আমার হাতের রান্না খুব ভালবাসতেন হেমন্তদা। যখন ইচ্ছে, চলে এসে বলতেন, ‘‘বেণু, কী আছে আজ?’’ কোনও ফর্ম্যালিটি ছিল না।
আমি তখন যোধপুর পার্কে থাকি। রাত প্রায় এগারোটার সময় চার-পাঁচ জনকে নিয়ে আমাদের বাড়ি হাজির। বললেন, ‘‘এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব খিদে পেয়েছে। তোর বাড়ি ঢুকে পড়লাম। জুটবে কিছু?’’ বললাম, ‘‘পাঁচ মিনিটে করে দিচ্ছি।’’ পড়িমড়ি করে চিকেনের কিছু একটা বানিয়ে দিয়েছিলাম। খুব তৃপ্তি করে খেলেন। আর সেই থেকে খাবারটার নাম দিলেন ‘পাঁচ মিনিটের চিকেন’। নিজেই রটিয়ে দিলেন সর্বত্র।
আরেক বার, আমরা তখন ময়রা স্ট্রিটে থাকি। এক দিন দেখা হতে আমাকে বলে উঠলেন, ‘‘দুনিয়ার লোক তোর রান্নার এত সুখ্যাতি করে, কিন্তু তুই তো আমাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াস না!’’ আমি হেসে ফেলে বললাম, ‘‘তোমাকে নেমন্তন্ন করতে হবে, তবে তুমি আসবে? ঠিক আছে, বলো কবে খাবে।’’ ধমকে উঠলেন, ‘‘আমি দিনক্ষণ বলে দেব, তবে তুই আমাকে খাওয়াবি?’’ তাড়াতাড়ি বললাম, ‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমিই দিন ঠিক করে তোমায় ডাকব।’’
তাই ডেকেছিলাম। বেলাবৌদিকে নিয়ে এসেছিলেন। ডিনার টেবিলে খেতে খেতে বলে উঠলেন, ‘‘শোনো উত্তম, তোমরা কিন্তু আমাদের নেমন্তন্ন করোনি, এই নেমন্তন্ন আমি যেচে নিয়েছি। কী রে বেণু, বলে দেব নাকি ব্যাপারটা?’’ বেলাবৌদি অবাক। উত্তম তো কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেই চলেছে। শেষে হেমন্তদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘থাক, থাক, এত যত্ন করে এমন রান্না করে খাওয়াচ্ছে, আর বকুনি খাওয়াতে চাই না।’’
সুপ্রিয়াদেবী
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
সে দিন দুপুর অবধি জানতাম না, ‘সপ্তপদী’-তে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ হেমন্তদার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে হবে। সবে খেয়ে উঠেছি, স্টুডিয়ো থেকে গাড়ি এসে হাজির। বলল, ‘‘এক্ষুনি যেতে হবে। হেমন্তদা ডেকেছেন।’’ তবে তো যেতেই হবে। গেলাম।
গিয়ে দেখি, মিউজিক-সেট একেবারে রেডি। মিউজিশিয়ানরা একদম তৈরি হয়ে বসে আছেন আমার জন্য। সাধারণত এ রকম হয় না।
হেমন্তদাকে বললাম, ‘‘দাদা, ভরা পেটে ওরকম ‘লা লা লা লা’ আর ‘তুমিই বলো তুমিই বলো’ আমার দ্বারা হবে না।’ হেমন্তদা ধমক দিলেন— ‘হবে না মানে? এমন ক্লাসিক্যাল বেস্ আর রাউন্ড ভয়েস তোর! তোর গলায় সবই উতরে যাবে। এখন শিগগির রিহার্সালে যা। এখনই রেকর্ড করা হবে।’’
বালসারাজি রিহার্সাল করিয়েই রেকর্ড করাতে ঢুকিয়ে দিলেন। হল রেকর্ড। পরে নানা জলসায় ওই ‘লা লা লা লা’ আর ‘তুমিই বলো’ করতে করতে অডিয়েন্সের চাহিদায় তিন মিনিটের গান প্রায় দশ-বারো মিনিট ধরে ডুয়েট গাইতে হয়েছে হেমন্তদার সঙ্গে।
তখন ইচ্ছে করছিল গলাটা টিপে দিই। ‘বালিকা বধূ’ তৈরির সময়ের কথা। আমরা তিন জেনারেশন, মানে, আমার দিদিমা, মা, আমি তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রচণ্ড ভক্ত। কিন্তু দেখিনি তার আগে।
ওঁকে প্রথম দেখি ‘বালিকা বধূ’র রিহার্সালের সেট-এ। ক্লাস ফাইভে পড়ি। শ্যুটিং চলছে। হঠাৎ রব উঠল, ‘‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছেন।’’ তনুকাকু (তরুণ মজুমদার) ছুটে গিয়ে ওঁকে নিয়ে এলেন। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘হেমন্তবাবু, এই দেখুন, বালিকা বধূ খুঁজে পেয়েছি।’’ উনি আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গমগমে গলায় বলে উঠলেন, ‘‘এ! এ পারবে? এ তো একেবারে বাচ্চা!’’ সেই মুহূর্তে আমার অমন ইচ্ছে হয়েছিল। পরে অবশ্য দারুণ ভালবেসে ফেললাম।
যে দিন ‘বালিকা বধূ’র রাশপ্রিন্ট দেখে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘কী দারুণ কাজ করেছিস রে তুই!’’— কী যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম!
আর আজ ছেলের বৌ হিসেবে বলছি না, হয়তো ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, তবু বলছি, আমার মনে হয়, ওঁর নিজের দুই ছেলেমেয়ের থেকেও আমি বেশি কাছের ছিলাম। অবশ্য এটা পুরোপুরিই আমার নিজের ধারণা।
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়
হৈমন্তী শুক্ল
বর্ধমানের একটা ফাংশানে গিয়ে প্রথম ওঁর সঙ্গে আলাপ। আমার গান শুনে খুব প্রশংসা করলেন। এমন করে কথা বলছিলেন, যেন কত কালের চেনা। তার পর থেকে উনি আমার বাবা পণ্ডিত হরিহর শুক্লর মতোই আমার অভিভাবক। কত জায়গায় যে গাইতে নিয়ে গেছেন! দিল্লির ত্রিমূর্তি ভবনে নেহরুর এক মৃত্যুবার্ষিকীতে কনভেনার পদ্মজা নাইডু হেমন্তদাকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তখন আমি একেবারে নতুন। তা সত্ত্বেও আমাকে দিয়ে ওখানে গান গাওয়ালেন। কেউ একটু টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারলেন না। এটা হেমন্তদার পক্ষেই সম্ভব।