Art exhibition

Arts: ‘ভোরের আলোয় নয়ন ভ’রে, নিত্যকে পাই নূতন করে...’

 ছবিতে ওই যে এক অদ্ভুত সারল্যের বহিঃপ্রকাশ, তা তাঁর চিরাচরিত বর্ণবিন্যাস ও রচনার অতিসরলীকরণ।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২১ ০৯:০৫
Share:

স্বপনচারণ: ইমামি আর্টে আয়োজিত কার্তিকচন্দ্র পাইনের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

গণেশ পাইনকে একান্ত কথোপকথনে একবার কার্তিক পাইনের ছবি সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, “খুব ফ্যান্টাসি আছে এক ধরনের। বেশ অন্য রকম।” বহু কাল আগে করা ওই মন্তব্য তাঁর ছবি দেখতে দেখতে ভীষণ ভাবেই মনে পড়ছিল। শুধু তো ফ্যান্টাসি নয়, এমন আদিমতা বা আপাদমস্তক শিশুসুলভ চমৎকারিত্ব, অথবা আশ্চর্য সুররিয়ালিজ়মের সঙ্গে মিশে থাকা সুর-সিম্ফনির এক নীরব উচ্ছ্বাস। এ রকম অনেক কিছুই তাঁর চিত্রকলা। আরও কত রকম ভাবে এক-একটি ক্যানভাস আত্মপ্রকাশ করেছিল সে সময়ে, দেখে অবাক হতে হয়। হ্যাঁ দর্শক, বিশেষত ছবিদেখিয়ে বোদ্ধা দর্শক অবাকই হয়েছিলেন। বিরাটসংখ্যক চিত্রকলা নিয়ে কার্তিক পাইনের ‘দ্য (ইন) ভিজ়িবল অ্যান্ড দ্য (আন)রিভিলড: ইনসাইড সিক্রেট ওয়র্ল্ড অব কার্তিকচন্দ্র পাইন’ নামে এক অনন্য প্রদর্শনী উপস্থাপন করল ইমামি আর্ট। সম্প্রতি শেষ হওয়া এই প্রদর্শনীটি সাম্প্রতিক কালের এক উজ্জ্বল সংযোজন ইমামি আর্টের।

Advertisement

ছবিতে ওই যে এক অদ্ভুত সারল্যের বহিঃপ্রকাশ, তা তাঁর চিরাচরিত বর্ণবিন্যাস ও রচনার অতিসরলীকরণ। যার আড়ালে আধুনিক চিত্রকলার একটি মেলোডিকে অনুভব করা যায়। কী সেই মেলোডি? আধুনিকতাকে তিনি নির্দ্বিধায় ভেঙেছেন নানা ভাবে, বালখিল্যের ভাঙাগড়ার মতন, কিন্তু অতি স্বতঃস্ফূর্ততার ধারণাকে শ্লথ হতে দেননি। সেখানে রূপবন্ধই হোক বা অবয়বী প্রত্যঙ্গ, সবই তুঙ্গ সাবলীলতার উজ্জ্বল প্রকাশ। মানুষ বিশেষত নারী, পশুপাখি, প্রকৃতি... সব কিছুই তাঁর ছবিতে একান্ত উপস্থিতির মধ্যেও যে নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত, যে বা যারা কম্পোজ়িশনের কাঠামোয় গড়ে ওঠা প্রতিটি অংশে বিবিধ প্রশ্ন ও কৌতূহল জাগায়— এখানেই তাঁর অন্য এক সার্থকতা। এই যে দ্রুত ও অনির্দিষ্ট বর্ণলেপন ও মিশ্রণের টেকনিক, তা তাঁর ছবির এক রকম অলঙ্কারও যেন।

কার্তিকের স্টাইল কখনও কখনও ছাড়িয়ে গিয়েছে তাঁর অদ্ভুত সব টেকনিককে। আবার পাশাপাশি, ওই টেকনিকও কোথাও কোথাও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ওই অনন্য স্টাইলটিকেই। ওই ধরে ধরে মেশানো রং, একটি মায়াবী টোনাল ভেরিয়েশন, নিটোল ফর্মের শাঁস, রূপবন্ধের চিরাচরিত নির্দিষ্ট স্বাভাবিকতাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে তৈরি করেছেন তাঁর সরল বিশ্ব। রূপ যেখানে অরূপকে আহ্বান করে দেখায় তার অন্তর্গত শরীর, হাড়, মজ্জা, মাংস। কখনও তা অতি রহস্যময় অলৌকিক, কখনও বড্ড ‘চাইল্ডিশ’।

Advertisement

তাঁর ছবির আদিমতা, প্রত্ন-লৌকিক ভাবনার রঙিন মাজাঘষার সরলীকরণ, লোকশিল্পের সঙ্গে মিশে থাকা আধুনিকতা, ডিজ়াইনধর্মীয় উৎসব, রূপকথার বুদ্ধুভুতুম, শুকসারির ন্যায় চিন্তার প্রতিফলন... অনেক কিছুই মিলেমিশে, অনেক গল্প-নাটকীয়তায় পৌঁছে দেন চরিত্র ও সামগ্রিক আবহটিকে। পশুপাখির একক ও সংগঠিত রূপ, নারী-পুরুষের ভিন্ন মুহূর্তগুলি কৌতূহলোদ্দীপক।

তাঁর ছবি ভীষণ রকম আধুনিক ও ভারতীয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের ঘ্রাণও অনুভূত হয়। তিনি রূপবন্ধ ও আংশিক গঠন নিয়ে মজার জ্যামিতিতে বাঁধেন তাঁর রচনাকে। অদ্ভুত এক জ্যামিতি তাঁর বেশ কিছু কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। স্পেস যেখানে নায়কোচিত অবস্থান নেয়। কার্তিকের ছবিতে ‘স্পেস’-এর ভূমিকা অনেকখানি। যেখানে বর্ণের নির্বাচন ও নির্যাস বড় মায়াবী ও ভয়ঙ্কর সুন্দর। সৌন্দর্যের কাঠামো ভেঙে চুরমার করা এ বিন্যাস বড় বেশি গভীরের কথা বলে। যন্ত্রণার কথা বলে। এই অন্তর্ভেদী অবলোকনের মধ্যেই রয়ে যায় অনেক মৌলিক প্রশ্ন, যার উত্তর তাঁরই সৃষ্ট স্টাইল, টেকনিক, টেম্পারামেন্টে তিনি নিজেই দিয়েছেন। যে সমাধানের ভিতরের জ্যামিতিতে পাওয়া যায় সুবিখ্যাত অয়েল ‘বার্ড ইন দ্য কেজ’-এর মতো কাজ। ‘রিফিউজি ফ্যামিলি’, ‘রিকশা পুলার’, ‘ভেক্সেশন’, ‘ফ্যামিলি’, ‘ক্রেন’, ‘গ্রুপ অব ডিয়ার’ কাজগুলি দেখলেও তা অনুভূত হয়।

তাঁর নগ্নিকারা মাতিস, মদিগিলিয়ানিকে মনে পড়ায়। তাঁর ছবির নগ্নতার ওই মোহিনী রূপ তো ক্যানভাসের কবিতা। ‘ওয়ে টু বাথ’, ‘ওল্ড অ্যান্ড ইয়ং’, ‘ব্রেভ বাথ’, ‘দ্য কার্ট পুলার’, বিশেষ করে ‘ডান্স’— এই কাজগুলিতে তা জীবন্ত। শরীরী ভঙ্গি, অভিব্যক্তি অসাধারণ। জলরঙে কিছু টলটলে কাজ, পোর্ট্রেট চমৎকার। এ ছাড়া ড্রাই পয়েন্টে ‘দ্য পোর্ট্রেট অফ ওল্ড ম্যান’, এচিংয়ে ‘ফিগার স্টাডি’ উল্লেখ্য। কার্তিক ছবির এক আলাদা ভাষা ও ভাষ্য তৈরি করেছেন। নশ্বর পৃথিবীতে যতক্ষণ প্রাণ থাকবে, তাঁর ছবি যেন সেই শ্বাস-প্রশ্বাস...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement