দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। ‘নীল-দর্পণ’ অভিনয় করবে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। কিন্তু কলকাতা পুলিশের অনুমতি মিলছে না। উদ্যোক্তারা বারবার যাচ্ছেন পুলিশের কাছে, লাভ হচ্ছে না। পুলিশের এহেন আচরণের কারণটা বোঝা গেল কিছু পরে, যখন তাঁরা অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলেন, ‘দীনবন্ধুবাবু কোথায়? তাঁকে আসতে বলুন—’। মৃত্যুর প্রায় আশি বছর পরে দীনবন্ধু মিত্রকে পুলিশ স্টেশনে হাজির করা গোয়েন্দা বিভাগেরও অসাধ্য ছিল, বলাই বাহুল্য।
নির্মল হাস্যরসের তাগিদে এ গল্প বলা নয়। প্রশাসনের যে বিভাগ সকলের নাড়িনক্ষত্র জানে, তারা দীনবন্ধু কে, তা জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধুর আসন পাকা, কিন্তু অভিনয়ই নাটকের প্রাণ, পরীক্ষাও। রঙ্গশালায় তিনি প্রায়-বিস্মৃত। কেন? তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সুহৃদ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শতবর্ষ পরে গোপাল হালদার এই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই সন্ধান যত না তাঁর সাহিত্যকর্মে মিলবে, তার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে তাঁর জীবনযাপনে।
বাহাদুর-বৃত্তান্ত
সাবেক পূর্ব বাংলা রেলওয়ের কাঁচরাপাড়া স্টেশনের কয়েক কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে চৌবেড়িয়া গ্রামে দীনবন্ধুর জন্ম ১২৩৮ বঙ্গাব্দে। যমুনা নামে এক ছোট্ট নদী গোটা গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে, তাই চৌবেড়িয়া। এই গ্রাম নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলা সাহিত্য, দর্শন, ধর্মশাস্ত্রে নদিয়া জেলার যে বিশেষ গৌরব, তার একটা কারণ দীনবন্ধুও।
দীনবন্ধুর পরিবার সচ্ছল ছিল না, সামান্য লেখাপড়া শেখার পরেই জমিদারি সেরেস্তার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। শুধু উচ্চাশা ও বিদ্যানুরাগের জোরে তিনি কলকাতায় পৌঁছন, শুরু হয় উচ্চশিক্ষা। পিতৃব্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আনুমানিক ১৮৪৬ সালে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হওয়া। সে সময়ে এই স্কুল হিন্দু কলেজের ‘ব্রাঞ্চ’ বা ‘হেয়ার সাহেবের স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল, ১৮৬৭ সালে নাম হয় হেয়ার স্কুল। যে বাড়িতে থাকতেন, লেখাপড়ার সঙ্গে সেখানে রান্নাবান্না ও অন্যান্য গৃহকর্ম করতে হত। সে সব সামলেই ১৮৫০ সালে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ, হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়া। পরের বছর ফোর্থ ক্লাসের পরীক্ষায় ফের বৃত্তি লাভ, বাংলা পরীক্ষায় প্রথম। পরের বছরেও প্রথম। ১৮৫৩-র জানুয়ারিতে শিক্ষকতার পরীক্ষা পাশ করেন দীনবন্ধু। পরের বছর এপ্রিলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে সিনিয়র পরীক্ষা দিয়ে ৩০ টাকা বৃত্তিও পান। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে পড়া বোধ হয় তাঁর আর শেষ হয়নি। ১৮৫৫-এ চাকরি হয়ে যায় ডাক বিভাগে, পোস্টমাস্টার হয়ে চলে যান পটনা।
দীনবন্ধুর আঠারো বছরের চাকরিজীবন ডাক বিভাগেই কেটেছিল। পটনায় পোস্টমাস্টারের পদে ছিলেন ছ’মাস, কাজে সুনাম হয়, ওড়িশা বিভাগে ইনস্পেক্টিং পোস্টমাস্টার হয়ে যান। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে পোস্ট অফিসের কাজ তত্ত্বাবধান করা ছিল এই পদের দায়িত্ব। ১৮৫৬-৫৭ সাল থেকে ১৮৬৯-৭০ পর্যন্ত সম্বৎসর শুধু ঘুরেই বেড়াতে হয়েছে দীনবন্ধুকে। এক-দু’দিন, বড়জোর তিন দিন— তার বেশি এক স্থানে থিতু হওয়ার নিয়ম নেই সেখানে। ওড়িশা থেকে বদলি নদিয়ায়, নদিয়া থেকে যশোর, তার পর ক্রমান্বয়ে ঢাকা, নদিয়া, ঢাকা, ওড়িশা, নদিয়া; ১৮৬৯-৭০ সালে কলকাতা। ১৮৭১-এ আবার লুসাই যুদ্ধে সরকারি ডাকের সুবন্দোবস্তের প্রয়োজন হওয়ায় তাঁকে কাছাড়ে পাঠানো হয়, কাজ সেরে ফেরেন কলকাতায়। ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পান তিনি।
চৌবেড়িয়ায় দীনবন্ধুর পৈতৃক ভিটের ভগ্নদশা।
দীনবন্ধু প্রথম শ্রেণির বেতন পেতেন, ভারী উপাধিও পেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে তাঁর বিশেষ উপকার হয়নি। পোস্টমাস্টার জেনারেল বা ডিরেক্টর হওয়ার যোগ্যতা থাকলেও তা হতে পারেননি। তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল টুইডি ছিলেন দীনবন্ধুর গুণগ্রাহী। টুইডির সঙ্গে ডিরেক্টর জেনারেল হিগ-এর ক্ষমতাদ্বন্দ্ব বেধেছিল, বলির পাঁঠা হন টুইডির বিশ্বাসভাজন দীনবন্ধু। ১৮৭২ সালে কলকাতার ‘বিশ্রাম’ ছেড়ে তাঁকে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কাজে হাবড়া ডিভিশনে বদলি করে দেওয়া হয়। বারবার ছুটির আবেদন করেন, ফল মেলে না।
স্বাস্থ্য ভাঙতে থাকে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাগ্রহণ করেন দীনবন্ধু। মারা যান অল্প কালের মধ্যেই।
১ নভেম্বর ১৮৭৩, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে।
মানব-চরিত্র
পাঠকের মনে হতে পারে, সাহিত্যিকের চাকরিজীবনের এত খুঁটিনাটি জেনে কী হবে? মানুষটিকে বুঝতে তা জরুরি, আরও জরুরি তাঁর সাহিত্যকর্ম বুঝতে। বঙ্কিমচন্দ্র ঠাট্টা করে লিখেছিলেন, ‘‘...বঙ্গদেশের দূরদৃষ্টিবশতই তিনি ইন্স্পেক্টিং পোষ্টমাষ্টার হইয়াছিলেন।’’ সারা বছর অবিরত পথেঘাটে দৌড়ে বেড়ালে যা হয়, তা-ই হয়েছিল দীনবন্ধুর। ক্ষয় ধরেছিল শরীরে, সয়নি অমানুষিক পরিশ্রম। কিন্তু এর অন্য দিকটি হল, নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণই সাহিত্যিক দীনবন্ধুকে তৈরি করে দিয়েছিল। নানা দেশ ঘোরার সূত্রে বহু মানুষের সঙ্গে চেনা-জানা হত, সেই সূত্রে মনুষ্যচরিত্র পর্যালোচনা করার শিক্ষাটি পেয়েছিলেন তিনি, উপহাসনিপুণ সাহিত্যিকের পক্ষে যা একান্ত দরকারি। এই শিক্ষাতেই গড়ে উঠেছিলেন প্রহসনকার দীনবন্ধু, যিনি নানাবিধ রহস্যাবৃত চরিত্র সৃজন করতে পারতেন।
সব শ্রেণির মানুষের দৈনিক জীবনের খবর রাখেন, লেখককুলে এমন বাঙালি বিরল, সে কালেও এ কালেও। তাঁরা দেশবৎসল, দেশের মঙ্গলার্থে লেখেন, কিন্তু দেশের অবস্থা জানেন না। কলকাতার ভিতর স্বশ্রেণির লোকে কী করছে, এটুকুই তাঁদের স্বদেশজ্ঞানের সীমা। কেউ হয়তো টুকটাক গ্রামগঞ্জ চা-বাগান হাটবাজার দেখেছেন, কিন্তু মানুষের সঙ্গে তত মেশেননি। চারপাশ সম্পর্কে অধিকাংশ জ্ঞানই তাঁরা খবরের কাগজ থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, “তাঁহাদিগের অনেকেরই লিখিবার যোগ্য শিক্ষা আছে, লিখিবার শক্তি আছে, কেবল যাহা জানিলে তাঁহাদের লেখা সার্থক হয় তাহা জানা নাই।” এই বিরল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিলেন দীনবন্ধু। সরকারি কাজে ঘুরেছেন পূর্বে মণিপুর থেকে পশ্চিমে গঞ্জাম, উত্তরে দার্জিলিং থেকে দক্ষিণে সাগর। এক বার নয়, বারবার। যদিও তিনি ডাকঘর দেখতে যেতেন, গ্রাম বা শহর নয়, তবু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ছিল তাঁর সহজাত। প্রায় আহ্লাদ করেই তিনি সব ধরনের মানুষের আপন হয়ে যেতেন। সমাজের প্রান্তিক মানুষ, যাঁদের খবর শহুরে ‘এলিট’ সাহিত্যিককুল পর্যন্ত পৌঁছত না, তাঁদের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে ফেলতেন তিনি। ক্ষেত্রমণি-আদুরীর মতো গ্রাম্য মেয়ে, গ্রামের প্রজা তোরাপ, রাজীবের মতো গ্রাম্য বৃদ্ধ, গ্রামের বালক নশীরাম-রতা, নিমচাঁদের ন্যায় শহুরে শিক্ষিত মাতাল, পুরবাসী গ্রাম্য বাবু অটল, কাঞ্চনের ন্যায় অত্যাচারী শোষক, বখাটে ছেলে নদেরচাঁদ-হেমচাঁদ, আবার ঘটীরামের মতো ডেপুটি— সবই তাঁর দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় লব্ধ। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। যা দেখলাম, তা-ই হুবহু এঁকে দিলে শিল্প হয় কি? নিপুণ শিল্পীর মতো বাস্তবের উপরে কল্পনার তুলি বুলিয়ে দিতেন দীনবন্ধু। জানতেন, কী ভাবে স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে জীবন্ত আদর্শ তুলে এনে দোষে-গুণে একটি চরিত্রের জন্ম দিতে হয়।
বস্তুত, দীনবন্ধুর সাহিত্যকে চেনা যেত দুই বৈশিষ্ট্যে— বাস্তবতা ও হাস্যরসে। বাস্তবতা তাঁর স্বভাবধর্ম। বলা হয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ আর ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’-র অনুপ্রেরণা ছিল দীনবন্ধুর প্রহসন ‘সধবার একাদশী’ ও ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’-র ক্ষেত্রে। তবে সেখানেও দীনবন্ধু সমাজচিত্র এঁকে নিয়েছেন নিজের মতো করে, তাঁর বাস্তব ধারায় সমাজ-পরিচিতি কলমে আরও আরও শক্তির সঞ্চার করেছে। অতি সামান্য বস্তু আশ্রয় করে জমে উঠেছে তামাশা।
মানুষ দীনবন্ধুর আর একটি অপরিহার্য গুণের কথা উল্লেখ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। “দীনবন্ধুর সামাজিক অভিজ্ঞতাই বিস্ময়কর নহে— তাঁহার সহানুভূতিও অতিশয় তীব্র। বিস্ময় এবং বিশেষ প্রশংসার কথা এই যে, সকল শ্রেণীর লোকের সঙ্গেই তাঁর তীব্র সহানুভূতি। গরীব দুঃখীর দুঃখের মর্ম্ম বুঝিতে এমন আর কাহাকে দেখি না। তাই দীনবন্ধু অমন একটা তোরাপ কি রাইচরণ, একটা আদুরী কি রেবতী লিখিতে পারিয়াছিলেন।” বিদগ্ধ পাঠক বুঝবেন, শুধু অভিজ্ঞতায় কিছু হয় না, সহানুভূতি ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। দীনবন্ধুর তীব্র সহানুভূতি ছিল সর্বব্যাপী, শুধু গরিব-দুঃখীর সঙ্গে নয়। এমনকি তিনি দুশ্চরিত্রের দুঃখও বুঝতেন, নিজের চরিত্রে সামান্য কালির ছিটে না থাকলেও পাপিষ্ঠের দুঃখ বুঝতেন। নিস্পৃহতা নিয়ে যথাযথ অনুধাবন করতেন— মানুষটি বিকৃত হলেও অমানুষ নয়। বঙ্কিম আরও লিখছেন, “তিনি নিমচাঁদ দত্তের ন্যায় বিশুষ্ক-জীবন-সুখ বিফলীকৃতশিক্ষা, নৈরাশ্যপীড়িত মদ্যপের দুঃখ বুঝিতে পারিতেন, বিবাহ বিষয়ে ভগ্ন-মনোরথ রাজীব মুখোপাধ্যায়ের দুঃখ বুঝিতে পারিতেন, গোপীনাথের ন্যায় নীলকরের আজ্ঞাবর্ত্তিতার যন্ত্রণা বুঝিতে পারিতেন।” বস্তুত, তাঁর মতো পরদুঃখকাতর মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
পরদুঃখকাতরতা দীনবন্ধুর সাহিত্যের দোষও বটে। রুচির দোষ। সহানুভূতি বিনা চরিত্র অঙ্কন অসম্ভব, কিন্তু কলঙ্কিতকে আঁকতে গিয়ে সহানুভূতিতে লাগাম পরাতে না পারলে সমূহ বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা, দীনবন্ধুর সাহিত্যকীর্তি কিয়দংশে যে দোষে দুষ্ট। তোরাপের রাগ কিংবা আদুরীর রহস্য তিনি দেখিয়েছেন, কিন্তু যে ভাষায় তারা রাগ বা রহস্য করে, তা কি বাদ দেওয়া যেত না? নিমচাঁদের মাতলামি দেখানোর জন্য তার ভাষাও অক্ষরে অক্ষরে বসিয়ে দেওয়া কি অবাঞ্ছিত নয়? আস্ত একখানা তোরাপ-আদুরী-নিমচাঁদ সৃষ্টি দীনবন্ধুর সাহিত্যিক মুনশিয়ানার অভাবই প্রকট করে। তাঁর মতো নরম মনের মানুষেরা হয়তো সহানুভূতির দাস হন, চরিত্রের সবটুকু তাঁর ঘাড়ে চেপে বসে, কিন্তু তাতে শিল্পগুণ খর্ব হয়।
দীনবন্ধুকে অবশ্য দোষারোপ করব না। তাঁর বন্ধুরা স্মরণ করেছেন, গুণবান ও সুলেখক পরিচয়ের চেয়ে অনেক বড় কথা তাঁর অন্তঃকরণের মহত্ত্বটি। অহঙ্কার-অভিমান-ক্রোধ-স্বার্থপরতা-কপটতা যিনি জয় করতে পারেন, এমন মানুষ সংসারে অতি বিরল। তাই তিনি যেখানেই যেতেন, বন্ধু জুটে যেত অজস্র। কোথাও তাঁর যাওয়ার খবর শোনা গেলেই আলাপে উৎসুক হতেন বহু মানুষ। এবং আলাপ হলেই মিত্রতা। স্বভাবনিন্দুক বা স্বার্থান্বেষী ছাড়া দীনবন্ধুর তেমন শত্রু ছিল না। শোনা যায়, দীনবন্ধুর গৃহসুখ ছিল ঈর্ষণীয়। চিরকাল বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতেন, তবু স্ত্রী ও আট সন্তানকে নিয়ে দীনবন্ধুর সংসারে কলহ বস্তুটি নাকি প্রায় অনুপস্থিতই ছিল।
প্রসঙ্গত বলি, দীনবন্ধু রচিত প্রথম কবিতা মানব-চরিত্র। তাঁর সুহৃদ স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছেন— “মানব-চরিত্র-ক্ষেত্রে নেত্র নিক্ষেপিয়া।/ দুঃখানলে দহে দেহ, বিদরয়ে হিয়া।।”
সমাজ-দর্পণ
‘নীল-দর্পণ’এর ভূমিকায় দীনবন্ধু লিখছেন, “নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ২ মুখ সন্দর্শনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্ত্তে পরোপকার-শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা।” ‘নীল-দর্পণ’ দীনবন্ধুর প্রথম নাটক এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ— যে জন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে অমর। এই নাটক তাঁর প্রতিনিধিস্থানীয়ও বটে— পরদুঃখকাতরতার ফল। এই নাটকের মাধ্যমেই বহুলাংশে তাঁর সাহিত্য-পরিচয় জ্ঞাপন সম্ভব।
গ্রামেগঞ্জে ঘুরতে ঘুরতেই নীলকর-দৌরাত্ম্যের কথা জানতে পারেন দীনবন্ধু। তাঁর মনে হয়, বঙ্গীয় প্রজাদের স্বার্থেই এই গোলযোগ নথিভুক্ত করা উচিত। এ-ও জানতেন, ‘নীল-দর্পণ’এর লেখক পরিচিতি প্রকাশিত হলে তাঁর সমূহ অনিষ্টের আশঙ্কা। অতএব ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত নাটকে লেখকের নামের জায়গায় লেখা হল— ‘নীলকর-বিষধর-দংশন কাতর-প্রজানিকর / ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভিপ্রণীতং’। সেই পথিকের নাম জানতে অবশ্য বঙ্গীয় প্রজাদের দেরি হয়নি। ‘নীল-দর্পণ’ প্রচারে রাখঢাক করেননি দীনবন্ধু, নাম গোপন রাখতেও যত্নবান হননি। এই নাটক নিয়ে তিনি নিজে বিপদে না পড়লে অনেকেরই সঙ্কট ঘনিয়ে এসেছিল। নাটকের বাস্তবতা লোকহিতৈষী শিক্ষিত সমাজকে স্পর্শ করেছিল, নীলকরদের অত্যাচারে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন ভদ্র ও বিশিষ্ট ইংরেজরাও। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দিয়ে ‘নীল-দর্পণ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করান রেভারেন্ড জেমস লং, তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক, এক মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় পাদ্রি লং-এর। ইতিহাসের পাতায় উঠে যায় ‘নীল-দর্পণ’। তার আলোড়নে নীলচাষ বন্ধ না হলেও নীল-বিদ্রোহের ফলে জমিদারি প্রথায় বিপর্যস্ত বাংলার চাষিদের অসন্তোষ আরও দানা বাঁধে। সেই ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই একশো বছর পরেও রঙ্গালয়ে অভিনীত হয় এই নাটক।
এর পরেও দীনবন্ধু বহুলাংশে বিস্মৃত— কারণটি তিনি নিজেই। তিনি যা দেখতেন, তা-ই লিখতেন। বিশেষ করে অত্যাচারিতের পক্ষে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল না, সামাজিক সমস্যা বা তত্ত্ব নিয়েও সচেতন ছিলেন না। ছিল না গভীর জীবনদর্শনও। রোম্যান্স বা কবিত্বেও তত পটু ছিলেন না। তাই কৃষক সমাজকে এত ভাল করে, জানার পরেও একটি নাটকের গণ্ডিতেই বাঁধা পড়ে গেলেন। রুশ চাষিদের চরিত্রস্রষ্টা লিয়ো তলস্তয় বিশ্ব সাহিত্যে কিংবদন্তি। সভ্যতায় চাষি সমাজের মৌলিক তাৎপর্য বুঝতেন তিনি। দীনবন্ধু বুঝতেন না, রয়ে গেলেন অগোচরেই। গোপাল হালদার লিখছেন, “...বুঝে-না-বুঝে নীলকরদের অত্যাচার দেখিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ একটা গুরুতর নাটক তিনি লিখে ফেলেছিলেন।”
আর এক গুরুতর নাটক ‘সধবার একাদশী’। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘শাস্তি কি শান্তি’ নাটক দীনবন্ধুকে উৎসর্গ করতে গিয়ে লিখেছেন, “মহাশয়ের নাটক যদি না থাকিত, এই সকল যুবক মিলিয়া ন্যাসানাল থিয়েটার স্থাপন করিতে সাহস করিত না। সেই নিমিত্ত আপনাকে রঙ্গালয়-স্রষ্টা বলিয়া নমস্কার করি।” চিত্রাঙ্কনে, বহুদর্শিতায়, বাস্তবতায়, হাস্যরসের সৃষ্টিতে দীনবন্ধুর কৃতিত্ব এবং সমাজের জীবন্ত সমস্যাকে নাটকের প্রধান বিষয় করে তোলায় তাঁর মুনশিয়ানা এ নাটকেও পরিস্ফুট। যদিও মুক্ত নয় পূর্বোল্লিখিত দুর্বলতাগুলি থেকেও।
‘নীল-দর্পণ’ নাটকের প্রচারে রাখঢাক করেননি ।
ঐন্দ্রজালিক হাস্যরস
“এলোচুলে বেণে বউ আল্তা দিয়ে পায়,/ নলক নাকে, কলসী কাঁকে, জল আন্তে যায়।” দীনবন্ধুর এই কবিতা পড়লে বোঝা যায় যে, সংবাদপ্রভাকর-এর সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের অনুবর্তী হয়েই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির সূচনা। বাংলা সাহিত্যে চার জন রহস্যপটু লেখকের কথা বলেছিলেন বঙ্কিম— টেকচাঁদ, হুতোম, ঈশ্বর গুপ্ত ও দীনবন্ধু। দ্বিতীয় প্রথমের শিষ্য, চতুর্থ তৃতীয়ের। ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে দীনবন্ধুর পার্থক্য ছিল রসসৃষ্টিতেই। প্রথম জন ব্যঙ্গের উপরে নির্ভরশীল, দ্বিতীয় জন হাস্যরসে।
প্রশ্ন উঠত প্রায়ই, “মধুসূদন দত্ত কি নিমচাঁদ দত্তের মূল?” লেখকের উত্তরও পরিচিত, “মধু কি কখনও নিম হয়?” এখানে ‘সধবার একাদশী’-র রসবিচার উদ্দেশ্য নয়, বরং দীনবন্ধুর হাস্যরসবোধের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা। গল্প শোনা যায়, তিনি যে সভায় বসতেন, তার জীবনস্বরূপ হতেন, সুমিষ্ট ও সরস কথায় সবাই মুগ্ধ হত, দুঃখ ভুলে হাস্যরস-সাগরে ভাসত। এমনকি কেউ কেউ নাকি ‘আর হাসতে পারছি না’ বলে পালিয়েও যেত! এই মূর্তিমান হাস্যরসের সম্যক পরিচয় তাঁর রচনাবলি নয়, বক্তৃতামালা। খেদের বিষয়, সে বস্তু গ্রন্থিত হয়নি।
জীবনসায়াহ্নে তাঁর হাস্যরসপটুতা মন্দীভূত হয়েছিল। এক বন্ধু এক দিন জানতে চেয়েছিলেন, “দীনবন্ধু তোমার সে হাস্যরস কোথা গেল? তোমার রস শুখাইতেছে, তুমি আর অধিক কাল বাঁচিবে না।” সত্যিই, তার পর আর বেশি দিন বাঁচেননি দীনবন্ধু। প্রথমে দেখা দেয় বহুমূত্র রোগ, তার পর কার্বাঙ্কল। দেহের নানা জায়গায় ফোঁড়া হতে থাকে। শেষ ফোঁড়াটি হয় বাঁ পায়ে। সে সময়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন হাস্যরস সম্পর্কে সন্দিহান সেই বন্ধু। অশক্ত দীনবন্ধু ক্ষীণকণ্ঠে জানান, “ফোঁড়া এখন আমার পায়ে ধরিয়াছে।” মাথাটা একই রকমই সচল। রসবোধও।
আসলে, যাঁরা দীনবন্ধুর রচনায় ‘রুচির দোষ’ দেখতে পেয়েছিলেন, সেই হাস্যরসকে বলেছিলেন ‘জঘন্য’, তাঁরাও দীনবন্ধুর দৈনন্দিন স্বচ্ছন্দ রসিকতার বোধ উল্লেখ করতে ভোলেননি। এর কারণ কিছুটা ধরা যায় সুশীলকুমার দে-র আলোচনা থেকে। তিনি লিখছেন, “দেশকাল দ্বারা পরিচ্ছন্ন বাঙালী জীবনের বিশিষ্ট রূপটি বোধ হয় আর কাহারও রচনায় এরূপ সুস্পষ্টভাবে মর্মস্পর্শী হয় নাই। দীনবন্ধু প্রাণে মনে খাঁটি বাঙালী ছিলেন, তাই দোষ-ভরা, গুণ-ভরা, হাসি-ভরা, কান্না-ভরা বাঙালীকে তিনি বুঝিতেন এবং তাহার জীবনের সঙ্গে তাঁহার সংযোগ ছিল আন্তরিক।”
বাঙালি বলে দীনবন্ধুকে কম হেনস্তা হতে হয়নি। বস্তুত বাঙালি নয়, কৃষ্ণচর্মই ছিল বৈষম্য ও অন্যায়ের কারণ। তদ্সত্ত্বেও কখনও নিজেকে পাল্টানোর কথা ভাবেনওনি। শেষ জীবনে প্রতিকূলতা সয়েও অক্ষুণ্ণ রেখেছেন স্বকীয় সত্তাটি— রসিকতার অভ্যেসটি। রঙ্গব্যঙ্গের অভাবনীয় সমাবেশ, দুর্লভ বিদ্যার্জিত ভাবনা এবং বুদ্ধিশাণিত বাক্চাতুর্যের সমারোহ— এই হল খাঁটি বাঙালি রসিকতা। এই দীনবন্ধুর রসিকতা। বাংলার মাঠে-ঘাটে ও অন্তঃপুরে ভাবে-ভাষায় তিনি সকলের সঙ্গী— সর্বজ্ঞ ও রসজ্ঞ। তাই তো বাংলা সাধারণ নাট্যশালার শতবর্ষপূর্তির উৎসবে (৭ ডিসেম্বর ১৯৭২) তৎকালীন নাট্যরসিকদের অনেকেই দীনবন্ধুকে চিহ্নিত করেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম আধুনিক নাট্যকার হিসেবে— নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘রঙ্গালয়-স্রষ্টা’।
ঋণ: দীনবন্ধু রচনাসংগ্রহ (প্রধান সম্পাদক: গোপাল হালদার); রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী ও গ্রন্থাবলীর সমালোচনা: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; দীনবন্ধু মিত্র: সুশীলকুমার দে; সাহিত্যসাধক চরিতমালা, নং ১৯: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়