সমাজে ধর্ম ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নিহিত শক্তি ছিলেন মা সারদা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থেকে স্থিতি ও সুরক্ষার মৌলিক অনুভবে আয়োজিত হয়েছিল প্রদর্শনী, মা— শাশ্বত শক্তি। নিবেদনে এই সময়ের উদীয়মান শিল্পী মহেশ্বর মণ্ডল। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে মুম্বইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে।
বিভিন্ন মাধ্যমে গৃহীত তাঁর প্রায় সত্তরটি কাজের মূল লক্ষ্য ছিল, ট্র্যাডিশনাল বস্তুজগৎকে পুনরুদ্ধার করা ও গঠন করা, যা দর্শকের পক্ষে উদ্দীপক। পোস্টমডার্ন শিল্পের চ্যালেঞ্জিং প্রেক্ষিতে বাস্তববাদকে নতুন ভাবে উদ্ভাবন করার উৎসাহে শিল্পীর কাজগুলি ঘনিষ্ঠতা-বিচ্ছিন্নতা, সততা-প্রতারণা এবং সংগ্রাম ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলিকে সম্বোধন করে।
শিল্পীর শৈলীটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সেট থেকে বিকশিত হয়েছে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনে রয়েছে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণের একটি অংশ। এ ছাড়া নিজেকে মেলে ধরার নেপথ্যে ডাচ শিল্পী এম সি এশ্চার, বাংলার গণেশ পাইন, গণেশ হালুই প্রমুখের ভাবনা ও গঠন ভীষণ ভাবে শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিরাট আকারের ছবি, কোলাজ ও ইনস্টলেশনের উপস্থাপনায় প্রদর্শনী মুগ্ধ করল দর্শককে।
প্রকরণগত বিবরণে কয়েকটি কাজের উল্লেখে শিল্পীর কাজ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হতে পারে। যেমন গ্রাফাইট, কন্টির ‘রাশ আওয়ার’ ছবিটি। এই কাজের বিষয়টি চা-কে ঘিরে, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি পানীয়। কোনও চায়ের স্টলে পা রাখলেই অভ্যর্থনা জানানো হয় আমাদের। দেখা যায়, প্যান বা কেটলির জল ফুটে উঠলে চা পাতাগুলি প্রাণবন্ত হয়ে বুদবুদের মধ্যে হইহই করে নাচ শুরু করে। জলের বুদবুদ যতই বাড়ে, চা পাতাগুলি ততই প্রাণবন্ত হয়ে একপাশ থেকে অন্য দিকে ছোটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করে শিল্পীর মনে হয়েছে, আমরা সকলে সেই ফুটন্ত জলের চা পাতার মতোই। ব্যস্ততার এক বিরাট প্রতিযোগিতায় নেমেছি। জীবনে ফুরসত নেই। ক্লান্ত চোখকে বিশ্রাম দিতে প্রকৃতির প্রশান্তি খুঁজি না আমরা। ৬০/৪৫ ইঞ্চির এই কাজটিতে সাদা-কালোর গোলাকার পাত্রে (বিশ্ব) বুদবুদের মতো সমস্ত প্রাণশক্তির বিন্দুগুলি কেন্দ্রীভূত শাসনে তলিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে সাদার আশ্চর্য ব্যবহার, শূন্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
প্রদর্শনীটি উৎসর্গ করা সারদা মাকে, যাঁর (৪/৫ ফিট) মূল ভাবকে শিল্পী সযত্ন সাদা, ব্রাউন ও ইয়েলো অকারের নরম স্ট্রোকে তুলে ধরেছেন। এই প্রক্রিয়ার আর একটি কাজ বিশেষ আকুতি নিয়ে আসে— ‘প্রে’। ‘র-সিয়েনা’র সাপোর্টে, সামান্য বার্ন্ট আম্বারের রেখাভিত্তিক নতজানু ভঙ্গি দর্শকমনে গভীর প্রভাব ফেলে।
নারীশিক্ষার উপরে একটি কাজ ‘ওয়েভিং ড্রিমস’। লিঙ্গ-পক্ষপাত দোষে দুষ্ট সমাজের অগ্রগতির জন্য শিশুকন্যার শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এই থিমের জন্য শিল্পী ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনটি সিল্ক ও ক্রেপ কাপড়। একটি মেয়ের হাতের লেখা, আঙুলের ছাপ ও স্বাক্ষরে জলরং, প্যাস্টেল ও কালির ব্যবহার ছাড়াও, ডিজিটাল মিডিয়ামের সাহায্যে একাধিক উপাদানকে একত্রিত করায় এসেছে কোলাজের সুন্দর চেষ্টা।
প্রতিনিয়ত যৌন নিগ্রহের খবরে উঠে আসে নারী ও শিশু। বহু পুরুষের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটে, অনেকে হয়তো বলতে পারে না। এটি মাথায় রেখে মহেশ্বর পুরুষের সেই তীব্র যন্ত্রণার কথা ভেবে এঁকেছেন একটি ছবি— ‘অ্যানাদার ওয়াল’ (১৮২/১১৮ সেন্টিমিটার)। চারকোল ও পেনসিলের আলো-আঁধারির ভ্রুকুটিতে, ভোগীর ফেলে দেওয়া উপভোগ্য সামগ্রী হিসেবে উঠে এসেছে একটি জরাজীর্ণ প্যান্ট। পুরুষ বা নারীর সেই প্রতীকী আবরণে চোখে পড়ে নির্মম শতচ্ছিন্নতার দাগ। অসাধারণ কম্পোজ়িশন ও বস্তুগত আলোছায়ায় এই কাজকে কুর্নিশ জানাতে হয়।
সমসময়ের এই শিল্পী তাঁর নিজের সময়ের কেন্দ্রীয় প্যারাডক্সগুলির মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে নিজের কাজের পরিকল্পনা করেন। প্রাসঙ্গিক সমস্যাকে তুলে ধরার চেষ্টায় এগোতে থাকে শিল্পীর খোঁজ। সেই পথেই শিল্পোত্তীর্ণ হয় তাঁর কাজ।