে। ‘তিলক কল্যাণ’।

‘‘কে ভাসালে বড়ো বেদনার মতো মুখের আদল/ হৃদয় জুড়ে/ সারা দিনমান ঝড়ে যায় বুকের শ্যামল পাথর/ অতল কালো/ এ দিনান্ত প্রাণ খুঁড়ে তোলে আজ শিকড় অবধি বাতাস, আলো...।’’

কাঁধের ঝোলায় কবিতার খাতার সঙ্গে কত বই তার! ইংরেজি বই, অনুবাদের বই, ছবির বই, কবিতার বই।

কবি মানে, এলিয়ট, বোদলেয়ার, শক্তি আর জীবনানন্দ। শক্তির মতোই তারও কবিতায় দিন দিন ঢুকে পড়ছে পল্লির রোদ-হাওয়া। ‘‘এতদূরে সরে গেছো/ নিভৃত সৃজন ফেলে/ অন্য নির্মাণে—/ মানুষের ভিতরে যেমন মানুষ/ ক্রমাগত দূরে সরে যায়...।’’

শক্তি শান্তিনিকেতনে!

আনন্দবাজার থেকে অবসর নেওয়ার পরে বিশ্বভারতীর অনুরোধে কবি শক্তি এলেন বাংলা বিভাগের অতিথি-অধ্যাপক হয়ে। নাওয়া-খাওয়া উড়ে গেছে বিক্রমের। শক্তিও খুব স্নেহ করতেন ওকে।

ফুরফুরে দু’জন।

বন্ধু নীলাঞ্জনের সঙ্গে নিত্য যাতায়াত শুরু হল পূর্বপল্লি গেস্ট হাউস, শক্তির ১৯ নম্বর ঘরে। ‘পদ্য লেখা শেখার ক্লাস’-এ যেতে দু’ই ছাত্রের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন শক্তি।

হাঁটতে হাঁটতে বিক্রম জেনে নিচ্ছে ছন্দ-মিলের কথা। সেই দিন এখনও নীলাঞ্জনের স্মৃতিতে অমলিন। —

‘‘বিক্রম ডান দিকে, আমি বাঁদিকে। দেখতাম, শক্তিদা উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতেন পূর্বপল্লির গাছগুলোর দিকে। রোজ পথ থেকে কুড়িয়ে উনি একটা করে আমলকী খেতেন।’’

দিন কয়েক পরে শক্তি চলে গেলেন! কান্নায় ভেঙে পড়ে বিক্রম নিজের মতো করে শেষ শ্রদ্ধা জানাল। লিখল, ‘...বিপরীত মুখে চলে যাওয়া রাজপথ কতোটা সময় রেখে যায়— আয়ুহীন মাপকাঠি?/ ক্রমশ ডুবে যাওয়া লালচাঁদ আর/ বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুড় শালবন...।’

‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায়’

দোল। রং লেগেছে শান্তিনিকেতনের স্থলে, জলে, বনতলে। জাগছে দখিন হাওয়া। ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে।’

জয় শান্তিনিকেতনে।

স্মৃতি থেকে আবীর বলছেন, ‘‘জয় গোস্বামী তখন এলেই প্রায়ই ঢুকে পড়ছেন দাদার ঘরে। মেঝেয় বসতে বসতে হয়তো বলছেন, ‘বিক্রম শ্যামকল্যাণ শোনাতে হবে! এক্ষুনি। কোনও দিন জয়জয়ন্তী।’ দাদাও তানপুরা টেনে নিয়ে শোনাচ্ছে। আর দোল মানে তো সুরের মেহফিল।’’

জ্যোৎস্না রাত্তিরে বিক্রম গাইছে। ‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।’ শুনতে শুনতে নির্বাক বন্ধুজন!

জয় লিখছেন, ‘‘দোল উৎসবে তরুণ-তরুণী কবিরা এসেছে শান্তিনিকেতনে। ছাদে বসে গান গাইছে সে। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান। বাড়ি ফেরার সময় কোন তরুণী ওর সঙ্গ নিল? তাই নিয়ে বয়সের গাছপাথর নেই এমন এক কবিতা লেখক লিখে ফেলল, নতুন কবিতা। এই সময় তার প্রাণের বন্ধু কলাভবনের পাগলি মিঠু সেন।... কবিতা লেখে দু’জনে। সাইকেলে ঘুরে বেড়ায় শান্তিনিকেতনের রাস্তায়, আর তুমুল ঝগড়া করে।’’

ঝগড়া মিটেও যায়!

মোটা কালিতে বিক্রম লেখে, ‘‘...শীত শীত মিহিন কুঠিবাড়ি/ যা কিছু উন্মাদ করতল উজাড় করে চায়/ গমের ঘ্রাণের মতো ভোর, শাঁখরঙ/ অপরাহ্ন গুলঞ্চের... / ‘দিতে পারো দু-একটা বৃষ্টি গান লিখে’...।’’

এ বার কবিতা-গানের সঙ্গে ছবি নিয়ে পড়েছে বিক্রম।

যোগেনদা তো ছিলেনই, এ বার যাতায়াত সোমনাথ হোড়ের বাড়ি, মানিদার বাড়িতেও। স্বজন হলেন সোমনাথ হোড়ের মেয়ে চন্দনা। একসঙ্গে মেতেছেন ছবি নিয়ে। অবনপল্লিতে চন্দনার স্টুডিয়োতে বিক্রম গাইছে, ‘ওগো কিশোর, আজি তোমার দ্বারে পরান মম জাগে।’ গানের সঙ্গে রং মিলিয়ে ছবির সিরিজ করলেন চন্দনা। প্রদর্শনীও হল কলকাতায়।

বিক্রম ছবি দেখতে ঢুকে পড়ছে যখন তখন কলাভবনেও। রং লাগছে তার কবিতায়। শব্দে, সেমিকোলনে, পূর্ণ যতিতে। মিঠু লিখছে, ‘‘কথা না বললে টাঙিয়ে রাখব কুর্চি গাছে/ কথা না বললে জামার বোতাম ছিঁড়ব দাঁতে/ কথা না বললে কালপুরুষের সাথে শুতে যাব/ কালপুরুষের সাথে শুতে যাব তিনতলার ছাতে/’’ ... না-বলা কথার অভিমান জমতে থাকে। শব্দের গায়ে শব্দ লেগে যেমন জমাট বাঁধে অভিমান!

‘‘কথা না বললে কথা না বললে— না বলা কথা/ তুই না-বলিস আমি বলে যাব ঠিক তোর সাথে।’’

মগ্ন কবি

‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’

সেই ছিয়ানব্বইয়েই অভিমানের জমাট মেঘ ভেঙে ভেঙে বিক্রম ‘মিঠুর জন্য’ লিখল তার ‘ব্রাত্যকথা।’

‘‘তোমার পাশে রাত্রিজাগা মাঠ/ মেঘের নীচে কাঁপতে থাকা ভোর/ তোমার কাছে যেটুকু পরিচয়/ যেটুকু পাপ ভাসিয়ে নেবে ঘোর/ ভেসে চলার পথের কাঁটা নীল/ ভেসে চলার পথে হাজার সুখ/ মাটি শীতল মাটির যতো শব/ আগুন দেবে, পুড়িয়ে দেবে বুক/ পোড়া বুকের শ্যাওলা মাখে চাঁদ/ পোড়া বুকের কাঁথা জলোচ্ছল/ আগল খুলে দিল কঠিন শীত/ উপচে ওঠে বাদামী সানুতল...।’’

একান্তের জন্য চল্লিশ লাইন।

ঠিক যেন জয়ের ‘কড়ি ও কোমল’-এর সেই মেয়েটি, সেই ছেলেটি।

জয় তো ‘জলঝারি’ তাকেই দিয়েছিল। ‘যে অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে’ তাকে। বিক্রমকেই!

‘‘...খোয়াই, খোয়াই তুমি জানো ওরা কোথায়? জানি তো। ওরা এখানেই আসছে। এখন রাস্তায়। কোন রাস্তায়, খোয়াই? ওরা গোয়ালপাড়ার ভেতর দিয়ে আসছে। দু’জনেই সাইকেলে। কী বলছে, কী বলছে ওরা? শোনো, কান পাতো। শুনতে পাবে কী বলছে। মেয়েটি বলছে,

তুই জানিস তো, খোয়াইটা কার?

কার?

কার আবার? আমার। আমার।

পুরো খোয়াইটা?

পু-রো-টা। আচ্ছা তোকে অর্ধেকটা দিয়ে দিলাম।

ওই দ্যাখো ওরা খোয়াইতে ঢুকছে। মেয়েটি হু হু সাইকেল থামিয়ে চলে যাচ্ছে এক প্রান্তে। চেঁচিয়ে বলছে। এ-ই যে। এতটা পর্যন্ত তোকে দিলাম। তুই কী দিবি আমায়। কী-ই-ই —দি-বি-ই?...’’ একে একে ছেলেটা সব দেয়। ক্যানেলের ধার দেয়। বয়ে যাওয়া জল দেয়। সোনাঝুরির সব পাতা, রামকিঙ্কর... সব! চেয়ে থাকে ইমনে তারা ফোটা সন্ধের আকাশের দিকে।

শৈশবের বিক্রম

‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’

প্রথম বই বেরিয়ে গিয়েছে সেই কবে, স্কুলবেলায়। বন্ধুদের স্মৃতিতে এখনও তার সাদামাঠা মলাট। নাকি একটু খয়েরি রংও যেন!

এ বার দ্বিতীয়। বই বের হল ১৯৯৮-এর কলকাতা বইমেলায়। শান্তিনিকেতনে ফলপট্টির সুবোধের দোকানের সামনে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আজ সাইকেল নয়।

বাবার স্কুটার।

কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করে বন্ধু-দম্পতি মানব আর মৌকে বই উপহার দিয়ে লিখে দিচ্ছে দু’ পঙ্‌ক্তি। ‘‘যতটা বিপন্ন ভাবো, ততদূর ছড়াব দু-হাত/ ব্যথার ভিতরে গান ছুঁয়ে গেছে অলীক প্রপাত।’’

অপলক বন্ধু-যুগল!

বিক্রমের নতুন বই, ‘ছাতিমকে লেখা চিঠি।’ পাতায় পাতায় সে-ই গাছপালা-লতাপাতার ইমেজ। যার জন্য বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত ‘ভেষজ কবি।’ আশ্চর্য! নামকবিতায় শক্তির কবিতার ক্লাসের অনুরণন।

‘‘অন্ধমুখে বাতাস রাখো/ শীতল বুকে ছই/ আগুন যদি জ্বলে, জ্বলুক/ পাতার ফাঁকে সই...!’’

‘আরো আঘাত সইবে আমার’

রাস্তার ধারে ছোট গুমটিতে চা খাচ্ছে বিক্রম। ও যেমন খায়। চা ঠান্ডা হয়ে গেল। জুড়িয়ে জল!

কী যেন ভাবছে।

ঠিক পাশেই বসে পাঠভবনের স্বজন কুন্তল আর সঙ্গীতভবনের প্রিয়াঙ্কা। ওঁরা এখন যুগল। মুম্বই থেকে বলছিলেন দু’জন। ‘‘দেখতাম সর্বক্ষণ একজন মানুষ গানের ভিতর বেঁচে আছে। সঙ্গীতভবন ফিরিয়ে দেওয়ার পরে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল ও!’’ আকাশের দিকে চেয়ে আছে।

উদাস। ও যেমন চায়।

আজকাল একটু বিরক্তও। বদলে যাওয়া শান্তিনিকেতন কেমন যেন ঠেকছে ওর কাছে। আসলে ও ছিল বক্তা।

ইদানীং কবিতার মধ্যে ঘুরতে থাকে কেবল‌ দূরে যাওয়ার কথা।

‘‘যদি দূরে কোথাও দূরে সরে যাই।’ কখনও স্বপ্নের চান্দ্রপথে হাঁটে ছায়া। ‘‘আজকাল/ ঘুমের ভিতরে লণ্ঠন হাতে কারা যেন/ চাঁদের মোরাম ভেঙে হেঁটে যায়—/ দক্ষিণ গোলার্ধের গায়ে ছায়া পড়ে...।’’

বিরক্তির কথা ভাইকে জানিয়েছিল। ‘‘দাদা অপমানিত বোধ করত। সঙ্গীতভবনের ইন্টারভিউতে বাজে ভাবে ‘হ্যারাস’ করা হয়েছে ওকে। সেই সময় যিনি উপাচার্য ছিলেন, দাদাকে বলেছিলেন, ‘আপনি আবার কি ক্লাসিক্যাল গাইবেন, আপনার বাবা তো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।’ কে না জানে আমাদের বাবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লোক। তা’ও এ সব শুনতে হল! এর পরে ২০০৫-এ মা চলে যাওয়ার পরে খুব একা হয়ে গিয়েছিল দাদা! কেউ আর মায়ের জায়গাটা পূরণ করতে পারেননি। আমার স্ত্রী দূর্বা দাদাকে খুব আগলে রাখত, যাতে কষ্ট না পায়। কিন্তু মৃত্যুশোক ভোলেনি দাদা!’’

একা! একাই ঘুরছে সে।

একা একা গিয়ে বসে রয়েছে চাঁদের শ্মশানে। সোনাঝুরি বনে হহু হাওয়ায় ওর চুলগুলো কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে। দূরে, অনতিদূরে কোপাই নদীর মাথায় ঘোলাটে মেঘের দিকে চেয়ে ওর খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে।

বিক্রম একা একা গিয়ে শ্মশানে বসে আছে, খবর পেতেন মোহন। ‘‘নভেম্বরের ৭ তারিখ ওদের মা চলে গেল। পিঙ্কু খুব কষ্ট পেয়েছিল। ওর নিজের চলে যাওয়া হয়তো সেই শোকেই! খবর পেতাম, বহুদিন চাঁদের শ্মশানে গিয়ে ও একা বসে থাকত!’’

‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’

বিক্রম তখন একত্রিশের কোঠায়।

তত দিনে জামসেদপুরের মনখারাপ ওর ‘চোখের জলে লাগল জোয়ার’ শুনে, কলকাতায় ওর শ্রোতারা কাঁদছে ‘তবু মনে রেখো’-র উজাড় মর্মশোকে। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অনুরোধ আসছে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ কিংবা ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই’ শুনতে চেয়ে। কত ছবি সেই সব অনুষ্ঠানের!

খেয়ালের তিনটে সিডি আর রবীন্দ্রনাথের গানের চারটে সিডি রাখা বই-খাতার মাঝে। যেমন রেখে গেছে, ঠিক তেমনটি। ঘর ভর্তি। ছবি। বই।

বইয়ের আড়ালে বই, ছবির আড়ালে ছবি। তানপুরা। ও পাশে রং-তুলি, এ পাশে মোমদান। কোলাজের কাগজ।

কত কাল যে রং লাগানো হয়নি তুলিগুলোয়! শুকিয়ে কাঠ!

শুকিয়ে গিয়েছে ইজেলের তেল রং!

কোথায় যে গেল, এ ঘরে রাতভর দুই ভাইয়ে শোনা মল্লিকার্জুন মনসুর কিংবা ভীমসেন যোশী বা শুধুই ওঁর গুরু উলহাস কসলকর!

সে বার বিক্রম একা ছিল শান্তিনিকেতনে। অসমে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মোহন সিংহ। সঙ্গে আবীর ও তাঁর স্ত্রী দূর্বা।

হঠাৎ কার যেন টেলিফোন, বিক্রম অসুস্থ!...বাঁ পাটা দুর্বল হয়ে গেছে!... ও আর হাঁটতে পারছে না কিছুতেই!

কলকাতায় প্রায় পনেরো দিন ধরে চিকিৎসা চলল। ডাক্তাররা বললেন, ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। সে’ও শুরু হল।

একটু যেন সুস্থ বিক্রম।

রোগশয্যায় বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে থাকে তখন সে। চোখ দু’টোয় অপার ক্লান্তি যেন। ভিজে যায় চোখের পাতা। কোন সে সুদূর থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে যেন।

‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন/ কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই—/ দেখ্‌ রে চেয়ে আপন-পানে/ পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই।/ ফিরছে কেঁদে প্রভাত-বাতাস,/ আলোক যে তার ম্লান হতাশ, / মুখে চেয়ে আকাশ তোরে/ শুধায় আজি নীরবে তাই।’

ডাক্তাররা তো বলেছিলেন ছেড়ে দেবেন। শান্তিনিকেতন ফিরবে বিক্রম। ভালো হয়ে গেছে ও!

কিন্তু কী যে হল... যে দিন ফেরার কথা, সেদিনই...!

সেদিন ১৪ মার্চ!

দুঃসংবাদ ছড়াল কাল বসন্তের হাওয়ায়! বিক্রম নেই! এই তো ছিল! নেই! এই তো সেদিন গাইল, ‘আরো আঘাত সইবে আমার’, বন্ধুসভায় গাইল, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়!’ এই তো সে দিন... সেদিনই... কোথায় গেল ওর বইটা! দোলের দিন একসঙ্গে তোলা ছবিগুলো! কলাভবনের চাতালে গজল আর রবিঠাকুরের গানের একক অনুষ্ঠানের রেকডিং সিডিটা... কালোর দোকানে বসেছিল না ছেলেটা! হাঁটছিল, নাকি সাইকেল? সঙ্গে ছিল কেউ!

ঋণ: ছাতিমকে লেখা চিঠি (বিক্রম সিংহ), জলঝারি (জয় গোস্বামী), সজন (সম্পাদনা বিক্রম সিংহ), এস্রাজের রণধীর এবং ‘দেশ’ পত্রিকা

অনুচিত্রণ: অর্ণব ঘোষাল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement