মূর্ত: দেবভাষায় গণেশ হালুইয়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
বর্তমান বাংলাদেশের জামালপুর অঞ্চলে শৈশব কাটে বিশিষ্ট প্রবীণ শিল্পী গণেশ হালুইয়ের। সেই সময়ে ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুলের ড্রয়িং মাস্টার গফুর মিঞার কাছে। তিনি শিখিয়েছিলেন, কী ভাবে একটি প্রাথমিক ক্রস চিহ্নের মধ্য দিয়ে রূপের গঠন ও আকৃতির প্রকাশ ঘটে। সেই পাঠ আজও এই বর্ষীয়ান শিল্পীর শিল্পচর্চার মূল উপাদান। অর্থাৎ চিত্রভাষায় রূপের গাঠনিক মূল্যটি যে অপরিহার্য, তা তিনি আজীবন চর্চা করে চলেছেন। ‘দেবভাষা’ প্রদর্শশালায় সদ্য প্রদর্শিত হল নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে শিল্পী সৃষ্ট তেমনই এক ডজন অদেখা মুখাবয়বের সম্ভার। দর্শককে নতুন করে ওই ভাবনা ও তার প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে ‘প্রেজ়েন্স অ্যান্ড অ্যাবসেন্স’ নামের এই প্রদর্শনী।
আজ গণেশ হালুই মূলত একজন বিশিষ্ট বিমূর্ত শিল্পী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের এই প্রাক্তনীর প্রতিকৃতি অঙ্কনের দক্ষতাও অতুলনীয়। দৃঢ় ভাবে, ঋজু ও পেলব রেখার সংমিশ্রণে চিত্রিত তাঁর বহু প্রতিকৃতি সেই সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু কর্মসূত্রে পঞ্চাশের দশকে দীর্ঘ দিন অজন্তায় থেকে, ভিত্তিচিত্রের প্রতিলিপি আঁকা ও গবেষণার সুবাদে, ভারতীয় ধ্রুপদী ঘরানায় রৈখিকতার যে অসাধারণ এক চাক্ষিক আস্বাদ, তা তাঁর কাজের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ছবি আঁকা ছাড়াও, গণেশ হালুই একজন সুদক্ষ লেখকও বটে। শিল্পীর দেখা, আঁকা ও লেখার মধ্যে যে এক সুষম সংযোগ বিদ্যমান, তা দর্শককে সাহায্য করে শিল্পীর বহুমুখিতাকে খুঁজে পেতে। যেমন শিল্পী তাঁর নিজের ভাষায় লিখছেন, ‘‘আমি অতীতে দাঁড়াই। বর্তমানে হাঁটি। ভবিষ্যতে উড়ি। ভবিষ্যৎ এসে মেশে বর্তমানের ধারায়। বর্তমান ডোবে অতীতের ভাবনায়। আমি ভাসি ভাবনার সাগরে।’’
সেই ভাবনার সাগর থেকেই জন্ম নিয়েছে এই প্রদর্শনীর মুখাবয়বগুলি। পুরুষ, নারী বা শিশু... কোনও চরিত্রই বিশেষ কোনও প্রতিকৃতি হিসেবে ধরা দেয়নি, বরং নান্দনিক রেখার মাধ্যমে ধরা দিয়েছে শিল্পীর ব্যক্তিগত আত্মদর্শন ও দীর্ঘ অনুশীলনের চর্চাক্ষেত্রটি। তিনি লিখছেন,‘‘আমার ছবিতে প্রত্যক্ষ মানুষের ছবি নেই। কিন্তু আমি আছি।’’ অর্থাৎ শিল্পীর আত্মিক মননের মধ্য দিয়ে ধরা দিয়েছে এই চরিত্রগুলি। কেউ তারা ঘাটশিলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের, কেউ বা অজন্তার লেনাপুরের গ্রামীণ বাসিন্দা। কিন্তু মুখাবয়বগুলির মধ্যে তাঁর স্বকীয় যে শৈলী—অর্থাৎ গাঠনিক ও পেলব রেখার ঐকতান, তা সুস্পষ্ট ভাবে দর্শককে আকর্ষণ করে। চারকোল, কন্টি, প্যাস্টেল মাধ্যমে আঁকা মুখগুলি প্রায়শই বিমর্ষ, দৃষ্টির মধ্যে যেন হতাশা বা কৌতূহলের আভাস। এ যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই অন্তহীন লীলায় সে তার নিজ অস্তিত্বের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাধীন। আয়ত চোখগুলি তাই যেন অন্তর্মুখী এক প্রশ্নের তাড়নায় নিমগ্ন। শিল্পী লিখছেন, ‘‘এইরূপ ভাবগত সম্পর্কেই একটি ছবির সার্থকতা। জীবাত্মার অনুভূতিই শিল্পের সত্তা।’’ সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে যে ভাব ও ভাবনা, রূপ ও রস, গঠন ও পরিবেশনের এক ছন্দ গড়ে ওঠে, এই ছবিগুলিতে তারই অসাধারণ প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। কিছু কাজে প্যাস্টেলের রং ঘষে, চিত্রপটে এক ধূসর কাল্পনিক আলোআঁধারির মাঝে শিশুদের নিষ্পাপ দৃষ্টি চরিত্রগুলিকে এক ঔৎসুক্যের আমেজে উদ্ভাসিত করেছে।
এ জাতীয় প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে একজন বর্ষীয়ান শিল্পীর সুদীর্ঘ শিল্পচর্চার যে বহুবিধ অধ্যায় থাকে, তার পরিচয় পান দর্শক। আগামীদিনে এমন আরও প্রদর্শনী শিল্পরসিকদের সমৃদ্ধ করবে।