ক্ষমতার চোখরাঙানিকে অস্বীকার

গ্যালিলিও গ্যালিলেই নাটকে। দেখলেন গৌতম চক্রবর্ত়ীবিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বাংলা থিয়েটারে চমৎকার একটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর চুলকানি, দাঁত খোঁটা, তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা সবই বিশ্বাস্য ভাবে নিয়ে এসেছেন তপন থিয়েটারের ‘গ্যালিলেও গ্যালিলেই’ নাটকে। পীযূষবাবুদের নাটক নামছে এখন। দুই দশক আগে, ১৯৯২ সালে তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জন পল সাফ জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বলার জন্য গ্যালিলিওকে যে ভাবে বৃদ্ধ বয়সে যাজকতন্ত্রের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল, সেটি ভুল ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share:

বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বাংলা থিয়েটারে চমৎকার একটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর চুলকানি, দাঁত খোঁটা, তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা সবই বিশ্বাস্য ভাবে নিয়ে এসেছেন তপন থিয়েটারের ‘গ্যালিলেও গ্যালিলেই’ নাটকে।
পীযূষবাবুদের নাটক নামছে এখন। দুই দশক আগে, ১৯৯২ সালে তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জন পল সাফ জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বলার জন্য গ্যালিলিওকে যে ভাবে বৃদ্ধ বয়সে যাজকতন্ত্রের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল, সেটি ভুল ছিল। ‘‘আজ আমরা নিঃসংশয়ে জানি, গ্যালিলিও-ই সে দিন ঠিক ছিলেন,’’ নব্বই দশকের সেই বিবৃতিতে বলেছিল ভ্যাটিকান। পৃথিবী নয়, সূর্য এই সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে, গ্রহরা তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বলার জন্য ১৬৩৩ সালে ৭৭ বছরের বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে ঘরবন্দি করেছিল গির্জা। ভুলের সেই চুলকানি কাটতে কাটতে সাড়ে তিনশো বছর পেরিয়ে গেল।
গির্জা বনাম গ্যালিলিওর এই দ্বন্দ্বকেই প্রায় সত্তর বছর আগে একটি ধ্রুপদী মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট। তিরিশের দশকে হিটলারের নাৎসি দল ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে পালান ব্রেখ্ট, তখনই ‘গ্যালিলেও গ্যালিলি’ নাটকের প্রথম খসড়া। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিল্স বোর তাঁকে এ বিষয়ে তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিছু তথ্য বুঝতেও সাহায্য করেছিলেন। খসড়া নিয়ে ব্রেখ্ট পাড়ি দেন আমেরিকায়। সেখানে নাটকটির প্রথম অভিনয়।

Advertisement

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধর শেষে আমেরিকা বনাম রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধ। ব্রেখ্টকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়, নাট্যকার জানান, তিনি কোনও দিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। পরের দিনই ইউরোপ হয়ে পূর্ব জার্মানি পাড়ি। দেশে ফিরে আবার ‘গ্যালিলিও’-র পরিমার্জন ও সংশোধন। কমিউনিস্ট হয়েও কেন আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, মার্কিন আদালতে কেন সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন, সেই স্বীকারোক্তিও যেন প্রচ্ছন্ন ভাবে মিশে থাকল নাটকে। বিজ্ঞানী এবং শিল্পীরা যে বেঁচে থাকার তাগিদে ক্ষমতার দ্বারস্থ হলেও কখনও স্বধর্মচ্যুত হন না, সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নাট্যকার।

অতএব, এই নাটক বাংলায় বারংবার। কখনও ফ্রিৎস বেনেভিৎসের পরিচালনায় শম্ভু মিত্রকে গ্যালিলিও করে রুদ্রপ্রসাদ, বিভাস চক্রবর্তী এবং অনেকে। কয়েক বছর পর আবার বহুরূপীর প্রযোজনায় গ্যালিলিও-র চরিত্রে কুমার রায়। পীযূষ এই দুই মহীরুহের গ্যালিলিও দেখেননি। তখন অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্র সদনের বদলে ফুটবল মাঠ তাঁকে বেশি টানে। আর সেটাই শাপে বর হয়েছে। এই নাটকের শেষ দিকে গ্যালিলিও যে ভাবে গোগ্রাসে হাঁসের মাংস খান, বিরক্ত হয়ে গা চুলকাতে থাকেন সেটি আগের দুই উপস্থাপনায় সে ভাবে আসেনি। ভাবগম্ভীর, পরিশীলিত প্রৌঢ়ত্ব এবং কৃত্রিম বাচনভঙ্গির হাত থেকে এ যাত্রায় নিস্তার পেয়েছেন গ্যালিলিও।

Advertisement

নিভা আর্টস-এর প্রযোজনায় তৈরি এই নাটকের আর এক চমক পরিচালকের ডিজাইনিং ও মঞ্চ উপস্থাপনায়। তপন থিয়েটারের মঞ্চটি রিভলভিং, প্রথম দৃশ্যেই অভিনেতা অভিনেত্রীরা যখন মোমবাতি হাতে যীশুর ছবির সামনে সারিবদ্ধ ভাবে প্রবেশ করেন, মঞ্চটি ঘুরতে থাকে। শেষ দৃশ্যে ফের মঞ্চ ঘোরে, ঘুরতে থাকে গ্যালিলিওর হাতে ধরা গ্লোব। ক্রমশ ঘুরতে ঘুরতেই অদৃশ্য হয়ে যান গ্যালিলিও, নিভু নিভু আলোয় ঘুরতে থাকে শুধু পৃথিবী। পিছনের পর্দায় পড়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, ‘চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও লিখে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না/ তবু পৃথিবী ঘুরছে, ঘুরবেও। যতই তাকে চোখ রাঙাও না।’

মঞ্চের সামনে একটি জাল, পুরো নাটকটি ঘটে সেই জালের আড়ালে। মাঝে মাঝে জালের আড়াল থেকে ক্লান্ত ও বৃদ্ধ গ্যালিলিও মঞ্চের সিঁড়িতে এসে বসেন। ১১টি দৃশ্যে ধাপে ধাপে তিনি ৪৬ থেকে ৭৯ বছরে পৌঁছান। পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের কেরিয়ারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই নাটকটা, সসম্মানে উতরেছেন তিনি। কিন্তু বিপ্লবের পরিচালনা? আগামী শনিবার তপন থিয়েটারে ফের এই নাটকের অভিনয়। তখনও কলকাতা স্তম্ভিত হয়ে ভাববে, ক্ষমতার বিস্তৃত রহস্যময় ঊর্ণনাভ কি এ ভাবেই অভিনেতা ও দর্শকদের মধ্যেও তৈরি করে আড়াল?

ক্ষমতাকেই বারংবার হাইলাইট করেছে এই নাটক। কখনও দলতন্ত্রের ক্ষমতা, কখনও বা বাজারের ক্ষমতা। কিউরেটর এসে গ্যালিলিওকে বলেন, ‘পয়সা কম দিলেও আমাদের সরকার কিন্তু আপনাকে গবেষণার স্বাধীনতা দিয়েছে। আমাদের যারা বিরোধী, তাদেরও লেকচারে ডাকা হচ্ছে, ডক্টরেট দেওয়া হচ্ছে।’ ব্রেখটের নাটকে কিউরেটরকে গ্যালিলিও বলেছিলেন, ‘বুঝতে পারছি, কী বলছেন। মুক্ত বাণিজ্য, মুক্ত গবেষণা তাই তো?’ এখানে রতন দাসের অনুবাদ সেই সংলাপকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। গ্যালিলিও ঠাট্টা করেন, ‘বাণিজ্যে বসতি গবেষণা, তাই তো?’ অত্যাচারের পর গির্জাই ঠিক, আমি ভুল বলে ধুঁকতে ধুঁকতে ক্লান্ত শরীরে বেরোচ্ছেন গ্যালিলিও, তখনই সেই সংলাপ। তাঁর ছাত্র আন্দ্রেয়া বলে ‘দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে বীর নেই।’ গ্যালিলিওর পাল্টা উত্তর, ‘দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়।’ ব্রেখটের নাটক এতটুকু না বদলে প্রতিটি যুগ তার নিজের মতো মর্মোদ্ধার করে নিতে পারে, এখানেই তিনি ক্লাসিক।

হাসি যখন হাতের মুঠোয়

‘চলো পটল তুলি’ নাটকটি দেখে এলেন পিয়ালী দাস।

ধান গাছ থেকে চেয়ার-টেবিল হয়। আঁকশি দিয়ে পেঁয়াজ পাড়তে হয়। আবার কমলালেবুর গাছে বাতাবিলেবুও ফলে। গল্পের গরু গাছে চড়ে। চার্বাক প্রযোজিত হাসির নাটক ‘চলো পটল তুলি’তে এমন সব আজব ঘটনারই সাক্ষী হয়ে রইলেন দর্শকেরা। ২৫০তম অভিনয় হয়ে গেল সম্প্রতি।

তথ্যের যুগে পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় বন্দি। বিনোদন, বন্ধুত্বের অনেক হাতছানি। তবুও মানুষ বড় একা হয়ে পড়ছে। তেমনই এক একা মানুষের আজব সব কাণ্ড-কারখানা উঠে আসে এই নাটকে। আর তাকে কেন্দ্র করেই নাটকে আসে একাধিক চরিত্র, অনেক মজা। শিব্রাম চক্রবর্তীর কয়েকটি সরস গল্পের নির্বাচিত অংশ থেকে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় নাটকটি লিখেছেন।

অশ্বিনী চাকলাদার এক স্বার্থপর মানুষ। পাশের বাড়ির নিত্যচরণবাবুর ‘বেরি-বেরি’ হয়েছে শুনে তার আশঙ্কা, এই বুঝি তারও বেরিবেরি হল। আগাম সতর্কতায় ডাক্তারবাবুর কাছে ছোটে। ডাক্তার বেরিবেরি হয়েছে ভেবেই অশ্বিনীকে ওষুধ দেয়। সেই মিক্সচার খেয়ে অশ্বিনীর শরীর ঝাঁকিয়ে নেওয়ার দৃশ্য দর্শকদের প্রচণ্ড হাসায়। সে এক জনের কাছে শুনেছে কলার খোসা খেলে বেরিবেরি হয় না, অমনি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে কলার খোসা খেতে শুরু করে। আবার সেই কলার খোসাতে নিজেই পিছলে পড়ে! এই অশ্বিনীর চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তীর অভিনয় মুগ্ধ করে। অশ্বিনীর পোশাকও হাসি পাওয়ার মতোই। হিটলারের মতো ছোট গোঁফ আর চালচলন চ্যাপলিনের কথাই স্মরণ করায়। অরিন্দম অভিনীত ডাক্তারের চরিত্রটিও নজর কাড়ে। রণচণ্ডী জগত্তারিণীর ভূমিকায় খেয়ালী দস্তিদারের অভিনয়ের তারিফ করতেই হয়। অশ্বিনীকে ভালোবাসলেও ওর আজব কান্ডকারখানায় বকাঝকাই বেশি করে।

নাটকে আলোর ব্যবহার দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অশ্বিনী মামারবাড়ি ডালটনগঞ্জে পাড়ি দেবে। ব্যাগপত্র গোছানোর সময় অশ্বিনীর ভাইঝি জগত্তারিণীকে জিজ্ঞেস করে, ওরা চলে গেলে তার মন খারাপ করবে কিনা? সেই দৃশ্যে খেয়ালীর অভিব্যক্তি, সঙ্গে আলোর সঠিক ব্যবহারে প্রেক্ষাগৃহের কেণে কোণে ছড়িয়ে পড়ে নরম ভালোবাসার আবেশ। এক মনোরম দৃশ্য রচিত হয়। আবহ সঙ্গীতের ব্যবহারও যথাযথ।

নতুন পথের দিশা

সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল ‘বৃত্তান্ত’র প্রযোজনায় মিলন মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি ও প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নাটক ‘সেকেন্ড ওপিনিয়ন’। এক অস্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া থেকে জন্ম নেওয়া দুশ্চিন্তা বাস্তব ঘটনার আবহে বিস্তৃত হতে হতে হঠাৎই আশাতীত প্রাপ্তির পথে মোড় নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দ্রুত সেই প্রাপ্তির আশা সতর্ক প্রবাদবাক্য ‘লোভে পাপ পাপে ...’, না মৃত্যু নয়। এ নাটকে বিপর্যয় এ কথা স্মরণ করিয়েই পরিসমাপ্তির পথে এগিয়ে যায়। আসলে প্রবাদ কখনও কখনও বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু কিছু ঘটনা সেই প্রবাদের সূত্রে এক নতুন রসায়নের পথ দেখায়। খগেন-এর চরিত্রে প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় অনবদ্য। চয়নিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু গুপ্ত, উৎপল আগোয়ান, জয়ন্ত সিংহ এবং তপতী মালি দাস যথাযথ। উমা নস্করের অভিনয় বেশ দাগ কাটে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement