কর্মকাণ্ড: অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতে মীরা মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন
শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করল ‘গ্যালারি ৮৮’। বিশিষ্ট আলোকচিত্রী অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের তোলা মীরা মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন এবং ভাস্কর্যের ছবির প্রদর্শনী উপহার দিল তারা। শিল্পীর কাজ আগে দেখা থাকলেও তাঁর কাজের ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল না। এ যেন ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া।
ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টে শিল্পে শিক্ষাগ্রহণ মীরার। পরে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে এবং পরে দিল্লির পলিটেকনিকে শিক্ষালাভ। ডিপ্লোমা পেয়েছিলেন পেন্টিং, গ্রাফিক্স ও ভাস্কর্যে। একটি অধ্যায়ে ইন্দোনেশিয়ার চিত্রশিল্পী এফেন্দি কুসুমার কাছে শান্তিনিকেতনে কাজের সুযোগ আসে। ওই ঘটনা মীরার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৫২-’৫৩ সালেই মিউনিখের অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে কাজের সুযোগ পান। সেখানে টোনি স্ট্যাডলারের তত্ত্বাবধানে অঙ্কনশিল্প থেকে ভাস্কর্যে স্থানান্তরণ। ১৯৫৭ সালে দেশে ফেরেন মীরা এবং মধ্য ভারতের ক্রাফ্ট প্র্যাকটিস বা কারুশিল্প নিয়ে প্রভূত রিসার্চ করেন।
ছত্তীসগঢ়ের বাস্তার এলাকার জনজাতির শিল্পীদের সঙ্গে ডোকরার ধাতু ঢালাই শেখেন। পরবর্তীকালে সেই টেকনিক আয়ত্ত করে যে পদ্ধতিতে কাজ করতেন, ‘লস্ট ওয়্যাক্স মেথড অফ কাস্টিং’, সেটিই তাঁর নিজের কাজের সিগনেচার হয়ে দাঁড়ায়। এটি ছিল শ্রম-নিবিড় কাজ। সে কাজে অনেক মানুষের সাহচর্য দরকার ছিল। তাঁরাই ছিলেন ওঁর পরিবার। তারের কর্মী, মাটি-বাহক, মাঝি, জেলে, ঝুড়ি বোনেন যাঁরা... তাঁরাই ওঁর শিল্পসৃষ্টির বিষয়বস্তু।
মাটি দিয়েই প্রথম থেকে মূর্তি গড়তেন মীরা। সাধারণত প্লাস্টার অফ প্যারিসেই মূল অংশটি (কোর) বানানো হয়। কিন্তু উনি ব্যবহার করতেন এঁটেল মাটির সঙ্গে খড়ের টুকরো, ছাঁকা গোবর, ধানের কুড়ো, বেলে মাটির সংমিশ্রণ। তা দিয়ে প্রথমে মূল অংশটি তৈরি হত। তার পর মৌচাক থেকে সংগৃহীত মোমের সুতো বানিয়ে সেটি খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে সমান ভাবে মূল মূর্তিটা তৈরি করা হত। তার উপরে গোলা-মাটি দিয়ে ঢাকা হত। এর উপরে মোটা টেপা-মাটি। তার পরে বালি-মাটি, একদম উপরে তুষ-মাটি। যখন ফার্নেসে দেওয়া হত, মোমটা গলে গিয়ে একটা নেগেটিভ স্পেস তৈরি হত। সেখানে গলা ধাতু ঢেলে দেওয়ার ফলে মূর্তির ভিতরটা ফাঁপা থেকে যায় ও তাতে কাজটার ওজন কম থাকে। ইটের গোল উনুন বা ভাটায় কাজ করতেন। এর আঁচ ঠিকমতো বজায় রয়েছে কি না, সে দিকে নজর রাখতেন নিজেই। এই ভাবে তিনি নিজেই কিছুটা পশ্চিমি পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেন।
মীরা মুখোপাধ্যায়ের শেষ কাজ ছিল বুদ্ধের ১৪ ফুটের ধ্যানস্থ মূর্তি। সেটির অনুপ্রেরণা হয়তো পেয়েছিলেন সাঁচিতে বুদ্ধের বিশাল ধ্যানমগ্ন প্রতিকৃতি দেখে। মীরা লিখেছিলেন, ‘‘যে শিল্পী এ কাজ করতে পারেন, তিনি তো নির্ঘাত বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।’’ বিদেশ সফরে জানতে পারেন যে, জাপানের কারিগররা যখন চাকা ঘুরিয়ে মাটির পাত্র গড়েন, তখন তাঁরা ধ্যানস্থ হয়েই ওই কাজ করেন। মীরা বিভিন্ন দেশ ঘুরে, দেখে, নিজের ভিতরে হয়তো সেই ধ্যান খুঁজে পেয়েছিলেন।
কর্মকাণ্ড: অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতে মীরা মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন
‘বিশ্বকর্মার সন্ধানে’ বইটিতে শিল্পী বৌদ্ধদের নানা রীতিনীতি নিয়ে চর্চা করেছেন এবং শেষে সেটি একটি চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৪ ফুটের সুবিশাল বুদ্ধমূর্তিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে তাঁর শেষ শিল্পকর্ম বসে থাকা এক বুদ্ধমূর্তির কাজ শুরু করেন মীরা। তার ঠিক আগেই পুরী গিয়েছিলেন, কয়েক জন পাথর-শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে। একটি ৮ ইঞ্চির দাঁড়ানো বুদ্ধমূর্তি বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। জীবনের প্রথমে দিকে সম্রাট অশোকের একটি ১২ ফুটের ভাস্কর্য শুরু করেছিলেন তিনি। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরের মুহূর্তকে ধরা হয়েছে সেখানে। সেটি বানাতে প্রায় তিন বছর সময় নিয়েছিলেন শিল্পী। কিন্তু জীবনের শেষ দিগন্তে ওই ১৪ ফুটের বুদ্ধমূর্তির জন্য মাত্র এক বছর পেয়েছিলেন। ওই বিশাল কাজে সাহায্য পান ভূমিহীন চাষিদের কাছ থেকে, যাঁরা শিখেছিলেন মীরার জটিল ধাতু ঢালাই পদ্ধতি। শেষে তাঁরাও হয়ে ওঠেন উন্নতমানের শিল্পী। ১৯৯৭ সালে এলাচি গ্রামে কাজ করছিলেন মীরা। বুদ্ধের শরীরের নীচের অংশ ও কিছুটা অবয়ব সংযুক্ত করা হয়েছিল, এমন সময়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান মীরা। বাহুর কিছু অংশের কাজ বাকি ছিল।
দুই কিউরেটর, অদীপ দত্ত এবং তপতী গুহঠাকুরতা প্রদর্শনীর সযত্ন আয়োজন করেছেন। জীবনীকারের নিবিষ্টতা দিয়ে অরুণ গঙ্গোপাধ্যায় শিল্পীর জীবন ও শিল্পচর্চার নানা মুহূর্ত ছবিতে ধরে রেখেছেন। তবে এত কাজ, এত ভাস্কর্য যিনি রেখে গিয়েছেন, গোটা প্রদর্শনীতে সেই শিল্পীর ভাস্কর্য বলতে মাত্র একটিই, ‘মিনিবাস’। এত বড় চিত্র-প্রদর্শনীতে মীরার কাজের ব্যাপ্তি আরও খানিক ধরা পড়লে যেন তা সম্পূর্ণতা পেত।