অন্ধকারকে ভয় কী!

বাচ্চার ফোবিয়া বিভিন্ন জিনিস থেকে তৈরি হতে পারে। কিছু ফোবিয়া সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কিছু আবার অনেক দিন পিছু ছাড়ে না। কী ভাবে সামলাবেন, রইল পরামর্শবাচ্চার ফোবিয়া বিভিন্ন জিনিস থেকে তৈরি হতে পারে। কিছু ফোবিয়া সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কিছু আবার অনেক দিন পিছু ছাড়ে না। কী ভাবে সামলাবেন, রইল পরামর্শ

Advertisement

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০৯:০০
Share:

বিদেশ থেকে বড়মাসি এসেছে খুশির। সঙ্গে এনেছে ঢাউস পুতুল। কিন্তু পুতুল হাতে নিতেই চোখমুখ বদলে গেল একরত্তি মেয়েটার। প্রচণ্ড আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল যেন! বহু দিন লেগেছিল খুশির এই পুতুল আতঙ্ক কাটতে।

Advertisement

দু’বছরের সাম্য’র আবার রং দেখলেই কান্না। কিছুতেই রঙে হাত ছোঁয়াবে না। রঙের বাক্স বার করলেই আতঙ্কে কেমন যেন দিশেহারা হয়ে যায় সাম্য।

এগুলো নানা ধরনের ফোবিয়া। সাধারণ ভয় নয়, তার চেয়ে অনেকটা বেশি। ফোবিয়া নানা রকমের হতে পারে। কখনও অন্ধকার, কখনও একলা থাকা, অচেনা মানুষ... এর বাইরেও আছে। পুতুল, প্রজাপতি, মুখোশ, এমনকি নরম তুলতুলে সফ্‌ট টয়েও ফোবিয়া জন্মাতে পারে।

Advertisement

কেন ‘ফোবিয়া’

অনেক সময় এই ‘কেন’র উত্তরটা বাড়ির বড়দের কাছেই পাওয়া যায়। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, বেশির ভাগ ফোবিয়ার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বড়রাই কোনও একটা নির্দিষ্ট বিষয়কে ঘিরে আতঙ্ক পুরে দিয়েছেন শিশুটির মধ্যে। বাচ্চা যাতে পেডেস্টাল ফ্যানে হাত না দেয়, তার জন্য হয়তো বলা হয়েছে ওতে হাত দিলেই হাত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বা অন্ধকারে দুর্ঘটনা আটকাতে বলা হয়েছে, ওখানে ব্রহ্মদৈত্য আছে। ফলে, এক ধরনের আতঙ্ক ওদের মনে বাসা বাঁধে। অনেক সময় আবার বাচ্চা যে জিনিসে ইতিমধ্যেই ভয় পেয়ে বসে আছে, সেটার ভয় দেখিয়েই ওর অপ্রিয় কাজগুলো করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যেমন, খাওয়ার পর্বটা নির্বিঘ্নে মেটার জন্য ইঞ্জেকশনের ভয় দেখানো হয় অনেক সময়। ফলে, ভয় তো কমেই না। উল্টে সেটা আতঙ্কের পর্যায়ে চলে যায় এবং শরীরেও নানা প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সমস্যা আরও আছে। বাচ্চা যখন কোনও জিনিসে ভয় পেতে শুরু করেছে, তখন বড়রাই অনেক সময় ‘ভিতু কোথাকার’ বলে হাসাহাসি করেন। এই ধরনের ব্যঙ্গগুলো ফোবিয়ার পক্ষে আরও মারাত্মক। তখন তারা নিজেকে বেশি ভিতু, দুর্বল ভাবতে থাকে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

ফোবিয়া ম্যানেজমেন্ট

বাচ্চাকে সামলানোর কাজটা ভয় না-দেখিয়েও করা যায়। চেষ্টা করুন কেন বারণ করা হচ্ছে, সেই যুক্তিটা দিতে। ঘুরন্ত ফ্যানে আঙুল ঢোকাতে চাইলে বোঝান যে, এতে আঘাতটা ওরই লাগবে। আঙুল কেটে যাবে। একলা ঘরে দুষ্টুমি করলে ‘জুজু’র ভয় দেখানো নয়। বরং সকলের সঙ্গে মিশে খেলতে, একসঙ্গে খেতে উৎসাহ দিন। অনেক সময় মায়ের বলার ধরনেও বাচ্চা বারণটা বুঝে নেয়। ফোবিয়া তৈরির সম্ভাবনাও কমে। বাচ্চা কোনও বিষয়ে ভয় পাচ্ছে বুঝলে তাকে সামনে বসিয়ে বোঝানো উচিত।

এই দায়িত্ব তার ‘প্রাইমারি কেয়ারগিভার’, অর্থাৎ মা-বাবারই। তবে, তারও আগে ওর সেই ভয়ের জায়গাটাকে মানতে হবে। বলতে হবে, ‘বুঝতে পারছি, তুমি এটায় ভয় পাচ্ছ। তোমার কষ্টটা বুঝছি।’ এ বার জানতে হবে, ভয় পেলে ওর সেই সময় কী মনে হয়, কেমন অনুভূতি হতে থাকে। এতে বোঝা যায়, ওর মনে ভয়টা কত দূর গেড়ে বসেছে। পরের কাজ, বিভিন্ন ঘটনা, গল্পের মধ্য দিয়ে ওকে বোঝানো— ভয় থাকতেই পারে। তুমি একা ভয় পাও না, আমিও পেতে পারি। কিন্তু ভয়কে কাটিয়ে ফেলা যায়। চলো, দুজনে মিলে চেষ্টা করে কাটিয়ে ফেলি। এই ‘আমি আছি তোমার সঙ্গে’র আশ্বাসটুকুতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফোবিয়া কাটিয়ে ওঠা যায়। আসলে, ফোবিয়া কমবে কখন, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা হচ্ছে, তার উপর।

বিপদসংকেত

বাচ্চাদের মধ্যে অল্পবিস্তর ফোবিয়া থাকা অস্বাভাবিক নয়। সময়ের সঙ্গে নিজেই তা কেটে যায়। কিন্তু কখন বুঝব, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে? পায়েল ঘোষের মতে, সাধারণত দেড়-দু’বছর থেকে বাচ্চারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। এই সময় থেকে ক্লাস থ্রি-ফোর অবধি বাচ্চার মধ্যে ফোবিয়া থেকে যেতে পারে। কারও কারও আবার ফাইভ-সিক্স অবধিও সেই পর্ব চলতে পারে। কিন্তু টিনএজে পৌঁছনোর পরও কোনও একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আতঙ্ক না কমলে, সেটা চিন্তার। তখন কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও কান্নার সঙ্গে কাঁপুনি, ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠা বা বিড়বিড় করা, ঘন ঘন টয়লেট করে ফেলা, অত্যধিক ঘাম— এই লক্ষণগুলো দেখলে বুঝতে হবে ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে এবং সেই চাপের মোকাবিলা করার সময় হয়েছে। সাধারণত, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংটা তার বাবা-মা’কেই করা হয়, যাতে তাঁরা ঠিকমতো সামাল দিতে পারেন।

সতর্ক থাকুন

বাড়িতে কী কী জিনিস ও দেখছে, সেটা লক্ষ রাখুন। টেলিভিশনে বা মোবাইলে কোনও ভয়ের জিনিস দেখে থাকলে, ওর সামনে সেটা অন্যদের না দেখাই ভাল।

বাচ্চার দেখভালের জন্য যাঁকে রেখেছেন, অনেক সময়ই দেখা যায়, তিনিই কাজের সুবিধের জন্য বাচ্চাকে ভয় দেখাচ্ছেন। সে রকম কিছু বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিন।

বাড়ির বয়স্করাও অনেক সময় না-বুঝে বাচ্চাকে ভয় দেখিয়ে ফেলেন। ওঁদের বোঝান, আগের চেয়ে এই প্রজন্ম অনেক বেশি স্পর্শকাতর। ওরা এখন খুব একা। তাই আগেকার দিনে এক বাড়ি লোকের মধ্যে যে ভয় দেখিয়ে সহজে বাচ্চা সামলানো যেত, সেটা এখনকার দিনে করা যায় না।

প্রয়োজনে স্কুলে ক্লাসটিচারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারেন, ভয়ের গোড়াটা সেখানেই লুকিয়ে নেই তো!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement