মঞ্চে উপস্থাপনায় শিল্পীরা।
গত ১৫ নভেম্বর শ্রাবণী সেন মিউজ়িক অ্যাকাডেমির একাদশতম বার্ষিক অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়ে গেল পিসি চন্দ্র গার্ডেনে। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে শতবর্ষে শ্রদ্ধেয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হল তাঁদের গাওয়া রেকর্ডে ধৃত নির্বাচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। গান গাইলেন সংস্থার শিল্পীরা। ৮০০ সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে ধ্বনিত রবীন্দ্রসঙ্গীতাঞ্জলি সুচিত্রা-কণিকার গাওয়া সেই সব গানের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। এক সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পীরা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য গান গাইতেন না। তাঁদের সেই একনিষ্ঠ উচ্চারণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষ ঘরানা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল। শ্রাবণীর মা সুমিত্রা সেন সেই রকম একজন জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলিও মঞ্চস্থ হতে দেখেছি। সুমিত্রা সেনের সুযোগ্যা কন্যা শ্রাবণী সেনও পরম্পরা বজায় রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় ব্রতী— তাঁর পরিচালনায় ১১টি সঙ্গীত শিক্ষায়তনের শিক্ষার্থী ও তাঁর অনলাইনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘আনন্দসন্ধ্যা’ উদ্যাপন নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। ৮০০ শিক্ষার্থী সমবেত কণ্ঠে ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ গানের মধ্য দিয়ে সুচিত্রা-কণিকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। তার পর একে একে ৩০টি গান পরিবেশিত হল একক ও সমবেত কণ্ঠে। প্রথম স্থানাধিকারীরা একক সঙ্গীত পরিবেশন করলেন, বাকিরা গাইলেন সমবেত কণ্ঠে। শিশুশিল্পীরা গাইল ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’, ‘এখন আর দেরি নয়’, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ইত্যাদি। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিক্ষার্থীরা গাইলেন ‘আমার মনের কোণের বাইরে’, ‘নূপুর বেজে যায়’, ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি’ ইত্যাদি। সুচিত্রা-কণিকার কণ্ঠে রেকর্ডে গাওয়া গানগুলি আজও শ্রোতাদের মোহিত করে। সে দিন একক ও সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ৩০টি গানের মালা নিবেদিত হল গানের স্রষ্টা ও দুই অমর শিল্পীর উদ্দেশে। বিভিন্ন সঙ্গীত শিক্ষায়তনের শিক্ষক-শিক্ষিকারা (শ্রাবণী সেনের ছাত্রছাত্রীরাও) তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মঞ্চে উপস্থিত করে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন শ্রাবণী সেনের তত্ত্বাবধানে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রুক্মিণী দত্ত, পৌষালি রুদ্রবসু, সোনালি সরকার, দেবাংশু মুখোপাধ্যায়, অমৃতা সাহা, সোহিনী বিশ্বাস, মৌমিতা গোস্বামী, সৌমী বন্দ্যোপাধ্যায়, আশিস সরকার, শতাব্দী ঘোষ— এও এক পরম্পরার নিদর্শন। এ ভাবেই রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রবাহিত হোক উত্তরসূরিদের কণ্ঠে।
দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় কণ্ঠদান করেন শ্রাবণী সেন ও তাঁর বোন ইন্দ্রাণী সেন। ইন্দ্রাণীর বলিষ্ঠ কণ্ঠে নানা ধরনের গান শুনি। সে দিন রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিলেন। শ্রাবণীর গানেও পাওয়া গেল সুমিত্রা সেনের পরম্পরা। অর্জুনের ভূমিকায় শ্রীকান্ত আচার্যের গান ও অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। সঙ্গীত পরিচালনা করেন শ্রাবণী সেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন দেবাংশু মুখোপাধ্যায় ও আশিস সরকার। পাঠে ইন্দ্রাণী সেন, সুকুমার ঘোষ ও চন্দ্রিমা রায় যথাযথ। সমবেত কণ্ঠে অ্যাকাডেমির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। সঙ্গীত আয়োজক সুব্রত বাবু মুখোপাধ্যায়। এত জন প্রথিতযশা শিল্পী সমন্বয়ে যে নৃত্যনাট্যের উপস্থাপনা, তা অতি উচ্চমানের হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যন্ত্রানুষঙ্গের কারণে সঙ্গীত উপস্থাপনা আশানুরূপ হয়ে উঠতে পারেনি। ভাল লাগে— শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারাকে অনুসরণ করে ‘পুনশ্চ’ শান্তিনিকেতন ও কলকাতার ‘সাহানা’ গোষ্ঠী যে নৃত্য পরিকল্পনা করেছে। অর্জুনের ভূমিকায় রুদ্রাভ নিয়োগীর নৃত্যাভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় যথাক্রমে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় (প্রথম) ও নিবেদিতা সেনের (দ্বিতীয়) নাচে শান্তিনিকেতনের নৃত্য পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে। সখীদের কয়েকটি নাচে পুরনো দিনের নাচের পরিকল্পনা প্রশংসার যোগ্য। মদনের ভূমিকায় দ্রাবিন চট্টোপাধ্যায়ের নাচও দর্শক উপভোগ করেন। মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাত প্রশংসনীয়, তবে অনুষ্ঠান চলাকালীন সামনে বড় পর্দায় বিজ্ঞাপনের আলো দর্শকদের মনঃসংযোগে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। আজকাল বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই এই বিজ্ঞাপনের উৎপাত চোখে পড়ে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খোঁজা দরকার।