এই মুহূর্তে ‘বেঁচে থাকার গান’-এর মূল সুর একটাই: হে কর্ত়ৃত্ববাদী বড় ডাক্তার, বৃদ্ধাবাসের লোকগুলিকে মানুষ হিসেবে দেখো। ওদের ভালর জন্য তোমার তৈরি কড়া নিয়মগুলি আর লাগু কোরো না। এতে তোমার সেবা-তৃপ্তি হয় ঠিকই, কিন্তু মানুষগুলি ততক্ষণে কন্ঠাগত প্রাণ!
এই সিনেমার একটি দৃশ্যে নিয়মতান্ত্রিক সেই কড়া ডাক্তার টোটা রায়চৌধুরী জিপে নায়িকা গার্গীকে নিয়ে হাটে যাচ্ছেন।
ঝাড়গ্রামের শাল-জঙ্গলের রাস্তা, ত্রিপলঢাকা কিছু দোকানে ডাঁই-করা জিলিপি। পাশে মিড শটে গলিপথে কিছু পাকা দোকান।
গার্গী এসেছেন ওষুধ কিনতে। হল-এ বসেই মনে হল, ইস, এই সব দোকানে তো পেটিএম চলে না!
সিনেমাটার সঙ্গে ৮ নভেম্বর-উত্তর এই সব সমস্যার যোগাযোগ নেই জানি, কিন্তু শিল্প তো গগনচারী কোনও বিষয় নয়। দর্শক কোন সময়ে সেটি দেখছেন/পড়ছেন, সেটিও রসগ্রহণে প্রভাব ফেলে।
এই ছবির আর এক বৈশিষ্ট্য, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়। পরান বৃদ্ধাবাসে-থাকা বিপত্নীক বৃদ্ধ। এক সময় স্ত্রীর সঙ্গে গ্র্যান্ড হোটেলে বলডান্স করতেন, এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। কিন্তু শেষ স্টেশনে পৌঁছলেই কি শরীর নিভে যায়? থাকে না কামনা-বাসনার প্রজ্জলন্ত প্রদীপ?
পরান তাই বৃদ্ধাবাসে থাকা কাজের মেয়ের শরীরে হাত বোলান, স্মৃতি হাতড়ান। ‘জানিস, তোর দিদার বুকে একটা তিল ছিল?’ বেলাশেষেও যে শরীর রয়ে যায়, এ কথা ‘রাত ভর বৃষ্টি’ উপন্যাসে কবেই লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, ‘মাঝবয়সি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এত খিটিমিটি কেন? তাদের শরীর মরে গিয়েছে বলে।’
সত্তর দশকের সাড়া জাগানো সেই বাংলা উপন্যাসের পর আজও বাংলা ছবিতে বার্ধক্য মানে এক গত। নিজেকে অবহেলিত, বঞ্চিত ভেবে প্রবাসী পুত্রকন্যাদের জন্য হাহাকার।
সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহের এই ছবিতে সেই হাহাকার নেই, বৃদ্ধবৃদ্ধারা কড়া ডাক্তারকে লুকিয়ে কখনও শ্যান্ডি খান, কখনও বা গার্গীর প্রেরণায় নিজেরা একসঙ্গে হইচই করে পার্টি দেন। এটি বাংলা ছবির এক উজ্জ্বল উদ্ধার। বস্তুত বাংলা জনসংস্কৃতির চিহ্নকগুলি ছবির সারা গায়ে ছড়ানো। বৃদ্ধাবাসে এক অভিনেত্রী থাকেন, যিনি দশ বছর আগে জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন। তার পর ফিল্ম থেকে সরে গিয়েছেন, কেউ জানে না এই বৃদ্ধাবাসই তাঁর ঠিকানা। কল্পনার মাটিতে রয়ে গেল সুচিত্রা-স্মৃতি?
আর এক প্রৌঢ়া সারাদিন সাজগোজ করেন, অভিনেত্রী হতে চান। মিথ্যে মিথ্যে বলেন, শক্তি সামন্ত তাঁকে নায়িকা হতে ডেকেছিলেন।
আমাদের মতো অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত মানুষের অবদমিত, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ঢেকে রাখতে এই সব মিথ্যেও তো এক জাতীয় বেঁচে থাকার গান।
নজর কেড়েছেন নায়িকার চরিত্রে গার্গী। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত সাইকিয়াট্রিস্ট ঘন ঘন সিগারেট খান, প্রেমিককে না জানিয়ে মফস্সলের এই বৃদ্ধাবাসে চলে আসেন।
কোথাও কি থেকে গেল বাংলা ছবির ছকবাঁধা আত্মত্যাগের গল্প? কিন্তু ক্যানসার, আত্মত্যাগের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়ে গেল আর এক সত্য। মেয়েরা যখন নিজের থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, পুরুষটি আজও মধ্যযুগের ছকেই ভাবে।
যেমন, গার্গীর প্রেমিক। এক বারও জানতে চায়নি সে অসুস্থ কি না! প্রেমিক শুধুই ভেবেছে, নারীর প্রত্যাখ্যান মানেই সে বিশ্বাসঘাতিনী, অন্য কোনও পুরুষে মগ্ন।
বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্ন মেনে এই ছবির গানগুলি বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। তবে পদ্মনাভ দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য মাঝে মাঝে তাল কেটেছে। অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র যেমন। বিয়ে-থা না করে ভাইপো-ভাইঝিকে মানুষ করেছেন। তারাই এক রাতে ছোরা নিয়ে বৃদ্ধের ঘরে।
বৃদ্ধাবাস মানেই কি আর উত্তর প্রজন্মের ভিলেনি? প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রটি জঙ্গি হামলায় বউ ছেলে সবাইকে হারিয়ে মাথার রোগে ভোগে, সারাক্ষণ দরজা খোলা আছে কি না দেখতে যায়। দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় দরজা খুলে সশব্দে বায়ুত্যাগ করেন ও বাথরুমে যান। চিত্রনাট্যকার খেয়াল করেননি, বার্ধক্য মানেই মানসিক রোগ নয়।
দুর্বলতা শেষ সত্য নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায়ও ছিল ‘সুন্দর রহস্যময়’ আর্তি: বলেছি বাঁচো বাঁচো!
সেই বেঁচে থাকার গানই এই ছবির অভিজ্ঞান।