চাটুজ্জেদের বাড়ি

নৈহাটি স্টেশন থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে বসতবাড়ি বঙ্কিমের। বঙ্কিমের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহ রঘুদেব ঘোষালের সম্পত্তি লাভ করে এক সময় কাঁটালপাড়ায় চলে আসেন। ১৮৪০ সালে এই কাঁটালপাড়াতেই বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটি বানা়ন বঙ্কিম-পিতা যাদবচন্দ্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

নৈহাটি স্টেশন থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে বসতবাড়ি বঙ্কিমের। বঙ্কিমের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহ রঘুদেব ঘোষালের সম্পত্তি লাভ করে এক সময় কাঁটালপাড়ায় চলে আসেন।

Advertisement

১৮৪০ সালে এই কাঁটালপাড়াতেই বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটি বানা়ন বঙ্কিম-পিতা যাদবচন্দ্র।

এই বাড়িতেই ১৮৩৮ সালের ২৬ জুন জন্ম নেন বঙ্কিমচন্দ্র। যাদবচন্দ্রের তৃতীয় পুত্র।

Advertisement

দোর্দণ্ডপ্রতাপ যাদবচন্দ্র পরম নিষ্ঠাভরে হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। ছেলেদের ভিতরেও সেই ভাবকে তিনি সঞ্চারিত করে গিয়েছেন।

যাদবচন্দ্র রক্ষণশীল। কিন্তু অদ্ভুত, সে আমলে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়ে নন্দরানীকে কিন্তু সম্পত্তির ভাগ দিয়েছেন।

নন্দরানীর বিয়ে হয় রেলকর্মী শশীশেখর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শশীশেখরের কর্মস্থল ছিল বিহারের বাঁকিপুর।

মেয়েকে কাছাকাছি রাখার ইচ্ছেয় নিজের বাড়ির কাছে একটি একতলা বাড়ি করে দেন যাদবচন্দ্র।

মেয়ের প্রতি যাদবের ছিল পরম নির্ভরতাও। মারা যাওয়ার তিন দিন আগে কুলপ্রথা অনুযায়ী যাদবচন্দ্রকে অন্তর্জলী যাত্রা করানো হয়।

তাঁকে নৈহাটির গঙ্গার ঘাটে একটি ঘরে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুকালে যাদবচন্দ্রের সন্তানদের মধ্যে একমাত্র নন্দরানীই তাঁর কাছে যেতে পেরেছিলেন।

নন্দরানীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে কৈলাসচন্দ্র মায়ের বাড়িটি রেল কোম্পানিকে বিক্রি করে চুঁচুড়ায় চলে যান।

সে অবশ্য অন্য কাহিনি।

বঙ্কিমদের রথ , গৃহদেবতা

১৮৬৬ সালে বসতবাড়ির দক্ষিণ দিকে নিজস্ব বাগানে একটি বৈঠকখানা নির্মাণ করেন বঙ্কিমচন্দ্র।

কালক্রমে এই বৈঠকখানাই হয়ে ওঠে বাংলা নবজাগরণ-এর অন্যতম পীঠস্থান।

এই হলঘরেই বসত ‘বঙ্গদর্শনের মজলিস’। মজলিসকে কেন্দ্র করে শনি-রবিবারে আসতেন বিখ্যাত সব দিকপাল। কবি নবীনচন্দ্র সেন, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, দীনবন্ধু মিত্র, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়...। এঁদের মধ্যমণি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

বঙ্কিম এই ঘরে বসেই লিখেছিলেন ‘বন্দেমাতরম’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ সমেত বহু বিখ্যাত প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গদর্শন, প্রচার, ভ্রমর পত্রিকা।

১৮৬২ সালে কাঁটালপাড়ায় প্রথম আরম্ভ হয় রথের মেলা। আর সেই বছরই বেঙ্গল রেলের উদ্বোধন। ট্রেন চলে দমদম থেকে রাণাঘাট।

বঙ্কিমের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী আনন্দমোহিনীদেবী এই বাড়িতে থাকাকালীনই স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যান।

যে সময় বাংলায় বহু বিবাহ ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন চলছে, নারী শিক্ষা নিয়ে বিদ্যাসাগর দিকে দিকে দৌড়চ্ছেন তখন কাঁটালপাড়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবার কিন্তু রক্ষণশীলতার বেড়াজালে বন্দি।

বঙ্কিম পরিবারের কোনও নারীই তখন বিদ্যালয়মুখী হননি। এমনকী এ বাড়িতে বাল্যবিবাহও হতো। বঙ্কিমেরই বিবাহ হয় দশ বছর আট মাস বয়সে।

এই বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসেন তিন বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে।

বঙ্কিমের আঁতুড়ঘর

প্রথম স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বড় কন্যা কমলা। তাঁর বিবাহ হয় বঙ্কিমের বড় মেয়ে শরৎকুমারী দেবীর ছোট ছেলে শুভেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শুভেন্দুসুন্দর মারা যান টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে।

বিয়ের সময় কমলার বয়স নয়। দশ বছরেই স্বামীহারা।

স্যার আশুতোষ মেয়ের দ্বিতীয় বার বিয়ে দিতে চাইলে বঙ্কিমের স্ত্রী রাজলক্ষ্মীদেবী বাধা দেন। বিপন্ন আশুতোষ মেয়ের অভিভাবকত্ব আদায়ের জন্য আদালতে মামলা করেন। বিরোধ চরমে ওঠে। এই বিরোধ দুটি পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। গোঁড়া রক্ষণশীলরা পুণর্বিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে লেখা প্রকাশ পেতে থাকে। রাসবিহারী ঘোষ, উত্তরপাড়ার জমিদার প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন আশুতোষের পক্ষে। অন্য দিকে সুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন বঙ্কিম-পত্নীর পক্ষে।

এখানে লক্ষ করার বিষয় হল, প্যারিমোহন কিন্তু ছিলেন বঙ্কিম-পরিবারের আত্মীয়। বঙ্কিমের মেজ মেয়ে নীলাব্জকুমারীর শ্বশুরমশাই।

শিব মন্দির

রায় আশুতোষের পক্ষে যায়।

মামলায় জিতে আশুতোষ তাঁর মেয়ের বিয়ে দেন এক উকিলের সঙ্গে। কিন্তু আবার বিপর্যয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবারও বিধবা হন মেয়ে।

বঙ্কিম-পরিবারে দ্বিতীয় বিখ্যাত পরিবারের বধূ হলেন সরলাদেবী। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। বিবাহ হয় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় ছেলে বিপিনচন্দ্রর সঙ্গে।

তৃতীয় জন সুরেশ্বরীদেবী। যাঁর বিবাহ হয় বঙ্কিমের বড় দাদা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে। প্রসঙ্গত বলি, এই শচীশচন্দ্রই ছিলেন বঙ্কিমের প্রথম জীবনীকার।

যাদবচন্দ্রের উইলে সঞ্জীবচন্দ্র আর পূর্ণচন্দ্র পান বাড়ির অংশ। শ্যামাচরণ, বঙ্কিমচন্দ্র আর যাদবচন্দ্রের একমাত্র মেয়ে নন্দরানী পান জমির ভাগ। বঙ্কিম বাড়ির ভাগ পাননি বলে রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান চুঁচুড়ায়। পরে দাদা সঞ্জীবচন্দ্র নিজের বাড়ির শ্রেষ্ঠ দিকটি, দক্ষিণ দিকের অংশ বঙ্কিমের নামে উইল করে বঙ্কিমকে ফিরিয়ে আনেন।

বৈঠকখানার পিছন দিক

কিন্তু যাদবচন্দ্র কেন বঙ্কিমকে দিয়ে যাননি বাড়ির অংশ?

আসলে বঙ্কিমের কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর তিন মেয়ে। শরৎকুমারী, নীলাব্জকুমারী, উৎপলকুমারী।

বাবার বিনা অনুমতিতে বঙ্কিম কেবলমাত্র ‘ঘরজামাই’ রাখতে ঘরের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছিলেন। যাদবচন্দ্র ছিলেন ঘোর রক্ষণশীল। তিনি ঘরজামাই প্রথার বিরোধী। হয়তো তাই-ই কোনও আশঙ্কায় তিনি বাড়ির অংশ বঙ্কিমকে দিতে চাননি।

বঙ্কিমের বড় জামাই ছিলেন হালিশহরের রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই ছিলেন বঙ্কিমের ‘ঘরজামাই’। শ্বশুরমশাইয়ের সহায়তায় তিনি ‘প্রচার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। রাখালচন্দ্রের উপর বঙ্কিম অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন। বঙ্কিম রাখালের চাকরিও করে দেন। পরে নিজের যোগ্যতায় রাখাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।

অন্য দিকে সঞ্জীবচন্দ্র চাকরি ছে়ড়ে বাড়িতেই থাকতেন। তাঁর আর্থিক সঙ্গতি একবারেই ছিল না। পূর্ণচন্দ্রেরও তাই। কিন্তু পরিবারটি তো বড়। একমাত্র বঙ্কিম ও শ্যামাচরণের আর্থিক অবস্থা ভালই ছিল। শ্যামাচরণ অবশ্য নিজে বাড়ি বানিয়ে অন্যত্র চলে যান।

বঙ্কিমের জন্মভিটে দীর্ঘকাল ধরে ধ্বংসবস্তু হয়ে পড়েছিল। ১৯৮৪ সালে বাড়িটি রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র’।

বঙ্কিম দেখতে কেমন ছিলেন

বঙ্কিমচন্দ্র কেমন দেখতে ছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে একাধিক লেখকের লেখায়। রবীন্দ্রনাথ, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, নবীনচন্দ্র সেন,সরলাদেবী চৌধুরানী, দীনবন্ধু মিত্র...।

রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমকে প্রথম দেখছিলেন ১৮৭৬ সালে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মরকতকুঞ্জে, দ্বিতীয় বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়নে।

রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেন, ‘‘আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন।’’

আর এক জয়গায় বলছেন, ‘‘তাঁহার ললাটে যেন একটি অদৃশ্য রাজতিলক পরানো ছিল।’’

সাহিত্যিক চন্দ্রনাথ বসুও রবীন্দ্রনাথের মতো— বঙ্কিমকে প্রথম দেখেছিলেন কলেজ রি-ইউনিয়ন-এ।

চন্দ্রনাথ বসুর ভাষায়, ‘‘একটা বিদ্যুৎ সভাগৃহে প্রবেশ করল।’’

বঙ্কিমের সঙ্গে চন্দ্রনাথ করমর্দন প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘আমি জানতাম না আপনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর একবার করমর্দন করিতে পারি কি? সুন্দর হাসি হাসিতে হাসিতে বঙ্কিম হাত বাড়াইয়া দিলেন। দেখিলাম হাত উষ্ণ। সে উষ্ণতা এখনও আমার হাতে লাগিয়া আছে। সে হাত পুড়িয়া যায় নাই— আমার হাতের ভিতরেই আছে।’’

হরপ্রসাদ বলছেন, ‘‘তিনি বেশ সুপুরুষ ছিলেন। তাঁহার চক্ষুতে এক অসাধারণ দীপ্তি ছিল। নাকটি শ্যেনপক্ষীর মতো না হইলেও বেশ দীর্ঘ ও সুদৃশ্য ছিল। গাল দু’টি ভারী ছিল। কিন্তু তাহাতে সৌন্দর্যের কোনও হানি হইত না। চেহারাটা মানুষের একটা আকর্ষণ বটে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। বঙ্কিম নিজেই বলিয়াছেন, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। সে জয় যে তাঁহার হয় নাই, এ কথা কেহ বলিতে পারিবে না।’’

সরলাদেবী চৌধুরানীর কথায়, ‘‘দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি। মুখময় একটা সহাস্য জ্যোতির্ময়তা, জানলুম তিনি বঙ্কিম।’’

বঙ্গদর্শন

বঙ্কিমচন্দ্র কেন বঙ্গদর্শন পত্রিকা চার বছর মাত্র সম্পাদনা করে আচমকা ছেড়ে দেন, তা নিয়ে নানান মত রয়েছে।

স্বয়ং বঙ্কিম এ বিষয়ে একটি কৈফিয়ত লেখেন।— ‘বঙ্গদর্শনের বিদায় গ্রহণ’।

সেখানে বঙ্কিম বলেন, তিনি যখন বঙ্গদর্শন করেছিলেন তখন বাংলা ভাষায় ভাল সাময়িক পত্রের অভাব ছিল। কিন্তু সে অভাব পূরণ করেছিল ‘আর্য্যদর্শন’, ‘বান্ধব’ প্রভৃতি পত্রিকা।

বঙ্গদর্শন-এর গ্রাহক সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছিল। গ্রাহকরাও টাকা দিতে নারাজ ছিল না।

তবে হঠাৎ করে তিনি সম্পাদনা ছেড়ে দিলেন কেন?

সম্ভবত তিনি বাড়তি ঝুটঝামেলা বিশেষ পছন্দ করতেন না। এও চাইতেন চির অভাবী মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের একটা উপায় হোক। সঞ্জীবচন্দ্র রসিক মানুষ। বলতে গেলে এক বড় সাহেবের সঙ্গে রসিকতা করতে গিয়ে তাঁর চাকরিটি তিনি খুইয়ে ফেলেন।

সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন আবার প্রকাশিত হয়। বঙ্কিম উইল করে পত্রিকার সত্ত্ব তাঁকে দান করেন।

বঙ্গদর্শন প্রথমে কলকাতার ভবানীপুরের একটি মুদ্রাযন্ত্রে ছাপা হত। পরে বঙ্কিমের কাঁটালপাড়ার বাড়িতে মুদ্রাযন্ত্র বসানো হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement