painting

প্রায় দুশো ছোঁয়া শিল্পকৃতির পুরস্কারের আঙিনায়

মাঝারি মানের ঘনত্বের ফাইবার বোর্ড ও টুকরো-ক্ষুদ্র কাঠ সম্বলিত ‘ধালাভির’ নামের একটি রিলিফ ভাস্কর্যে চমকে দিয়েছেন মায়াধারা সাহু।

Advertisement

অতনু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:৪৭
Share:

নান্দনিক: ‘সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো’-এর চিত্রকর্ম (ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে)— এলিমেন্ট অব ভিলেজ, ডান দিকে, কনটেমপ্লেশন-টু

কলকাতার বুকেই নয় শুধু, ভারতের কোথাও এত বড় মাপের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী, অর্থাৎ শিল্পবস্তুর মানের বিচারে শুধু অ্যাওয়ার্ড নির্বাচনের কাজগুলির প্রদর্শন-উপস্থাপনার নজির নেই। একমাত্র ‘সিমা গ্যালারি’-ই এই রকম ‘সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো’ গত ২০১৫ থেকে শুরু করে আয়োজন করে আসছে। দু’বছর অন্তর আয়োজিত এই প্রদর্শনী এবার চতুর্থ বর্ষের। ‘সিমা অ্যাওয়ার্ড শো ২০২২’ এখনও চলছে ‘সিমা গ্যালারি’ ও ‘জেম সিনেমা’-র অভ্যন্তরে।

Advertisement

প্রায় ১,০০০-এর মতো জমা পড়া আবেদনপত্রের সঙ্গে শিল্পীর করা গত তিন বছরের কাজের নিজস্ব পছন্দের নমুনা পাঠানো, তার প্রাথমিক নির্বাচনের পরে মূল কাজটি (শিল্পীর অ্যাওয়ার্ডযোগ্য মনে হওয়া একটি কাজ) পাঠাতে বলা, এর পর নির্দিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলীর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন মাধ্যম-সহ অ্যাওয়ার্ড নির্বাচন করা হয়। এই রকম এক প্রণালীবদ্ধ, সুপরিকল্পিত ভাবে শিল্পবস্তুসমূহের নির্বাচনের মাধ্যমে অ্যাওয়ার্ড প্রদান শিল্পীদের প্রাণিত করে, উৎসাহিত করে সন্দেহ নেই। ‘সিমা গ্যালারি’ অত্যন্ত সুচারু ভাবে গত আট বছর ধরেই এমন আয়োজন করে আসছে। প্রদর্শনীতে চূড়ান্ত নির্বাচন ছিল ১৮৩টি শিল্পকর্ম।

এমন একটি বড় মাপের প্রদর্শনী জানিয়ে দিল যে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তরুণতর শিল্পীরাও মাধ্যম নিয়ে কী সব দুঃসাহসিক ভাবনাচিন্তা করছেন। সে ভাবে কাজটির গভীরে ঢুকে, আরও খুঁড়ে বার করে আনতে চাইছেন যেন অনেক শৈল্পিক রূপারোপ, যা একই সঙ্গে তাঁদের ভাবনাচিন্তার বস্তুনিষ্ঠ দিক থেকে নির্মাণ পদ্ধতির একটি ‘প্যাটার্ন অব নিউ ক্রিয়েশন’। আকার-বিস্তারের দিক থেকেও মূল ডিসপ্লে-র রিপ্রেজ়েন্টেশন। বিশেষত, ইনস্টলেশনের ডিসপ্লে, স্পেস, লাইট, মিউজ়িক (প্রয়োজন অনুযায়ী) ইত্যাদির ক্ষেত্রে।

Advertisement

মাঝারি মানের ঘনত্বের ফাইবার বোর্ড ও টুকরো-ক্ষুদ্র কাঠ সম্বলিত ‘ধালাভির’ নামের একটি রিলিফ ভাস্কর্যে চমকে দিয়েছেন মায়াধারা সাহু। সমগ্র কাজটির সূক্ষ্মতা, নিখুঁত সব আলঙ্কারিক ডিজ়াইন দেখে আপ্লুত হতে হয়। শচীন ভাস্কররাও কাম্বলের কাজটিতে অনেকটাই শমীন্দ্রনাথ মজুমদার ও প্রভাকর কোলটের উপস্থিতি। ইঙ্ক, গোল্ডেন ফয়েল শিটে করা সৌগত দাসের ‘ইলেজিবল’ কাজটি অভিনবত্বের দাবি রাখে। ওই ‘দুষ্পাঠ্য’ স্টাইলিস্টিক লেটার অসাধারণ। আনন্দ প্রকাশের ‘দি ইগল’ অ্যাক্রিলিকে ক্যানভাসের কাজটিতে ডানার বিবর্তিত বিস্তার ও মোনোক্রোম-জাত টেকনিকে স্পেস-ছাড়া রচনাটি অসাধারণ। পি এ সাজিশের ক্যানভাস-কাগজে চারকোলে করা ‘জার্নি’, রজনী আর্যর ৬-টি কাজের সেট ‘আ পিক ইনটু মাই আনকনশাস’, অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জলরং ‘দ্য হাউস ইজ় করোনা পজ়িটিভ’, জয়িতা বড়াইয়ের ‘লকডাউন কেওস’, পঙ্কজ বসাকের ‘লকডাউন ফেস’, সুমন চন্দ্রর ‘ব্ল্যাক গ্রেভ-টু’, অত্রি চেতনের উডকাট ‘এনক্লোজ়ার অ্যান্ড ওপেনিং-থার্টিন’, ভগারাম চৌধরির ‘গুডমর্নিং’, গণেশ মোহন শিন্দের অসাধারণ অ্যাক্রিলিক ‘আনটাইটেলড’, চন্দ্রশেখর ভি ওয়াঘমারের উডকাট ব্লকের ‘নিঃশব্দ’ অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত।

অপেক্ষাকৃত বড় মাপের একটি কয়লার গায়ে কুরে কুরে আধা বর্তুল ডিজ়াইন-সমৃদ্ধ ‘কোল’ নামে চমৎকার কাজ করেছেন মহেশ বিশ্বকর্মা। সোনাল ভার্সনেয়া’র ২৫টি প্লেটে করা এচিং ‘কিসসা গোয়ি’ অনবদ্য নিদর্শন। যদিও রঙিন ছাপচিত্র, কিছুটা সচিত্রকরণধর্মী, তবু এই কাজটি যথেষ্ট জোরালো। উন্নত মানের একটি গ্রাফিক্স। এর মাধ্যমে শিল্পী একটি অর্থবহ সোশ্যাল মেসেজ রেখেছেন। শতবিন্দর কৌর সিংহের উডকাট ‘কনটেমপ্লেশন-টু’ কাজটি দেখে হঠাৎ খানিক হলেও অর্পিতা সিংহের কথা মনে পড়ে। অসাধারণ গ্রাফিক্সের কাজ। নম্র বর্ণের পটভূমিতে দৃশ্যায়নের মাঝে সাদা শরীরের নারীর কম্পোজ়িশন অনবদ্য। আর একটি চমৎকার গ্রাফিক্স লখিন্দর সিংহের পাঁচটি প্লেট সম্বলিত খয়েরি-বাদামি রঙের এচিং ‘হোম কোয়রান্টাইন’। জলরং ও গ্রাফাইটে করা ১২টি অংশে সত্যরঞ্জন দাসের ‘ফেনোমেনন’ অত্যন্ত মনোগ্রাহী কাজ। গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং রচনার স্টাইলের দিকটি চোখ টেনে রাখে, মনও। শ্রীহরি দত্তর জলরং মাধ্যমে ব্রাউন রঙে করা ‘নেচার-থ্রি’র ট্রিটমেন্ট ভারী সুন্দর।

এ ছাড়া অমিত দাসের উড-স্কাল্পচার ‘কোলাজ অব স্টাডি’, সদ্যপ্রয়াত সুমন্ত দে’র একটি মিশ্রমাধ্যমের ইনস্টলেশন (বৈদ্যুতিক ভাবে ঘূর্ণায়মান) ‘সিনথেটিক মেমোয়ার্স’ যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। খোকন গিরির এচিংয়ের আধুনিক ‘ল্যান্ডস্কেপ’, অভিজিৎ পালের ক্যানভাসে টেম্পারা ‘ব্লাড মুন ডান্স’ (স্ক্রোল পেন্টিং) রাজপুত অণুচিত্রের অনুসরণে করা বেশ ভাল কাজ। কুণিকা বীজেন্দ্র পাঠকের ভিস্কোসিটি-এচিং ‘সিটিস্কেপ’ গাইতোন্ডের পেন্টিং ভীষণ ভাবে মনে পড়ায়। অভিজিৎ কুমার পাঠকের ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যম ‘আনটাইটেলড-ফাইভ’ ও চন্দ্রপল পাঁজরের ‘এলিমেন্ট অব ভিলেজ’ (কাঁথা স্টিচ অন ফেব্রিক) কাজ দু’টি আলাদা ভাবে মনে রাখার মতো। এ ছাড়া, কার্তিক কামিলার এচিং ‘উইভিং’, যশোবন্ত সিংহের ‘ফ্লায়িং বডি ইন ল্যান্ডস্কেপ’, সায়ন্তন সামন্তর ‘কংক্রিট ডিনার’, নীরজ সিংহ খান্দকার উডকাটের ছ’টি প্রিন্টে (সাদাকালো) ‘লাইফ ইন দ্য লকডাউন’, ভারতী ভার্মার অয়েলে করা ‘গ্লান্স’, সুষমা যাদবের এচিং ‘লাস্ট সাপার’, সঙ্গীতা কোডিমাল্যর চারকোলে করা ‘লাম্বার সাপোর্ট’, কাঞ্চন কার্জীর মিশ্রমাধ্যমের ভাস্কর্য ‘ইন্ডিভিজুয়াল স্পেস’, হরিশকুমার ওঝার ‘ফার্টাইল সয়েল’, শান্তিনাথ পাত্রর ‘ক্যাডাভার-টু’ এই প্রদর্শনীর অন্যতম উজ্জ্বল উদ্ধার।

এ ছাড়া যে কাজগুলি এই প্রদর্শনীর সামগ্রিক মান ও অভাবনীয় দৃষ্টান্তের বিশেষ সংকেত বহন করছে, তা হল শুভঙ্কর বাগের ‘আফটার থটস’, সোনম সিকারওয়ারের ‘রিফ্লেকশন অফ ওয়র্ল্ড’, সুরজিৎ বিশ্বাসের ‘ব্লুমিং মেটাফর’, রিমা ছারির ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্স’, রীতেশ চন্দ্রকান্ত রাজপুতের ‘স্ট্রাগল’, জ্যোতিপ্রকাশ শেট্টির ‘আনটাইটেলড’, শিবানন্দ সাগোতির ‘নন-ট্রান্সপারেন্ট’, নীলেশ প্রকাশ সাহারকরের ‘আনটাইটেলড-ফোর’, গাভারা সত্যনারায়ণের ‘সেল্ফ রিয়েলাইজ়েশন’। অসাধারণ সব কাজ। সমগ্র প্রদর্শনীটিই মনে রাখার মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement