কার্টুন-দুনিয়া: আবু আব্রাহামের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি গ্যালারি রসা-য় কার্টুনের একটি অনন্য প্রদর্শনী দেখতে পেলেন শিল্পরসিকরা। কার্টুনিস্ট আবু আব্রাহামের শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে যে সম্মান এখানে দেওয়া হল, হয়তো এর আগে কখনও তাঁর কাজ এ শহরে এই ভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অতি যত্নে এই প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন সিদ্ধার্থ শিবকুমার। প্রদর্শনীটির নাম ‘দ্য ওয়ার্ল্ড থ্রু আবু’স আইজ়।’
আবু আব্রাহাম কার্টুনিস্ট ছাড়াও ছিলেন সাংবাদিক এবং লেখক। প্রদর্শনীর সমস্ত কাজই আবুর দুই কন্যা আয়েশা এবং জানকী আব্রাহামের সৌজন্যে সংগৃহীত।
আবুর জন্ম কেরলে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে এবং পরে যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে সময়কার যুব সমাজকে যেতে হয়েছে, তার চেয়ে খুব ব্যতিক্রমী ছিল না আবুর জীবন। ১৯৪২ সালে তরুণ আবু ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে অনাহারে ছিলেন। তখনই তাঁর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সাংবাদিক হিসেবে স্বাধীনতার পরে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কার্টুন আঁকতে শুরু করেন আবু। সাংবাদিকের নির্ভীক কলম এবং কার্টুনিস্টের নির্ভেজাল ব্যঙ্গাত্মক ড্রয়িংয়ের মেলবন্ধনে আবু সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেন অনবদ্য সব কার্টুন।
কার্টুন-দুনিয়া: আবু আব্রাহামের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
এর পরে দিল্লিতে ডাক পড়ে শঙ্কর’স উইকলি-তে কাজ করার জন্য। অপ্রত্যাশিত ভাবে পরিচয় হয়ে যায় ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট ফ্রেড জসের সঙ্গে এবং তার পরে সোজা লন্ডন-যাত্রা। সেখানে পাঞ্চ পত্রিকার পাতায় যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন আবু। তাঁর প্রতিভা বিকশিত হল। এ ছাড়াও বিলেতে অন্যান্য পত্রিকায়ও তাঁর কার্টুন ছাপা হতে আরম্ভ হয়। এখানেই প্রথম বার আবু সাফল্যের শিখর ছুঁয়ে যান, নিজের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, শিল্পবোধ এবং রসবোধের পরিচয় দিয়ে। ব্রিটিশ রাজনীতিকে হয়তো কিছুটা অন্য স্তরে উত্তীর্ণ হতেও সহায়তা করে আবুর কার্টুন। এ ছাড়া তাঁর প্রথম স্বকীয় কার্টুনের দায়িত্ব বর্তায় ‘দি অবজ়ার্ভার’ পত্রিকার পাতায়। সেখানেই সম্পাদকের নির্দেশে নামের শেষে আব্রাহাম বাদ দিয়ে শুধু ‘আবু’ নামটুকুই ব্যবহার করতে শুরু করলেন শিল্পী। তাঁর সেই সময়কার কার্টুন কিছুটা বিস্তারিত এবং অলঙ্কৃত ছিল। পরবর্তী কালে অনেক মিনিমাল এবং স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর কাজ।
লন্ডনবাসী আবুর দৃষ্টিভঙ্গিতে যেন বেশ কিছুটা আন্তর্জাতিক ছাপ পড়েছিল। ১৯৬০ এবং ’৭০-এর দশকে করা হেনরি কিসিঙ্গারের সঙ্গে ভুট্টোর শিমলা চুক্তি নিয়ে সাক্ষাৎকার ভারতের পক্ষে স্বস্তিদায়ক ছিল না। এটি আবুর কলমে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ১৯৭২ সালের চিন ভ্রমণ এবং সামরিক নিয়ন্ত্রিত গতিবিধির চর্চা, যা ভারতের পক্ষে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা নিয়েও আঁকতে ছাড়েননি আবু।
কার্টুন-দুনিয়া: আবু আব্রাহামের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
এ ছাড়াও কিছু কার্টুনে তিনি বিশ্বখ্যাত নেতাদের দ্বিচারিতার কথা স্পষ্ট বলেছেন। যে সব নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতি সমর্থন করেন না, তাঁরাই আবার দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায় থাকেন। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আঁকা কার্টুনে বিশ্বের তাবড় নেতাদের দুর্বলতা এবং যুদ্ধের প্রতি অনুরাগ আবু ব্যক্ত করেছেন, নিজস্ব রেখায়-রঙে।
প্রদর্শনীর অপর একটি কার্টুনে ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে দেখিয়েছেন মুরগির রূপে। সেখানে তিনি বলছেন যে, ইজ়রায়েল সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কোনও কথাই বলতে রাজি নয়। এই ছবির ক্যাপশনটিও খুব মজার ও অর্থবহ।
ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে আঁকতে গিয়ে একটি কার্টুনে নেহরুর দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন আবু। পৃথিবীর নাট্যশালায় ভারতের জায়গাটা ঠিক কোথায়, সেটির অনুষঙ্গ এসেছে এই আঁকায়।
কার্টুন-দুনিয়া: আবু আব্রাহামের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
এর পরে বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে করা কাজে প্রথম দিকে তাঁকে খুব সম্মানিত একজন রাজনীতিক হিসেবেই দেখাতেন আবু। কিন্তু পরের দিকে তাঁকে নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক ছবি আঁকতে ছাড়েননি। গ্যালারির দোতলায় ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে আঁকাগুলি দেখতে পাওয়া গেল। ইন্দিরা গান্ধীর অভিব্যক্তি বদলে গিয়েছে যখন আবুর তুলিকলমে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন এক জ্যোতিষীর কাছে। দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যেন অনেকাংশেই অসহায় এবং একাকী। তার পরে আরও একটি আঁকায় আবু দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা সাপ-সিঁড়ির লুডো খেলায় ব্যস্ত, পৌঁছতে হবে সমাজবাদে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তাঁর ঘুঁটি সাপের মুখে পড়ে যাচ্ছে।
’৮০ সালের মাঝামাঝি যখন ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের বিচারবিভাগে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, আবু দেখাচ্ছেন যে, বিচারকেরা যেন তাঁর সরকারের প্রগতির রিপোর্ট বানাচ্ছেন, সেখানে ইন্দিরা গান্ধী জিভ কাটছেন। একান্ত ভাবেই যেন বিহ্বল তিনি।
হিন্দুধর্মের নব-উত্থানের ব্যাপারেও আশ্চর্য রকম নিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে এল কে আডবাণীকে নিয়ে ছবি এঁকেছেন আবু। আডবাণী বাল্মীকি রামায়ণ লিখতে বসেছেন সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে, যদিও এঁদের দু’জনের কর্মজীবনে প্রায় এক দশকের ব্যবধান। এঁরা লিখছেন শুধুই প্রথম পর্বটি, কারণ তার পরেই দেশ প্রবল বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হবে বলে ভেবেছেন এবং সেখানেও তাঁর স্মরণে মহাত্মা গান্ধী।
কার্টুন-দুনিয়া: আবু আব্রাহামের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
এ ছাড়াও হালকা মেজাজের কয়েকটি কমিক স্ট্রিপে, যেগুলির নাম ‘সল্ট এ্যান্ড পেপার’, আবু বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নানা রকম হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছেন।
কার্টুন শিল্পীকে বেশ কিছুটা প্রতিবাদী, প্রগতিবাদী এবং সংস্কারপন্থী হতে হয় বোধহয়। আবু ছিলেন সেই জাতের শিল্পী। আবু আব্রাহামের বিশেষত্ব তাঁর সুদৃঢ় রেখায় আঁকা কার্টুনগুলিতে, যেখানে অনুভূতির প্রাচুর্যও দেখা যায়। তিনি যেন বরাবরই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ব্যঙ্গরসের এক মারাত্মক ভূমিকা আছে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। এ দেশে ইমার্জেন্সির সময়ে প্রেসের দায়িত্ব সর্বাঙ্গীন ভাবে পালন করেছেন আবু। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, পঞ্চাশ বছর পরেও আবুর প্রায় সব কার্টুন এখনও ততোধিক প্রাসঙ্গিক। এই প্রদর্শনীতে সে কথাই আরও একবার প্রতীয়মান হয়ে উঠল যেন।