দৃশ্যপট: ‘ডেলভিং দ্য ডার্ক’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের পঠন-পাঠনের জন্য এক নির্ধারিত পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সেটাই চিরাচরিত রীতি। কিন্তু রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা অনুষদের অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা প্রতি বছর ঠিক এমনই এক সুন্দর পাঠক্রমের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখেন। অর্থাৎ তাঁদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম নিয়ে বার্ষিক একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এ বছরও ঠিক সেই রকম এক সুদৃশ্য প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল কলকাতার ‘আকার প্রকার’ গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর নাম, ‘ডেলভিং দ্য ডার্ক’।
দৃশ্যকলা অনুষদের পঠনপাঠন এক অন্য ধারায় পরিচালিত হয়। অর্থাৎ চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ছাপাই ছবি, ফলিত কলা বিভাগগুলি মূলত ব্যবহারিক কাজের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়। এ ছাড়া শিল্প-ইতিহাস বিভাগে শিল্পের সংজ্ঞা, ইতিহাস ও তত্ত্বকথার পাঠদানের সঙ্গে ব্যবহারিক কাজও থাকে অন্তর্ভুক্ত। ফলত শিক্ষানবিশদের সঙ্গে শিক্ষকরাও একই ভাবে নানা সৃষ্টিকর্মে যুক্ত থাকার এক সুযোগ তৈরি করেন। এ যাবৎ কলকাতা ছাড়া দেশের অন্যান্য প্রদেশেও কোনও কোনও বছর এই প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে।
এ বছর প্রদর্শনীটি এক নতুন ভাবনায় গঠিত। অর্থাৎ একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শুধু মাত্র কালো-সাদা লিনোকাট মাধ্যমে তাঁদের কাজগুলি সৃষ্টি করেছেন। তাই যথাযথ ভাবেই নামকরণ হয়েছে ‘ডেলভিং দ্য ডার্ক’। বর্তমানে অনুষদের কর্মাধ্যক্ষা শিল্পী পলা সেনগুপ্তর নেতৃত্বে, তাঁর সকল সহকর্মীকে নিয়ে এই সুগঠিত শো-টি আয়োজন করেছেন। মোট ১৪ জন অধ্যাপক-অধ্যাপিকা এতে যোগদান করেছেন। সঙ্গে অতিথি শিল্পী হিসেবে প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বর্ষীয়ান শিল্পী পার্থপ্রতিম দেবের বেশ কিছু কাজও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
দৈনন্দিন পাঠদানের মাঝে এ বছর শিক্ষকরা একত্রিত ভাবে একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমেই কাজ করেছেন। তাই কালোর অতল থেকে আলোর সন্ধানে ব্রতী শিল্পীরা বহু বিষয়, বহু আঙ্গিক ও ভাবনার মধ্য দিয়ে তাঁদের কাজগুলি উপস্থাপিত করেছেন। ছাপাই ছবির যে নিজস্ব কিছু আঙ্গিক, তা বজায় রেখেই সকলে তাঁদের বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। যেমন সন্দীপ চক্রবর্তীর ‘রিফ্লেকশন’, দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘ল্যান্ড-এস্কেপ’, পলা সেনগুপ্তর ‘দ্য টাইড অ্যান্ড কান্ট্রি’, আদিত্য মিত্রর ‘সেলফ পোর্ট্রেট’, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়ের ‘কেজেড’, অনিন্দ্য পণ্ডিতের ‘কনভারসেশন’, দোলনচাঁপা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দ্য বুশ’, সুজয় মুখোপাধ্যায়ের ‘ইরেজ়ারস ওভার আ রিকনস্ট্রাকশন’, জয়ন্ত নস্করের ‘বম্ব-কালী’ এবং পরাগ রায়ের ‘মেগা সিটি’। এরই সঙ্গে ছিল রজত সেন, অদীপ দত্ত ও সুব্রত বিশ্বাসের নিজ নিজ ভাবনা।
শিক্ষকদের মধ্যে যেমন অনেকেই বাইরের বহু শিক্ষাকেন্দ্র থেকে এসেছেন, তেমনই অনেকেই এককালে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র থেকে পরে শিক্ষক হয়েছেন। ফলত, কাজগুলির মধ্যে এক বৈচিত্রের আভাস লক্ষণীয়। কেউ সাবেকি ধারায় বিশ্বাসী তো কেউ বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় ডিজিটাল প্রিন্টের পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্রতী। কোনও কাজে পাওয়া যায় সূচিশিল্পের সূক্ষ্মতা তো কোনও কাজ আবার ভাস্কর্যের গঠনাত্মক আবেশে মোড়া। তবে প্রায় সব ক’টি কাজেই কালো ও সাদার যে সমানুপাতিক পরিবেশন, তা অত্যন্ত আকর্ষক। অর্থাৎ অধ্যাপনার সঙ্গে তাঁরা যে প্রতিনিয়ত নিজেদেরও সৃষ্টিশীল ও সমৃদ্ধ করে চলেছেন, তার এক উজ্জ্বল নজির এই প্রদর্শনীতে দেখতে পাওয়া যায়। প্রবীণ ও নবীনের সঙ্গে যে মেলবন্ধন, তা-ও সুনিপুণ ভাবে ফুটে উঠেছে।
ছাত্রছাত্রীরা এই জাতীয় প্রদর্শনী থেকে বিশেষ ভাবে উপকার ও উৎসাহ পেয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্ম যে চির প্রবহমান এক ধারা, তারও সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। আজ রাষ্ট্রীয় স্তরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা অনুষদ যে সৃজনশীল ভাবনার এক উৎকৃষ্ট আঙিনা হয়ে উঠেছে, তা এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই প্রত্যক্ষ করা যায়।