আট-দশ বছর আগের কথা। একগাদা মেডিকেল টেস্টের কাগজ, এক্স-রে প্লেট, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে সুচিত্রা আমার উল্টোডাঙ্গার বাড়িতে চলে এল। আমার বাড়িতে সেই ওর প্রথম, আর শেষ বার আসা! তার দিন কয়েক আগেই ফোনে বলেছিল, ‘‘বাদলদা, আমার নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। একজন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেবেন?’’
আমি সাততাড়াতাড়ি আমার পরিচিত একজন চিকিৎসকের কাছে ওকে নিয়ে গেলাম। দেখানো হল। কথা ছিল, দিন কয়েক বাদে ও রিপোর্ট করবে ডাক্তারকে। তখন কিন্তু আর সুচিত্রার দেখা নেই।
মুম্বইতে বসে টিভিতে প্রথম ওর চলে যাওয়ার খবরটা পেলাম। তার পরই সে দিনের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
বিনা নোটিসে ওর এ ভাবে চলে যাওয়াটা যেমন মেনে নেওয়ার নয়, তেমনই মনে একটা খচখচানি থেকেই যাচ্ছে— হয়তো ওর শরীর ভেঙে যাওয়ার নোটিসটা আগেই সাঁটা হয়ে গিয়েছিল, কারও চোখে পড়েনি। ওর নিজেরও নয়।
এক বার শিলচরে আনন্দ-র পুস্তক বিপণীর উদ্বোধনে গিয়েও তো বুকে ব্যথা উঠেছিল। ঠিকঠাক চিকিৎসা করাচ্ছিল তো?
মাস কয়েক আগে নৈহাটিতে পুস্তকবিপণীরই আরেকটি অনুষ্ঠানে গিয়ে যখন ওর হাত ভাঙল, মনের দিক থেকে খুব ভেঙে পড়েছিল। সে কথা জানি।
অসহ্য হাতের যন্ত্রণা নিয়ে, একের পর এক অপারেশন সামলে যখন লেখাটাই ওর মারাত্মক কষ্টের হয়ে উঠছিল। জনে জনে একটা প্রশ্ন কেবলই করত, ‘‘আমার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে না তো? আমি তা হলে কী করে বাঁচব?’’
কিন্তু তার পরেও তো ম্যাজিক দেখাল। কম্পিউটারে বসে বাঁ হাতে টাইপিং শিখল। এক আঙুলে টাইপ করে করে পুজো সংখ্যার লেখা শেষ করল। এত কিছুর পরেও মনের ভারটা বোধ হয় ওর কিছুতেই হালকা হল না। আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ওকে তাড়া করছিল।
খবর পেতাম। কিন্তু বহু দিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। ফোন করেও যে খোঁজ নেব, তা’ও হয়ে ওঠেনি। আর সত্যি বলতে কী, ওর অসুখ যে কতটা গভীর, দূর থেকে তার আন্দাজও পাইনি।
ছ’মাস আগে আমার খবর নিতে ও-ই ফোন করেছিল, ‘‘কেমন আছেন বাদলদা?’’ সেই শেষ বার। কিছুটা কুশল বিনিময়ের পর, আর বিশেষ কিছু কথা হয়নি।
১৯৯২-তে আনন্দবাজার পুজোবার্ষিকীতে ওর ‘কাচের দেওয়াল’ বেরল। ’৯৩-তে বই হয়ে বেরল সেই উপন্যাস। তার মাঝেই এক দিন ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর কলেজ স্ট্রিটের অফিসে এল সুচিত্রা। সে দিনই ওর সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি আলাপ। বলল, ‘‘বাদলদা, বইটা হবে তো?’’
তখনও সুচিত্রা সরকারি চাকুরে। ওর অফিস কাঁকুড়গাছিতে। আমার বাড়ি থেকে বিশেষ দূরেও নয়। তা বলে যে রোজ এসে ধর্না দিত, তা নয়। বরং উল্টো, বছরে বড় জোর দু’তিন বার কলেজ স্ট্রিটের অফিসে আসত। তা’ও বই, নয়তো চেক নিতে। আর পয়লা বৈশাখে নেমন্তন্ন করলে। বাড়িতে তো নয়ই।
ফোন করত। খবর নিত। বিমলদা (কর) যেহেতু আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন, ওঁর কথাও জিজ্ঞেস করত।
সুচিত্রার সঙ্গে বেশি দেখা হয়েছে বিমলদা’র বাড়িতে কিংবা আনন্দবাজারে রমাপদ চৌধুরীর ঘরের আড্ডায় গিয়ে। ওঁদের দু’জনের কাছে সুচিত্রা খুব স্নেহের ছিল।
সুচিত্রার বিরল একটা গুণ ছিল। ও এক দিকে যেমন বিমলদা-রমাপদদার মতো প্রবীণ মানুষদের স্নেহধন্যা, তেমন ওর কাছের জনের তালিকায় অসংখ্য কমবয়েসিও ছিল।
আমার মনে হয়, লেখালিখির ক্ষেত্রে এটা ওর বিরাট সুবিধে হয়ে উঠেছিল। দেখার জগৎটা ওর মেলামেশার কারণেই অনেকটা বড় ছিল।
দক্ষিণ কলকাতায় সাহিত্যিক রাধানাথ মণ্ডলদের একটা আড্ডা বসত। ‘গল্পচক্র’। ওখানে সুচিত্রার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
এই আড্ডার কবি-লেখক ছাড়া আর যারা সুচিত্রার কাছের ছিল, তারা হল শেখর বসু, রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত ... এরা। আমার ও দিকে বিশেষ যাতায়াত ছিল না।
দেশ পত্রিকার ঘরে সুনীলদাকে (গঙ্গোপাধ্যায়) ঘিরে একটা আড্ডা বসত, শনিবারে মুড়ি-তেলেভাজা সহযোগে যার জৌলুস একটু বাড়ত, সেখানে আমরা অনেকেই নিয়মিত ছিলাম। সুচিত্রা কালেভদ্রে আসত। ওখানেও ওকে দেখেছি।
কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, সুচিত্রা আমার কাছে একটু গুটিয়েই থাকত। অন্তত প্রথম-প্রথম তো বটেই। লোকজনের কাছে শুনতাম, ও নাকি বলত, ‘‘ও বাবা, বাদলদার সঙ্গে আবার কী কথা বলব, উনি যা গম্ভীর!’’ ফলে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকলেও সেই অর্থে সখ্য কোনও দিনই গড়ে ওঠেনি।
তবু একটা ব্যাপার, ঘরেই হোক, কী বাইরে, ওর মধ্যে আমি কোনও দিন কৃত্রিমতা দেখিনি। দেখনদারি দেখিনি। যতটুকু দেখেছি, মনে হয়েছে, ও ছিল আগাগোড়া আন্তরিক ঘরোয়া একজন মানুষ। কত জনের কাছেই শুনেছি, ও খুব খাওয়াতে ভালবাসত, লোকজন বাড়িতে গেলে না খাইয়ে ছাড়ত না। আমার অবশ্য তেমন কোনও সুযোগ হয়নি।
বার দুয়েক ওর ঢাকুরিয়ার বাড়ি গেছি। দু’বারই আমার দুই মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে। তখন যে বসে দু’দণ্ড গল্প করব, সে ফুরসতও ছিল না।
অস্বীকার করব না, সুচিত্রাকে যখন প্রথম দেখেছি, আমার কিন্তু বিরাট সম্ভাবনাময় ইত্যাদি, তেমন কিছু মনে হয়নি।
কিন্তু একে একে হেমন্তের পাখি, অলীক সুখ, গভীর অসুখ –এর মতো উপন্যাস যখন বেরতে লাগল, আমার ভেতরে সুচিত্রা ভট্টাচার্য সাহিত্যিক হিসেবে জায়গা করে নিতে শুরু করল।
দেশ পত্রিকায় ’৯৫-এর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর ’৯৭— যখন ওর ‘কাছের মানুষ’ বেরোচ্ছে, ও কিন্তু বুঝিয়ে দিচ্ছিল, বাংলা সাহিত্যে ও থেকে যেতে এসেছে।
একটা সময়ের পরে আমার মনে হত, সুচিত্রা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ‘আশাপূর্ণাদেবী’ হয়ে উঠতে চলেছে। সেই হয়ে ওঠার মুহূর্তটাতেই ও চলে গেল।