গাঁধীজিকে দেখতে গিয়ে বুকের পাঁজর ভেঙেছিলেন

প্রেমে পড়েন এক ইহুদি কন্যার। তাঁর মধ্যে সিনেমার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন ইস্কুলের মাস্টারমশাই। এক মায়াময় শৈশব-কৈশোর জড়িয়ে তপন সিংহর বেড়ে ওঠায় প্রেমে পড়েন এক ইহুদি কন্যার। তাঁর মধ্যে সিনেমার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন ইস্কুলের মাস্টারমশাই। এক মায়াময় শৈশব-কৈশোর জড়িয়ে তপন সিংহর বেড়ে ওঠায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৬ ২২:১৩
Share:

মায়ের পাশে

বাড়ির ঠাকুর তৈরি করতে আসত গোপাল বৈরাগী। ওর গোপালদা। গোপালদা গুন গুন করে গান গেয়েই যেত।

Advertisement

তার একটা গান ছিল— ‘মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না’। বোন গীতাকে নিয়ে তন্ময় হয়ে ঠাকুর গড়া দেখতে দেখতে আর গান শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগত তখন।

অনেক পরে যখন ‘হারমোনিয়াম’ ছবি করছেন তপন সিংহ, কৈশোরের ওই গোপালদার গানটাই ঝেড়েমুছে সিনেমায় লাগিয়েছিলেন। কত যে ছবিতে গান নিজেও লিখেছেন আর সুর দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার জন্যও বোধ হয় এই ছেলেবেলাটা দায়ি।

Advertisement

বাড়ি বলতে ভাগলপুর।

আদি বাস বীরভূমে। মুরারই স্টেশনের কাছে হিলোরায়। বাবা ত্রিদিবেশচন্দ্র ছিলেন মাঝারি মাপের জমিদার। মা প্রমীলাদেবী লর্ড সিনহার পরিবারের মেয়ে। তপনের জন্মের সময় নাকি লর্ড সিনহা নিজে এসেছিলেন ওর মুখ দেখতে।

ছেলেবেলা থেকেই তপন দেখে আসছে বাড়ি গমগম করছে লোকজনে।

সে প্রায় জনা চল্লিশেক। মা-ই ছিলেন একমাত্র মহিলা-কর্ত্রী। বাড়ি আঁটোসাটো নিয়মে বাঁধা। দুপুরে বারোটার মধ্যে সক্কলকে খেয়ে নিতে হত। কাজের লোকজন খেত একটার ভেতর। এর পর মা সোজা ওপরে গিয়ে ‘ভারতবর্ষ’, নয় ‘প্রবাসী’ খুলে বসতেন।

বেলা আড়াইটে হলেই এসে পড়়ত পোস্টাপিসের ডাক পিওন হরেনদা। তার খাবারও রাখা থাকত। হরেনদা খেয়েদেয়ে চিঠি বিলি করতে ছুটত।

বাবার চোখে মায়ের ছিল দুটি দোষ। এক, লোকজন ডেকে ডেকে খাওয়ানো। আর দুই, যদি কোনও মেয়ে মাথায় করে মাছ বা সবজি বিক্রি করতে আসত, তার সবটাই কিনে নেওয়া।

মা বলতেন, একটি মেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে রোদ-বৃষ্টিতে পাঁচগ্রাম ঘুরে বেড়াবে, অসভ্য দেশ হলেই এমনটা হয়।

যারা কলেজে পড়ত, তারা গাঁয়ে পুজোয় কী গরমের ছুটিতে এলে মা তাদের রাজবংশী পড়াতেন নাইটস্কুলে। আবার কারও বাড়িতে উনুনের ধোঁয়া না উঠতে দেখলে তাকে ডেকে চাল-ডালও হাতে দিতেন।

গরমকালে গাঁ-ঘরে বড্ড গরম। বিকেল থেকেই বালতি বালতি জল ঢালা হত ছাদে। রাতে লম্বা লম্বা বিছানা করে ছাদেই শোওয়া।

বাবাকে কোনও দিন ভেতর-বাড়িতে শুতে দেখেনি তপন। বাবার তদারক করত ফণিদা আর হাকিমদা। সঙ্গে আরও ক’জন ছিল।

তারা ভরা আকাশের নীচে শুয়ে মা গান গাইত, ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিভে যায় বারে বারে।’ মায়ের কাছেই তপন শিখেছিল ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না।’ রবিঠাকুরের গান।

বাবা ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। জমিদারি মেজাজ ছিল বটে কিন্তু তার আড়ালে একটা কাব্যিক মনও লুকোনো ছিল।

সেটা তপন বুঝেছিল, যখন বাবা তাকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বাবা-ই তাকে প্রকৃতি চিনতে শেখাতেন। রাতে পাশে শুইয়ে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’ শোনাতেন। বাবা ছিলেন গাঁধীবাদী। পনেরো-বিশটা চরকা ছিল বাড়িতে। সারা দুপুর সবাই চরকা কাটত। গাঁধীজি মারা যেতে বাবা অশৌচ পালন করেন।

গোপালদার হাতে প্রতিমার দু-মাটির প্রলেপ লাগলে কলকাতা রওনা দিতেন বাবা। জওহরলাল পান্নালাল থেকে বাড়ির সকলের পুজোর জামাকাপড় কিনে তবে ফিরতেন। বাবা ফিরলেই মনে হত, পুজো এসে গেল।

ওদের পুকুর ছিল অনেক ক’টা। তার প্রত্যেকটার আবার আলাদা-আলাদা নাম। বাড়ির লাগোয়া পুকুরটার যেমন নাম ছিল ‘রানা’। তার পরেরটার নাম ‘সিদাগড়’। তার পরেরটা ‘ব্রজের পুকুর’। গ্রামের একেবারে শেষ সীমানায় ‘ময়দান দিঘি’।

ভরা ভাদরে ভাগীরথীর জল উপচে ভেসে যেত গোটা গাঁ। লোকে বলত বান এসেছে।

তেমনই এক বানের জলে এক বার কুমির এসে পড়ল পুকুরে। বাবা উঠে পড়ে লাগলেন কুমিরটাকে মারতে হবে!

নিমতিতা থেকে কুমির-ধরা বঁড়শি এল। লম্বা বাঁশে মোটা দড়ি বেঁধে বঁড়শি লাগানো হল। তাতে টোপ দেওয়া হল পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি।

বন্দুকে টোটা ভ’রে দাঁড়িয়ে রইলেন বাবা। গোটা গাঁ ভেঙে পড়ল পুকুরপাড়ে।

মরণকালে জল থেকে লাফিয়ে উঠে হাঁ মুখ করে বাবার দিকে এমন তেড়ে এসেছিল কুমির, সে-স্মৃতি তপনের কোনও কালে যায়নি।

ন’বছর বয়স হলেই তপনকে ভর্তি করে দেওয়া হয় ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে।

এম ই মানে, মিডল স্কুল। ক্লাস সেভেন অবধি। ওই পর্যন্ত পড়া হলে বিহারের যত এম ই স্কুল ছিল তার সবগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা হত। পাশ করলে হাই স্কুল।

ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের দূর সম্পর্কের মামা। সাদা শনের মতো আধা বাবরি চুল। ধবধবে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে সোনার পাঁসনে চশমা নীল সিল্কের সুতো থেকে ঝুলত গলায়।

হেড মাস্টারমশাই বেহালা বাজাতেন। স্কুলে প্রতিদিন প্রার্থনাসভায় যে-গানটি গাওয়া হত, সেটিও তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন— ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা।’ ছাত্ররা গাইত। সঙ্গে বেহালা বাজাতেন ওদের হেডস্যার। হেডস্যার স্বপ্ন দেখতেন এমই স্কুলকে একদিন হাইস্কুল বানাবেন। হলও তাই। বছর কয়েক বাদে দুর্গাচরণ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পরীক্ষা দিল প্রথম ব্যাচের জনা কুড়ি ছাত্র।

বাংলা স্কুলের পুরনো বিল্ডিং-এর পাশেই বিরাট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল। সংক্ষেপে, সিএমএস। তার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মিস্টার হার্ডফোর্ড। ছাত্রদের তিনি ক্রিকেট শেখাতেন। ক্রশ-ব্যাটে খেললে খুব রেগে যেতেন। স্কুলের কাজ সারা হলে সারাটা শহর চক্কর মারতেন সাইকেলে।

ইহুদি কোহেন সাহেবের অনেক সম্পত্তি ছিল ভাগলপুরে। বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা তাঁর আমবাগান। টাকা ধার দেওয়ারও কারবার ছিল তাঁর। সাহেবের তিন কন্যা। অতীব সুন্দরী — সেরা, ডোরা, ফ্লোরা। ওদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তাই নিয়ে তর্ক লেগে যেত বন্ধুদের মধ্যে। ডোরার টিকালো নাক, আয়ত চোখ। কোনও মেকআপ ছাড়াই তাকে সুন্দর লাগত তপনের। খুব ইচ্ছে হত পরিচয় করার, সে আর হয়ে ওঠেনি।

স্কুলে ইতিহাস আর ইংরিজি পড়াতেন গুরুদাসবাবু। বড় সুন্দর তাঁর পড়ানোর ধরন।

এক দিন ফরাসি বিপ্লব পড়াতে পড়াতে চলে এল চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিজ’-এর প্রসঙ্গ। কারণ ওই সময়ই ভাগলপুরে এক সিনেমা হলে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ ছবিটি এসেছে।

পাঠ্য বই ছেড়ে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ পড়াতে লাগলেন স্যার। দিন দুয়েক বাদে বললেন, ‘‘যাও এ বার ছবিটি দেখে এসো।’’

ওই ছবি দেখাতেই বোধহয় প্রথম বারের মতো ওর মধ্যে বীজ পুঁতে গিয়েছিল সিনেমার।

এর মধ্যে কত কাণ্ড!

গাঁধীজি এলেন ভাগলপুরে। তপন তখন ক্লাস সিক্স। ভিড়ের মাঝে গাঁধীকে দেখতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে পাঁজরের হাড় ভাঙল। কলকাতায় নিয়ে আসতে হল চিকিৎসার জন্য। তিন মাস লেগেছিল সুস্থ হতে।

সুভাষচন্দ্রও এলেন। ঝলমলে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বড় সুন্দর লেগেছিল তাঁকে।

কলেজের পাঠ শেষ করে ভাগলপুর ছাড়ল তপন ’৪৩ সালে। এ শহর তার অপরিচিত নয়। জন্মই তো কলকাতায়। বছরে দু’তিন বার আসাও হয়ে যেত এখানে। কিন্তু ’৪৩ থেকে ’৪৬ কলকাতার ছাত্রজীবন যেন দুঃসহ হয়ে দেখা দিল তাঁর কাছে।

এক দিকে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রকোপ। অন্য দিকে দুর্ভিক্ষ। ম্যালেরিয়া, মহামারী। কলকাতার রাস্তায় অনাহারে মৃত মানুষের লাশ।

’৪৬ সালে ইউনিভার্সিটি শেষ করে ঢুকলেন নিউ থিয়েটার্সে।

আজ থেকে ঠিক সত্তর বছর আগে। তার পর থেকে প্রায় শেষ দিন অবধি নাগাড়ে মনের গভীরে বয়ে গিয়েছে ছায়া আর ছবির খেলা। গুনগুন করে একটানা।

ঠিক যেন শৈশবের সেই গোপাল বৈরাগীর মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement