Jyotirindranath Tagore

Jyotirindranath Tagore: ‘নূতন দাদা’র আঁকা পেনসিল প্রতিকৃতির কোলোটাইপ মুদ্রিত ছবি

সম্প্রতি ‘আর্ট অলিন্দ’র পক্ষ থেকে কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য এই কোলোটাইপ গ্রন্থটিতে মুদ্রিত ছবিগুলির একটি অনলাইন প্রদর্শনী সম্পন্ন করলেন।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৪৩
Share:

প্রতিকৃতি: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্ম (বাঁ দিক থেকে: কাদম্বরী দেবী ও প্রজ্ঞা দেবী)

তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাকে লন্ডন থেকে লিখছেন, ‘আপনার ছবির খাতা আমি Rothenstein-কে দেখিয়েছি।... তিনি দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেছেন। তিনি আমাকে বল্লেন, আমি তোমাকে বলছি, তোমার দাদা তোমাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রী।... most marvellous, most magnificent. এই তো তাঁর মত।... আপনার ছবি এখানে যাঁরাই দেখেছেন, সকলেই খুব প্রশংসা করেছেন। রোথেনষ্টাইন খুব একজন গুণজ্ঞ লোক... ২৯ ভাদ্র ১৩১৯, আপনার স্নেহের রবি।’

Advertisement

১৩৫৯-এর ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। উপরে সংক্ষেপে তারই কিছুটা অংশ।

পেনসিলে আঁকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি প্রতিকৃতি নিয়ে উইলিয়ম রোথেনস্টাইন একটি কোলোটাইপে মুদ্রিত গ্রন্থের কথা ভাবেন। তাঁর এই ইচ্ছের কথা রবীন্দ্রনাথকেও জানান। শেষ পর্যন্ত লন্ডন থেকে ১৯১৪-তে প্রকাশিত হয় ‘টোয়েন্টিফাইভ কোলোটাইপস ফ্রম দ্য অরিজিনাল ড্রয়িংস বাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ টেগোর’। বইটির মুদ্রক এমেরি ওয়াকার লিমিটেড, প্রকাশক ছিলেন হ্যামার স্মিথ। ভূমিকায় রোথেনস্টাইন এক জায়গায় জানিয়েছিলেন যে, ‘সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দে ইউরোপীয় চিত্রকরদের কাজে নারীর এমন একটি প্রাণহীন চরিত্র মুছে যাওয়া পড়ে পাওয়া ছাঁদ আরোপিত হয়েছিল যে, সহজতায় ও সততায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাজের তুলনা মেলে শুধু আরও পূর্ববর্তী ড্যুরার বা হলবিয়েনের আঁকা প্রতিকৃতি চিত্রে।’ যদিও ঠাকুর পরিবারের বহু গুণীরই সমাবেশ এ সব চিত্রে।

Advertisement

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে বিশেষ করে কলকাতায় তাঁর কোনও প্রদর্শনী হয়নি। সম্প্রতি ‘আর্ট অলিন্দ’র পক্ষ থেকে কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য এই কোলোটাইপ গ্রন্থটিতে মুদ্রিত ছবিগুলির একটি অনলাইন প্রদর্শনী সম্পন্ন করলেন। তাঁর ইচ্ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আরও ড্রয়িং-সম্বলিত প্রদর্শনী ‘চারুবাসনা’ গ্যালারিতে উপস্থাপন করবেন। অনলাইন প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য দু’টি। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের শিল্পকলার পিছনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি বিরাট প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। যাঁর নিজেরই এত সব চমৎকার পোর্ট্রেট কত জনই বা সে ভাবে দেখেছেন? দ্বিতীয়ত, জ্যোতির্ময়ের নিজের দুষ্প্রাপ্য সব সংগ্রহের মধ্যে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত এই অরিজিনাল কোলোটাইপে মুদ্রিত ছবিগুলি-সহ একটি অতি দুষ্প্রাপ্য সংস্করণও আছে। যা থেকে আসে এই প্রদর্শনীর ভাবনা।

গগনেন্দ্রনাথ।

এই ২৫টি ছবির সবগুলিই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন পেনসিলে। তার পর লন্ডনে রোথেনস্টাইনের পরিকল্পনায় এটির কোলোটাইপ সংস্করণ হয়। কারণ, তিনি ভূমিকার শেষে বলেইছিলেন যে, ‘সমসাময়িক প্রতিকৃতি-চিত্রের এমন নিদর্শন আমার অল্পই জানা আছে।’ কোলোটাইপ ড্রাইক্রোমেট বেসড ফোটোগ্রাফিক্স প্রসেসে যা মুদ্রিত।

১৮৫৫ সালে ফরাসি রসায়নবিদ, আলোকচিত্রী ও বাস্তুকার আলফান্সে পইতেভিন কোলোটাইপ উদ্ভাবন করেন। তিনি ফোটোগ্রাফকে প্রস্তরখণ্ডের সমতলীয় স্থানে ‘লাইট সেনসিটিভ জিলেটিন’ লাগিয়ে, ফোটো নেগেটিভ এক্সপোজ় করতেন এবং লিথোর পদ্ধতিতে ছাপ নিতেন। পরবর্তী কালে এই পদ্ধতির অনেক বিবর্তন ঘটে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছবিগুলি সবই বাঁ দিকে ফেরানো প্রোফাইল পোর্ট্রেট। পেনসিলের রেখার সূক্ষ্মতা, লাবণ্যময় রেখাঙ্কন, সামান্য স্ট্রোক-সম্বলিত লাইন, কিছুটা ঘষামাজা, বিশেষ করে চুল-দাড়ি-গোঁফ ইত্যাদির ক্ষেত্রে। গাঢ়ত্ব সে ভাবে নেই বললেই চলে। প্রতিটি মুখের ভাব ও চরিত্রকে ভারী সুন্দর সংবেদনশীলতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরাও তো ছবি আঁকি, কিন্তু ছেলে বুড়ো আপনার পর ইতর ভদ্র সুন্দর অসুন্দর নির্ব্বিচারে এমন ক’রে মানুষের মুখকে যত্নের সঙ্গে দেখা এবং আঁকা আমাদের দ্বারা তো হয় না, আমরা মুখ বাছি!’

যদিও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এমন বাছাবাছি ছিল না। পরিবারের বাইরের বহু অতি-বিখ্যাতদেরও তিনি এঁকেছেন। এই বইয়ের ছবিতে সৌদামিনী দেবী, কাদম্বরী দেবী, জগদানন্দিনী, শরৎকুমারী, ইরাবতী, সরোজা দেবী, বলেন্দ্রনাথ (পুত্র), বিবি, অরুণেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবন, গগন, নীতীন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবী, গুণেন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, প্রজ্ঞা দেবী (হেমেন্দ্রনাথের কন্যা)... এমন আরও কয়েক জনের ড্রয়িং আছে।

রবীন্দ্রনাথের সেই লাইনগুলিই এগুলি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়— ‘এই যে নিছক দেখবার জগৎ ও দেখাবার আনন্দ, এর মর্মকথা বুঝবেন তিনি— যিনি যথার্থ চিত্রশিল্পী।’ সাধে কি রোথেনস্টাইন বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণির ড্রয়িং যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গেই ওঁর তুলনা হতে পারে।’ এ-ও তিনি বলেছিলেন যে, ‘বিদেশি আমরা বঙ্কিমের কাহিনিতে যে বাঙালি-চরিত্রের বর্ণনা পাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছবিতে তাই যেন চোখ ভরে দেখতে পেলাম।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement