চিত্রণ: শেখর রায়
সেই ব্রজমোহন বিদ্যালয়, যা ছিল তাঁর ইস্কুলবাড়ি, হুবহু একই রকম আছে!
বিএম কলেজে পড়িয়ে পিছনের পশ্চিম বগুড়ার যে সড়ক ধরে তিনি ফিরতেন ঘরে, তাও শুয়ে আছে মরা ময়ালের মতো!
বসত বাড়ির চেহারাটা গেছে বদলে। সদরের দ্বারটুকুই যা দাঁড়িয়ে তাঁর জ্বলজ্বলে স্মৃতিফলক বুকে করে।
লাশকাটা ঘরটা যেন কোন দিকে?
মন্তাজ মিঞার আস্তাবল?
কিংবা সেই মাঠ, আলো আঁধারির জ্যোৎস্নারাতে যেখানে ঘাস খেয়ে বেড়াত মিঞার ঘোড়ারা?
ধানসিড়িটির তীরে জীবনানন্দ দাশ যেন আজও বেঁচে আছেন তার হাওয়াবাতাসে।
রূপসী বাংলা ঠিক কেমন রূপসী?
যদি রূপসী বাংলা বলতে বোঝেন ধানসিড়ি, ধলেশ্বরী, কীর্তনখোলা, পায়রা, সন্ধ্যা নামের অপরূপ সব নদী জড়ানো বরিশাল, তা হলে মানতেই হবে সে-রূপসী ভাষায় ধরা দেয় না।
ছবিতে হয়তো কিছু বলে।
কবির বসতবাড়ির প্রবেশ-পথ
ধরা দেয়, ধরা যায়, শুধু জীবনানন্দের কবিতায়।
রূপসী বাংলা পূর্ণত জীবনানন্দ প্রদেশ!
কে জানে, হয়তো সেটাই সত্যি, যেটা কবি ভাবতেন— বাংলার যে-মুখ দেখলে পৃথিবীর রূপ আর খুঁজতে যাওয়ার টান থাকে না।
ধানসি়ড়ির পাশে এসে দাঁড়ালে কবির মরণোত্তর প্রকাশিত গোটা ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি মগজে এসে ভর করে।
আশপাশের গোটা প্রকৃতি এবং ৬১টি কবিতায় ভরানো বইটি একে অন্যের আয়নাচিত্র।
মনে পড়ে, এখানে কোথাও এসে শুয়ে পড়ে মরে যাওয়ার কী বাসনাই না ছিল কবির!
শেষ বারের মতো বরিশাল ছেড়ে কলকাতা যাবার পর ফিরে আসা হচ্ছিল না।
তার মধ্যে দেশভাগ হয়ে গেল।
ক্রমাগত চাকরি বদল আর বাসা বদলের ফাঁকে ১৯৫৩-র এপ্রিলে রংপুরে কায়সুল হক’কে লেখেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তান আমার জন্মস্থান, সেখানে যেতে আমি অনেক দিন থেকেই ব্যাকুল, কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে জোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।’’
এর বছর খানেক আগে, ১৯৫২-য়, জলপাইগুড়িবাসী ভক্ত সুরজিৎ দাশগুপ্তকে তাঁর আমন্ত্রণের উত্তরে লেখেন, ‘‘জলপাইগুড়ি ও ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জঙ্গল— বেশ দেখার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার যেতে খুব ইচ্ছে করে।’’
কিন্তু চার মাস পরেই লিখলেন, ‘‘এখন যাবার কোনও সম্ভাবনা নেই। পরে কখনও যাবার চেষ্টা করব।’’
বরিশাল বা জলপাইগুড়ি কোথাওই যাওয়া হয়নি কবির। কিছুকাল পরে ট্রাম দুর্ঘটনায় পড়ে, ২২ অক্টোবর ১৯৫৪, তো পরপারেই চলে গেলেন।
দিনে দিনে, এত দিনে, তাঁর প্রিয় ধানসিড়ি ক্ষয়ে ক্ষয়ে অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু সুগন্ধা নামের তুলনায় বড় নদীর থেকে বাঁক নিয়ে ভেতরে ঢুকে এখনও যে চেহারায় ধানসিড়ি বইছে, তা চাক্ষুষ করলে বোঝা যায় কেন এর বিশীর্ণ বটের নীচে শোওয়ার এত আকাঙ্ক্ষা ছিল ওঁর।
কবিতায় আঁকা ওঁর সেই কল্পনার দৃশ্য ভোলা যাবে কখনও? ...
‘‘বাঁকা চাঁদ জেগে রবে— নদীটির জল/ বাঙালি মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে/ আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে...’’
এই হলুদ বাড়ির অদূরেই মাঠের কোনায় ছিল লাশকাটা ঘর
তার পরের দৃশ্য আরও সুন্দর, ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর। কবি দেখবেন—
‘‘দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছে চিতা: বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ/চেয়ে রবে;’’
আমরা জনা কয় যখন সুগন্ধার ঘাটে বসে স্থানীয় বাউল কবির গান শুনছি তখন হঠাৎই শেষ জ্যৈষ্ঠেই অবিরত মেঘ জমে শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ ঘনাল যেন!
তখন কার না মনে হবে ১৯৩৪-এ ‘রূপসী বাংলা’-র কবিতা সব লেখা হয়ে যাবার পর আমৃত্যু কবি তা প্রকাশ হতে দিলেন না কেন?
বেশ কষ্ট হচ্ছিল ভেবে যে, জীবনানন্দের এই সব কবিতা রবীন্দ্রনাথ পড়ে যেতে পারেননি।
বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কবির যে-কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ পত্রে (৩ অক্টোবর, ১৯৩৫) মন্তব্য লিখলেন, ‘‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে,’’ তাতে বাংলার মুখ তো আছেই, সঙ্গে কবির স্বভাব মৃত্যুভাবনা।
প্রশ্ন করছেন, ‘‘আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,...’’ আর সেই কবিতার নাম? ‘মৃত্যুর আগে’!
তবে অপরূপ স্ফূর্তির কারণ এও যে ওই ১৯৩৫-এই ‘কবিতা’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হল কবির বহু বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’, যাকে কবিতা জগতের ‘মোনা লিসা’ বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। এ বার তা হলে গল্পে যাই...
জীবনানন্দের গুণগ্রাহী ও জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় (ইনি সুচিত্রা সেনের জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় নন) তাঁর ‘জীবনানন্দ’ বইয়ে লিখছেন: ‘‘এক দিন সকালে গেছি। গেলে ঘরে বসিয়ে বললেন— আমার ‘বনলতা সেন’ কবিতার বইটা সিগনেট প্রেস বার করেছে।— এই বলে তিনি আমার হাতে একখানা ‘বনলতা সেন’ দিয়ে বললেন— কাগজ, ছাপা, বাঁধাই সবই ভাল, কিন্তু কভারের ছবিটা আমার আদৌ পছন্দ হয়নি।
ধলেশ্বরী
আমি বইটা খুলে দেখছি। সেই সময় তিনি আর একটা ‘বনলতা সেন’ নিয়ে তাতে আমার নাম লিখে আমার হাতে দিলেন।
আমি বইটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— দাদা, বনলতা সেন কে? আপনি তো লিখেছেন— ‘নাটোরের বনলতা সেন’। এই নামে সত্যিই আপনার পরিচিতা কেউ ছিল নাকি?
আমার কথা শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন। কোনও কথা বললেন না।’’
বছর তিনেক আগে নাটোর নগরীতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কোটি বাঙালির এই এক প্রশ্ন মনের মধ্যে ওঠানামা করছিল।
বনলতা সেন সত্যিই কি কেউ? আর কবির নিজের বরিশাল থাকতে সে নাটোরেরই বা কেন?
নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয়। যখন মাত্র বাইশ-চব্বিশ মাইল দূরের পাবনা শহর আরেক কুহকিনী সেন উপহার দিয়েছে বাঙালিকে।
সুচিত্রা সেন।
তবে বনলতা বনলতা।
বরিশালের ধানসিড়ি, ধলেশ্বরী বা সন্ধ্যার পাশে দাঁড়ালে কৌতূহল হয় এমন সব নদীর বেষ্টনী থেকে নাটোরের মতো নিতান্ত সাদামাটা নগর কী করে তাকে হাতিয়ে নেয়। এবং এমন ভাবে, যে পৃথিবীর যেখানেই বাংলা কবিতা পড়া হয় সেখানেই এই নারী ও নগরীর নাম একই নিশ্বাসে এসে যায়।
আমরা ফের ফিরে যাব জীবনানন্দের নিজস্ব বাংলায়।
বয়ে চলে ধানসিড়ি
থুড়ি, বরিশালে।
বরিশালে যে-ইস্কুলে পড়েছিলেন জীবনানন্দ সেই ব্রজমোহন বিদ্যালয় আজও প্রায় সেই চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে।
রমজানের ছুটি লেগেছে, তাই ক্লাস বন্ধ। উঁকি দিয়ে দেখা গেল বেঞ্চির উপর বেঞ্চি চাপিয়ে ক্লাসঘরে দোর দেওয়া হয়েছে।
আমার পাশ থেকে বরিশালের বাঙালি খ্রিষ্টান কবি ও সমালোচক হেনরি বললেন, ‘‘দাদা, এই যা দ্যাখসেন, কবির শিশুকালে এমনই ছিল।’’
এই বলে হেনরি আমাদের নিয়ে গেলেন ইস্কুলের গায়ে ছেলেদের খেলার মাঠে।
আঙুল তুলে দেখালেন ক্যাম্পাসের পাঁচিলের একটা অংশ।
বললেন, ‘‘ওইখানেই ছিল সেই লাশকাটা ঘর। অল্প বয়েসে আমিও দেখেছি। এখন উঠে মেডিকাল কলেজে গেছে।’’
আমার মনে পড়ল কবির ছাত্র ও ভক্ত অরবিন্দ গুহ’র স্মৃতিচারণায় ওই লাশকাটা ঘর।
লিখেছিলেন—
‘‘আমি গোলকিপার। গোলের ধারেকাছে বল না এলে আমার খেলা ত্রুটিহীন। কিন্তু বল এলে আমি আর গোলের ধারেকাছে থাকি না, পাশের লাশকাটা ঘরের সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়ি, নির্বিবাদে গোল হয়ে যায়।...
ফাঁকা মাঠের মধ্যে কখনো-কখনো এমন বৃষ্টি নামত যে খেলা বন্ধ হয়ে যেত, সকলের সঙ্গে আমিও বহুদিন লাশকাটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। টেবিলে বহু লাশ দেখেছি।
ওই লাশকাটা ঘর থেকে জীবনানন্দ দাশের বাড়ি খুব দূরে নয়।
বহুকাল পরে জীবনানন্দের একটি বিখ্যাত কবিতায় পড়েছি যে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেছে এবং অতঃপর— লাশকাটা ঘরে চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।’’
লাশকাটা ঘর দেখা হল না ঠিকই, কিন্তু হেনরি আমাদের নিয়ে দাঁড় করালেন এক অদ্ভুতদর্শন টিনের চালের বাড়ির সামনে, আর বললেন, ‘‘এই যে এটা দেখছেন, সেই লাশকাটা ঘর ছিল অবিকল এমনই দেখতে। কোনও ফারাকই নেই, ওখানে লাশ থাকত, এখানে জ্যান্ত মানুষ।’’
লাশকাটা ঘর সদৃশ এই টিনের বাড়ি কোথায়? না, ব্রজমোহন ইস্কুল নয়, ব্রজমোহন কলেজের খেলার মাঠের ধারে! যে-ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দ পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন। যেখানে মাঠের ধারে এখন দাঁড়িয়ে এক প্রেক্ষাগৃহ, নাম জীবনানন্দ সভাঘর। প্রবেশদ্বারে কবির এক রঙিন প্রতিকৃতিও।
দেখা হল সেই ক্লাসরুমও যেখানে পড়িয়েছেন কবি। তার পর কলেজের পিছনের গেট দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে যেতে বললেন হেনরি, ‘‘জানেন নিশ্চয়ই যে, জীবনানন্দের কলেজে ঢোকা, বেরুনো সবই এই পিছনের দ্বার দিয়ে, লোকের চোখ এড়িয়ে, নির্জনে।’’
ও ভাবেই পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির পথে বগুড়া পশ্চিম সড়ক ধরতেন। যে-লম্বা রাস্তার নামকরণ হয়েছে জীবনানন্দ সড়ক। ‘‘কিন্তু দুঃখের বিষয়,’’ হেনরি বললেন, ‘‘কিছু বাড়ির নেমপ্লেট বা হোর্ডিং ছাড়া নতুন নামটা ছড়ানো যায়নি। তবে চেষ্টা ছাড়িনি।’’
ইস্কুল থেকে কলেজে আসার পথে একটা জমি পড়ে যেথানে মন্তাজ মিঞার আস্তাবল ছিল।
কীর্তনখোলা। এরই পারে দাঁড়িয়ে কবি দেখতেন জাহাজ পারাপার
পূর্ণিমার রাতে অরবিন্দ গুহ একাধিকবার দেখেছেন মাঠ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায় আর মিঞার ঘোড়ারা সেই আলো-অন্ধকারে ঘাস খাচ্ছে।
সে-দৃশ্য দেখেছেন হেনরিও এবং মনে করেন ওই ছবিই ফিরে এসেছে ‘ঘোড়া’ নামের কবিতার বিখ্যাত পঙ্ক্তিতে— ‘‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।’’
কলেজ ঘুরে গিয়েছিলাম বগুড়া রোডের এক বাঁকা চাঁদের মতো রাস্তার বাঁকে কবির বসতবাড়িতে।
রাস্তার ওপরে ছোট লোহার গেট। পাশে দেওয়ালে বাড়ির ঠিকানা ও নাম— ধানসিড়ি।
ধানসিড়ি নামটা অনেক পরে রাখা, সাবেক নাম ছিল সর্বানন্দ ভবন।
আমরা ঢুকছি দেখেই এক বৃদ্ধ মুসলমান পড়শি পাশে এসে বললেন, ‘‘কবির বাড়ি দেখন লগে আইছেন তো? দ্যাখেন, দ্যাখেন। তবে বাড়ির সে-চিহারা বদল গেছে গিয়া।’’
এ-অবধি ঠিকই ছিল, হঠাৎ বৃদ্ধ চমকে দিয়ে বললেন, ‘‘কেমন ছেলো জানবার পাইবেন ক্লিন্টন সাহেব আর মান্নান সাহেবের কেতাবে। পইড়্যা দ্যাখেন।’’
বুঝলাম ক্লিন্টন সাহেব বলতে কবির জীবনীকার ক্লিন্টন বি সিলি আর মান্নান সাহেব বলতে আব্দুল সৈয়দ মান্নানের কথা বলছেন ভদ্রলোক।
আমরা যখন টিনের ছাউনির বাড়িটা দেখছি, তিনি ফের বললেন, ‘‘বাড়ির সে-শোভা কি আর আছে? সামনে, পিছনে ধু-ধু সবুজ, কবি শুনসি উই ঘরে বইয়া ভাবতেন, ল্যাখতেন। তহন এহানে টিন কুথায়, ঘর ছেলো গোলপাতার ছাওনের।’’
সত্যিই তো, নিজের যে-স্বপ্নের আস্তানায় ফিরে এসে আরামের শ্বাস ফেলতেন, কবিতায় বসতেন, তখন সে-ঘরের অনেকটাই ছিল মাটির, আর তার ছাউনি ছিল খড়ের নয়, গোলপাতার।
সে-বর্ণনাও তিনি নিজেই রেখে গেছেন এ ভাবে—
‘‘গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়/উড়ে যায়— মিশে যায় আম বনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে চায় যে জড়াতে/ করবীর কচি ডাল চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়;’’
এ লেখা এ ঘরে বসেই লেখা ১৯৩২-এ।
এখন নতুন রংচং হয়ে নতুন মালিকের আসবাবে ভরানো। আসল বাড়ির সত্যিকারের অবশিষ্ট বলতে দু’খানা কংক্রিটের থাম। নিত্য আনাগোনা করা কবির ভক্তদের দেখানোর জন্য রাখা।
কবির বাড়ির পিছনের আদি আমবাগানটি উধাও। সেখানে মাথা তুলেছে মস্ত বহুতল। আর দুটো দরজা পর ওঁরই নামে এক অতি রম্য চেহারার পাঠাগার।
ধানসিড়ি বাড়ির বাগানের সব গাছই নতুন। এক মস্তকায় কাঁঠাল ঝুলছে এক গাছ থেকে, নতুন বাসিন্দারা খুব সোহাগ করে দেখালেন। কিন্তু আমার মন খুঁজছিল কবির সোহাগের গোলাপ গাছ, যার গোড়ায় জল দেওয়া ছিল তাঁর এক অতি প্রিয় কাজ। বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলার মতো।
বলা বাহুল্য, নেই।
সেই জাহাজ, যা ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে বরিশাল আসে
কবে থেকেই নেই।
আমরা বগুড়া, থুড়ি, জীবনানন্দ সড়ক ধরে কবির প্রিয় বেড়াবার চত্বর কীর্তনখোলার পাড়ে গিয়ে উঠলাম। তখন সূর্য ডোবে-ডোবে।
আহা, কী রূপ আকাশ ও নদীর!
রোদ পড়ে গিয়ে জলে নীল রং ধরেছে, আকাশের একটা ধার কমলা।
বেশ কিছু বজরা ও স্টিমার চরছে। মনে আসবেই কবির নিজের করা বর্ণনা— ‘‘বরিশাল শহরটি দেখতে অতি সুন্দর। সামনে দিয়ে একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীটি তেমন বড় নয়। নদীর ঘাটে অনেকগুলি বজরা ও নৌকা বাঁধা থাকে। আর এখন তো রোজই আমাদের স্টিমার যাতায়াত করছে।’’
এই যে রোজকার স্টিমারের কথা বলছেন কবি, তা এখনও নিত্য ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে ফি-সন্ধে এসে নোঙর করে বরিশালে।
আমরা আসার একটু আগেই সে বয়ে গেছে কীর্তনখোলা দিয়ে।
কিন্তু আমরা তাকে ছাড়তে চাইনি।
শোনা গেছিল, সকাল সাতটায় সে বরিশাল ছাড়বে। তাই আমাদের হোটেলের অদূরে বরিশাল নদী বন্দরে গিয়ে তাকে ধরা হল।
ঠিক যেমন একটা মস্ত চাকা-জোড়া পোত কবি দেখতেন আশি-পঁচাশি বছর আগে, তেমনই এক জাহাজ।
বিশালকায়। হলুদবরণ। চাকা ঘুরিয়ে জল কেটে এগোচ্ছে।
ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের ক্লাসঘর
মনে পড়ল এমনই এক স্টিমার পরিচালক মাইক নেওয়েল ব্যবহার করেছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাস নিয়ে গড়া ওঁর চলচ্চিত্রে। বৃদ্ধ বয়েসে ফিরে পাওয়া প্রেমের এক অনুপম যোগ সে-জাহাজযাত্রায়।
আমার মনে পড়ল একটু আগে ছেড়ে আসা কবির গোলপাতার ঘরের পরিবেশ। বিয়ের পর সেখানে স্ত্রী লাবণ্যকে নিয়ে তোলার আগে ঢাকায় তাঁদের ফুলশয্যার রাত।
কবির জীবনীকার প্রভাতকুমার দাস এক সুন্দর বর্ণনা রেখেছেন সে-রাতের।—
‘‘(কবি) আগেই শুনেছিলেন লাবণ্য গান গাইতে পারেন, ফুলশয্যার রাতে তিনি ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ গানটি পর পর দু-বার শুনতে চেয়েছিলেন। অনেক দিন পরে তিনি কেন এ গান প্রথম দিনেই শুনতে চেয়েছিলেন, লাবণ্য তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পূর্বে জীবনানন্দ তাঁকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন লাইন দুটির অর্থ:
‘আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া/তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া।’
লাবণ্য উত্তর দিতে পারেননি, তারপর আস্তে আস্তে, তিনিই বলেছিলেন: ‘জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।’’’
•
বগুড়া রোড জীবনানন্দ সড়ক হওয়ার পরও পুরনো নামে চলে দেখে আহত হয়েছিলাম ঠিকই, তবু বরিশাল আজও তার মহাকবির সংসর্গ উদ্যাপন করে তা দেখে আপ্লুত হয়েছি।
তার এক চমৎকার নমুনা দেখেছি আমাদেরই তারকাখচিত হোটেলে। বলি—
হোটেলটা মাস ছ’-আট হল খুলেছে। বাগান, পুকুর ঘেরা, ঝাঁ চকচকে, আধুনিক স্থাপত্যে গড়া। কিন্তু রিসেপশনে গিয়ে রেজিস্টারে নাম তুলব কী, লাউঞ্জের একটা দেওয়াল দেখেই তো থ’!
চাপা নরম ধূসর দেওয়াল জুড়ে জীবনানন্দের হস্তাক্ষরে তাঁর ‘বনলতা সেন’ ও ‘রূপসী বাংলা’র একটি কবিতা আশি পয়েন্ট অক্ষরে উৎকীর্ণ।
রিসেপশনিস্ট ডাকছেন— ‘স্যার, স্যার’ করে।
এক ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে ওয়েলকাম ড্রিংক নিয়ে। কিন্তু আমরা স্তম্ভিত চোখে দেখছি কবির লাইন—
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,’
কিংবা, ‘তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
বা, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে— এই বাংলায়’
এতটুকু রং না চাপিয়েই বলছি ঢাকার সদরঘাট থেকে স্পিডবোটে পাঁচ ঘণ্টা ঘরে বরিশাল আসতে আসতে ক্রমান্বয়ে মনে হয়েছে এই যাত্রা আমার প্রথম বরিশাল যাত্রা নয়। চাঁদপুর পেরোতেই যে-পদ্মা দু’ধারে ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিগন্তে মিশে গেল এ আমি বাল্য থেকে বাউলে বাউলে শুনে শুনে দেখে এসেছি। ‘পদ্মার ঢেউ রে’র সেই ডাক তো বড়ে গুলাম আলির ‘আয়ে না বালম’ কান্নার মতো মনে-মরমে মিশে আছে।
বরিশালের গায়ে পদ্মায় সূর্যাস্ত। রূপসী বাংলা-র শুরু এখানেই
ব্রজমোহন বিদ্যালয়
•
সেই জাহাজ, যা ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে বরিশাল আসেবরিশালের গায়ে পদ্মায় সূর্যাস্ত। রূপসী বাংলা-র শুরু এখানেই
বরিশাল এতটাই নদীমোড়া আর বনজোড়া যে এই জেলায় রেলের লাইন পাতা যায়নি।
পদ্মা দিয়ে যেতে যেতে এত স্টিমার, লঞ্চ, বজরা, নৌকো, ডিঙ্গি, ছিপ, বালাম (যাতে পরিবহন হয় বলে চালের নামই হয়ে গেল বালাম চাল), জেলে নৌকো, ট্রলার আমি জীবনে দেখিনি।
দক্ষিণ ফ্রান্সের কান, নিস বন্দরে ডক করা পাখির ঝাঁকের মতো যে ইয়ট, তাও নগণ্য হয়ে পড়ে এই তরণীমেলার কাছে।
আর যত কাছাকাছি হই কবির রূপসী বাংলার, কেন জানি না ওঁর মৃত্যুর কিছু দিন আগে, ১৯৫৪-র মে-জুন মাসে, লেখা একটা কবিতা ঘুরপাক খায় মনে।
এও বুঝি না যে, বেদনায় আচ্ছন্ন ওঁর কাব্যসমগ্রে এ কবিতা এত বেশি করুণ হয়ে ওঠে কেন!
ব্রজমোহন কলেজ
একটা সময় একটা যুক্তিও তৈরি হয়; বলি—
নদীর ধার বেয়ে বনভূমি গড়ে উঠতে দেখে কবিতাটির শেষ পঙক্তিটা ফিরে এল অ্যালবামের ছবির মতো— ‘‘অন্তহীন হরিতের মর্মরিত লাবণ্যসাগর।’’
আলাদা করেই লাইনটা মনে ছিল, কিন্তু এর অপরূপ দৃশ্যগুণ ও বাস্তবতা চাক্ষুষ করলাম সে দিন, তাতে একটা ভাবনাও এল— আত্মজীবনী লিখব-লিখব করেও কবি শেষ অবধি তা লেখেননি।
ভাই অশোকানন্দকে বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনী তো ঘটনাবহুল হবে না।’’
অর্থাৎ ওঁর গল্প-উপন্যাসের মতো তারাও যে পাঠক কুড়োতে পারবে তার নিশ্চয়তা কই?
বরিশালের নদী-বন ঘুরে ক্রমে এই ধারণাই বদ্ধ হল যে, ‘রূপসী বাংলা’-ই ওঁর আত্মজীবনী। যা তিনি প্রকাশ করে গেলেন না।
জেমস জয়েসের (জীবননান্দের প্রিয় লেখকও) ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসকে যেমন ডাবলিনের স্ট্রিট ডিরেক্টরি হিসেবে পড়া যায়, ‘রূপসী বাংলা’-ও তেমনই কাজে আসে বরিশালের অ্যালবাম হিসেবে।
আমরা বরিশাল পাড়ি দেবার তিন দিন আগে এক মস্ত ঝড় তোলপাড় করে গেছে গোটা জেলাটাকে। তাই একটু-আধটু কাঁপুনি তো ছিলই ভেতরে।
সেটা বাড়ল যখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি আর ঝড় মাঝদরিয়ায়।
অপার জল আর ঢেউয়ে ভাসতে দেখলাম গুটি কয়েক জেলে নৌকো। তাদেরও কয়েকটিতে মাঝি কেবল একজনা।
মনে আসবেই তখন সেই গানের কলি ‘অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে।’
সঙ্গে বাস্তব হয়ে ফুটে উঠল কবির জীবনের শেষ ক’টি কবিতার ওই একটি— যা শুরু হচ্ছে:
‘‘দু’দিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ/ মাঝখানে আজ এই সময়ের ক্ষণিকের আলো/যে নারীর মতো এই পৃথিবীতে কোনোদিন কেউ/নেই আর— সে এসে মনকে রৌদ্রনীল শ্যামলে ছড়ালো।’’
সামনে পদ্মার ঝ়ড়।
স্টিমারে বসে পাতা উল্টিয়ে এসবই পড়ছি।
হঠাৎ আপন খেয়ালে ঝড় থেমে রৌদ্রনীল শ্যামলে ছড়াল।
বুঝলাম রূপসী বাংলাও কবির পাতা আইন মেনে চলে, ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘বনলতা সেন’-কে কোথায় যেন মিলিয়ে দেয়!
ছবি: লেখক