বর্ণময়: অসিত পালের প্রদর্শনীর কাজ
সত্তর দশকের ‘চলমান শিল্প আন্দোলন’-এর হোতা তিনি। শিল্পকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সেই অবিরত প্রচেষ্টার ফসল তুলেছিলেন এই জেদি যুবক। মনোহরদাস তড়াগের গম্বুজ তখন শনি-রবির বৈকালিক আড্ডায় গমগম করত, কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকর-ভাস্কর-গায়ক-সমালোচক-সম্পাদকদের ভিড়ে। সঙ্গে পত্রপত্রিকা ও বই। আবৃত্তি, কবিতাপাঠ, গান ও গল্পপাঠের মশগুল সময় তখন। মহান শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী, বটতলা শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ, চিৎপুরের লিথো প্রেসগুলির সন্ধান, পুরনো ছাপচিত্রের খোঁজে অহর্নিশ অন্বেষণ তাঁর। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ তখন থেকেই তাঁর অবচেতনে তৈরি করে ফেলেছিল পুরনো কলকাতার ছাপচিত্রের এক মহার্ঘ মিউজ়িয়াম। ওই রকম একজন শিল্পীর ১৯৬৮ থেকে ২০২১— এই তিপ্পান্ন বছরের সমগ্র কাজের নির্বাচিত এক পূর্বাপর প্রদর্শনীতে কৌতূহল থাকবে, এ আর আশ্চর্য কী! অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সহায়তায় ও ‘মুক্তশিল্প’-র উপস্থাপনায় তিনটি কক্ষ নিয়ে অসিত পালের এই প্রদর্শনীটির পরিকল্পনা, ডিসপ্লে তাঁরই বন্ধুসম হিরণ মিত্রের। প্রায় দেড়শোটি সমস্ত মাধ্যমের কাজ ও বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সে এক মহাযজ্ঞ! এই উপলক্ষে তাঁর শিল্প নিয়েই একটি ডকু-ফিল্ম ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ রিলিজ় করে।
ড্রয়িং, বটতলার ছাপচিত্রের রঙিন পুনর্নির্মাণ, জলরং, ইঙ্ক, তেলরং, গ্রাফিক্স, মিশ্র মাধ্যম, রঙিন পেন্সিল, উডকাট, লিনোকাট, সেরিগ্রাফ, নিউজ পেপার ম্যাটে মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিক, এচিং, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য— কী করেননি অসিত?
উল্লেখযোগ্য এই যে, প্রতিটি মাধ্যমেই নির্দিষ্ট কোনও স্টাইলকে প্রাধান্য দেননি। বলা ভাল, শিল্পীর ব্যক্তিগত কোনও ধারা উপস্থিত নয়। মাধ্যম হিসেবে তাঁর মতো পটভূমি, সারফেস, বর্ণ অনুযায়ী কম্পোজ়িশন ও সমগ্র একটি নিরীক্ষামূলক পর্যালোচনা করেছিলেন ওই দ্বিমাত্রিকতায়। কখনও ন্যারেটিভ সেখানে প্রধান, কখনও নয়।
অসিতের ছবি সাঙ্কেতিক না প্রতীকী, না কি ‘দার্শনিক বিচরণ’ তাঁর কিছু কাজ? এ সবের ঊর্ধ্বে উঠে বলতেই হয়, হয়তো তা-ই। হয়তো তা-ও নয় সবটা। কাক, কড়ি, সাপ, পদ্ম, বিচ্ছিন্ন ভাবে পশুপাখি, জান্তব মুখ... এমন সব রূপই তাঁর ছবির নির্দিষ্ট অলঙ্কার! যাকে কেন্দ্র করে কম্পোজ়িশন একটি মেসেজ দিচ্ছে। এই সব সুরের মেলোডি থেকে কোথাও যেন ছবিতে অনুরণিত হচ্ছে অন্য স্বর। আর্তনাদ ও মৃত্যুচেতনা, অত্যাচার ও নৈঃশব্দ্যের এক হতাশামুখর হাহাকার।
তাঁর সাদাকালো লিনোগুলির ডিজ়াইন ও জ্যামিতি অনবদ্য। এখানে স্পেস ফর্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর একটি এয়ারি স্পেসকেই যেন অন্য রূপে প্রতিভাত করছে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ডিস্ট্রিবিউশনের অনন্য নজির। ৫০ বছর চিৎপুরের বটতলার কাঠখোদাই শিল্পীদের নিয়ে গবেষণা, তাঁদের কাজের অংশ, সেই হিসেবে তাঁরই ছবিতে জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতসারে প্রবেশ করেছিল। রূপবন্ধের বাস্তবতাকে রেখে আবার ভেঙে, মাধ্যমগত ভাবে ও নানা বিবর্তিত রূপে সে-সবের চিত্রিত পরিবেশন নির্দিষ্ট ভাবে বার্তাবহ। ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে যেমন কন্যা-হারানো পিতার আর্তনাদ, তেমনই সাদাকালো সরু লাইফ ড্রয়িং ও স্টাডির প্রখর বাস্তবতাও চোখ টেনে নেয়। ৪৭ বছর আগে লিনো প্রিন্ট ও কাঠ খোদাইয়ের ছবিগুলি তাঁর শিল্পযাত্রার দিকনির্দেশ গড়ে দিয়েছিল। দ্বিমাত্রিক পটভূমির আবহে ছাপচিত্র ও ড্রয়িং-পেন্টিংয়ের চমৎকার মিশ্রণে এক আশ্চর্য নিরীক্ষামূলক পর্বের অন্বেষণ ও নির্মাণমূলক অভিনবত্বের সূচনা করেছিলেন, দর্শকের চোখকে যা আচ্ছন্ন করেছিল। কিন্তু ওই বটতলার সাদাকালো ছবির রঙিন ডিজিটাল প্রিন্ট যখন ক্যানভাসের ইম্প্রেশনে একটি রূপ পাচ্ছে, সেখানে নিজস্ব টেকনিকে মিশ্রমাধ্যমে আর এক ধরনের কাজ ছবিগুলির নিজস্বতাকে খর্ব করছে।
ওই অভিনবত্বে আর একটি আলাদা মাত্রার সংযোজন ঘটেছে। তবু যেন রূপবন্ধও নতুন ভাবে পুনর্বিন্যাসের ফলে তার সিম্ফনি ও স্টাইল, বক্তব্য ও বর্ণনা, কম্পোজ়িশন ও ক্যাজ়ুয়ালিটি, মেসেজ ও মেটাফর যেন একে অপরের পরিপূরক। প্রাচীন এক রকম। সে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত কোনও রচনাই হোক বা একক, আবার পুনর্নির্মাণের নব্য আঙ্গিকে শিল্পীর সচেতনতার নতুনত্বেই হোক— এই প্রেক্ষাপটটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রেক্ষিতকেই স্মরণ করায়।
আশ্চর্য যে, অসিতের কাজে প্রচণ্ড গ্রাফিক কোয়ালিটি থাকা সত্ত্বেও ড্রয়িং ও পেন্টিংয়ে কিন্তু তা ভীষণ ভাবেই অন্তর্হিত। কারণ পেন্টিংয়ের প্রকৃত জায়গাগুলি, টেকনিক, কোয়ালিটি সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা প্রথম থেকেই কাজ করেছিল। তিনি সন্দিহান ছিলেন একটি মনুষ্যমুখ বা অবয়ব, একটি কড়ি বা অন্য রূপবন্ধের ব্যবহার ও আকার সমগ্র কম্পোজ়িশনের ব্যালান্স ও চরিত্রের সঙ্গে কোথায় কতটা বর্ণ ও স্পেসের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করবে না, বা রচনাটির মূল সুর একটি জায়গায় আবদ্ধ থাকবে, এই প্রশ্নে। তাঁর পেন্টিংগুলি সেই অর্থে গ্রাফিক কোয়ালিটিকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি।
অসিত এক সময়ে সাইক্লোস্টাইলে মুদ্রিত পত্রিকা ‘প্রমিতি’ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৭২-’৭৭ আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সময়ে তাঁর প্রকাশিত ‘আর্টিস্ট’ সাড়া ফেলেছিল। আশির দশকে তাঁর ‘উডকাট প্রিন্টস অব নাইন্টিনথ সেঞ্চুরি’, অনেক পরে ‘প্রিয়গোপাল দাসের কাঠখোদাই’, ‘আদি পঞ্জিকা দর্পণ’, ‘কোলকাতার কাঠখোদাই’ বিখ্যাত গ্রন্থ। দশ বছরের বেশি একটি বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রের আর্ট ডিরেক্টর অসিতের কাজে একটি ইন্টেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিনের বার্তাই ভেসে ওঠে। যে অনুভূতি এই ভিসুয়াল রিপ্রেজ়েন্টেশনের গভীরে বিশেষ ভাবে নিহিত। সেই সন্ত্রাসের উত্তাল সময়ের মধ্যে যিনি আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে খুঁজতেন বহু হারানো যৌবন, চৈতন্যের মধ্যে খুঁজে পেতেন সাম্যের বীজমন্ত্র।