জ্যোতির্বলয়

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। তাঁর ছেলেবেলা, ঘর সংসার, সাহিত্যের প্রেম-অপ্রেম আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর সঙ্গে এক সন্ধের আড্ডা। স্মৃতিতে ফিরলেন প্রশান্ত মাজী বেলেঘাটার বারোয়ারিতলায় একটা বস্তি দেখে এসে আমাকে বললেন, ‘ওই বস্তিতে থাকতে হবে।’ আমি সম্মতি জানালাম। লেখার তাগিদে ওই বেলেঘাটার তেরো ঘর বস্তির মধ্যে আমরা ছিলাম। উনি তেরো ঘর নাম না দিয়ে উপন্যাসের নাম রাখলেন ‘বারো ঘর এক উঠোন’।’’ সাহিত্যিক স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে নিয়ে বলতে গিয়ে এক জায়গায় এমনই কথা লিখেছিলেন স্ত্রী পারুলদেবী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

বেলেঘাটার বারোয়ারিতলায় একটা বস্তি দেখে এসে আমাকে বললেন, ‘ওই বস্তিতে থাকতে হবে।’ আমি সম্মতি জানালাম। লেখার তাগিদে ওই বেলেঘাটার তেরো ঘর বস্তির মধ্যে আমরা ছিলাম। উনি তেরো ঘর নাম না দিয়ে উপন্যাসের নাম রাখলেন ‘বারো ঘর এক উঠোন’।’’

Advertisement

সাহিত্যিক স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে নিয়ে বলতে গিয়ে এক জায়গায় এমনই কথা লিখেছিলেন স্ত্রী পারুলদেবী।

ওঁদের আলাপেরও সূত্রপাত জ্যোতিরিন্দ্রর লেখালেখির সূত্রেই।

Advertisement

সময়কাল ১৯৪৫। দাদা-বৌদি-বোনেদের সঙ্গে তখন ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় চলে আসেন পারুল। ওঠেন ৮০/১ হ্যারিসন রোডে।

এক দিন তাঁর চোখে পড়ল বাড়িতে রাখা বাঁধানো ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার একটি গল্প। ‘শশাঙ্ক মল্লিকের নতুন বাড়ি’। লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।

জ্যোতিরিন্দ্রর সঙ্গে পারুলের আলাপ এর পরেই। ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিক্ষক ও পরে আইনজীবী অপূর্বচন্দ্র নন্দীর ছেলে জ্যোতিরিন্দ্র তখন সবে ঢুকেছেন কলকাতার জে ওয়াল্টার কোম্পানিতে। বিজ্ঞাপনের সামান্য কর্মী। গল্প লিখছেন দু’বেলা, দু’হাত খুলে।

তাঁর গল্প পড়েই বৌদির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের মাধ্যমে পারুলের আলাপ হল জ্যোতিরিন্দ্রর সঙ্গে। তখনই রীতিমতো লেখক হয়ে উঠেছেন তিনি।

জ্যোতিরিন্দ্রর কৃশ চেহারা। পরনে ময়লা ধুতি। পাঞ্জাবি। প্রথম দেখে পারুলের মনে ধরেনি। ধীরে ধীরে বোধহয় তাঁর লেখক-সত্তাটিকে ভালবেসে ফেলেন। পরে মানুষটিকেও।

পারুল-জ্যোতিরিন্দ্রের বিয়ে হয়ে যায় ১৯৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের দিনেও যে সেজেগুজে ‘বর’ সেজে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র, তা’ও নয়। একরাশ ঝাঁকড়া চুল। লন্ড্রি থেকে কাচানো ধুতি। ব্যস।

আজীবন অর্থের মুখ দেখেননি। জীবনে ‘জনপ্রিয়তা’ পাননি। তবু স্বামীকে নিয়ে পারুলদেবীর গর্বের সীমা ছিল না।

পারুল লিখেছিলেন, ‘‘মানুষটার মন কিন্তু কখনও অর্থহীনের মতো হয়ে পড়েনি।... মনের ছাপ একমাত্র ধরা পড়ত চোখ দুটিতে। চোখ দুটি দেখলেই বোঝা যেত মানুষটি কৃশ হয়েও কত শক্ত।’’

জ্যোতিরিন্দ্রর প্রিয় বিষয় ছিল একা-একা চারপাশকে শুধুই দেখে চলা। আর কল্পনার মিশেলে তাকে তাতিয়ে কাগজে কলমে ফোটানো। এবং সেই ফুটিয়ে তোলা যে কত সূক্ষ্ম, অনুপুঙ্ক্ষ! ...এ নিয়ে অদ্ভুত একটি গল্প আছে।

তখন ওঁর ‘ঝড়’ উপন্যাস সবে বেরিয়েছে একটি সাপ্তাহিকে। উপন্যাসের পটভূমি উত্তরবঙ্গ। চা-বাগান।

উপন্যাস প্রকাশের পর এক দিন এক যুবক সুদূর সেই চা-বাগান অঞ্চল থেকে খুঁজে খুঁজে কলকাতায় এসে হাজির। উদ্দেশ্য, লেখকের সঙ্গে একবারটি দেখা করা।

লেখা পড়ে যুবক আপ্লুত। বিস্মিত। স্থান-কাল-পাত্র সব যে তার দেখা শোনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে! লেখক নির্ঘাত এক সময় ওখানে বাস করেছেন!

যুবকের সঙ্গে দেখা হল জ্যোতিরিন্দ্রের। কিন্তু তাঁর উত্তর শুনে যুবকের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। জ্যোতিরিন্দ্র বললেন, ‘‘চা-বাগান তো দূরের কথা। আমি উত্তরবঙ্গের ধারেকাছে যাইনি।’’

তাঁর কল্পনার ধার ছিল এতটাই প্রবল! তা যে শুধু পরিণত বয়সে তা নয়, শৈশব থেকেই এমন। চারপাশের রূপ-রস-গন্ধে বরাবরই মজে যেতেন জ্যোতিরিন্দ্র। এবং তা যখন লেখায় এসে ছবি আঁকত, কেমন করে যে রং ছড়াত, নিজেও বুঝে পেতেন না!

এক জায়গায় জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘‘পূর্ব বাংলার ছেলে। প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ। দু’পা বাড়ালেই নদী। ধূ ধূ গ্রাম। গাছপালা, ক্ষেতখামার, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত। ড্যাবড্যাব করে পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকতুম। খেজুর আর ডালপালা ছড়ানো একটা ঝুপসি শেওড়া গাছের পিছনে লাল দগদগে আকাশ। ঝাঁক বেঁধে লাল ফড়িং উড়ছে। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। মা জিজ্ঞেস করত, ‘অত কি ভাবিস রে তুই?’ ছোটকা বলত, ‘ধনু আকাশ দেখছে।’ বড় পিসি বলল হয়তো, ‘না, না ও ফড়িং দেখছে।’ ঠানদি বলল, ‘না, না ওর ঘুম পেয়েছে।’ আমার কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। একেবারে তখন থেকেই নাক আর চোখ ছিল সজাগ। তিতাসের বুকে নৌকা দৌড় বা দুর্গাপ্রতিমার ভাসান বা ভাদ্রের পচা পাটের গন্ধ, অঘ্রাণের ঘ্রাণ, বর্ষার মৌরলা খলসের আঁশটে গন্ধ... কেমন যেন হয়ে যেতুম এবং তা থেকেই...। লেখা ব্যাপারটা তো বড় রহস্যময়। কোথা থেকে কী এসে যায়!’’

জ্যোতিরিন্দ্রের ভারী পছন্দের ছিল নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা, আত্মমগ্নতা।

সারা দিন শুধু চুপ করে বসে থাকতেন। বাদবাকি সময়টুকু শুধু লেখা আর পড়া।

মাঝে মাঝে আড্ডায় যাওয়া, বাড়ির এ দিক ও দিক হাঁটা।

দূরে বেশি কোথাও যাননি কখনও। বড়জোর পুরীর সমুদ্র কী শিমুলতলা, বেনারস, ঘাটশিলা।

একবার পুরী গিয়েছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। সে এক কাহিনি! প্রথম রাতে একা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বসলেন গিয়ে সাগরের পারে।

পরের বর্ণনা ওঁর মুখেই, ‘‘হঠাৎ কী বলব, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো সারা শরীরে একটা স্পার্ক খেলে গেল, শরীরটা শিউরে উঠল। আমার মনে হল, সামনে এক অসীম শূন্যতা ধূ ধূ করছে। এর যে শেষ কোথায়, বুঝে উঠতে পারিনি। তার পর থেকে যে ক’দিন পুরীতে ছিলুম প্রায় ছটফট করে কাটিয়েছি। কলকাতায় ফিরেই ‘সমুদ্র’ গল্পটা লিখি। তা লিখে বেশ ভাল লেগেছিল। ‘দেশ’ পত্রিকায় দিলাম। মনে আছে, সাগরবাবু (সাগরময় ঘোষ) উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘‘বুঝলে জ্যোতিরিন্দ্র, অফিসের টেবিলে বসে আমি পুরোপুরি সমুদ্রের ঝাঁঝ পেয়েছি।’’

‘দেশ’ সাহিত্য পত্রিকা, ১৩৭৬।

অগ্রজ প্রিয় লেখকদের নিয়ে লিখলেন অনুজ সাহিত্যিকেরা।

তাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে নিয়ে। ‘নীল রাত্রি ও বনের রাজা’।

জ্যোতিরিন্দ্র তখন জীবিত।

থাকতেন পিকনিক গার্ডেন্স হাউসিং এস্টেট-এ।

‘মীরার দুপুর’, ‘সূর্যমুখী’, ‘বারো ঘর এক উঠোন’ বা ‘প্রেমের চেয়ে বড়’ — এ রকম অনেক উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে।

তাঁর ‘গিরগিটি’, ‘খালপোল ও টিনের ঘরের চিত্র’, ‘বনের রাজা’, ‘নীল রাত্রি’র মতো কালজয়ী গল্প পড়ে পাঠক মুগ্ধ।

তেমনই এক সময় এক সন্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও এক কবি বন্ধুকে সঙ্গে করে হাজির হয়েছিলাম ওঁর হাউজিং-এর ফ্ল্যাটে। ঠিক সাক্ষাৎকার নয়, দুই সাহিত্যিকের আড্ডা হবে।

আমরা হব দোসর।

এমনই এক আব্দার করতে সুনীলদা বলেছিলেন , ‘‘আমি তো ঠিক স্মার্ট কথা বলতে পারি না, আর টেপরেকর্ডার থাকলে তো কথাই নেই। তা ছাড়া জ্যোতিদার সঙ্গে লেখাটেখা নিয়ে কী কথা বলব? ওই একটু গল্পগুজব করা যাবে।’’

আর এমনটা হতে পারে জানতে পেরে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বলেছিলেন, ‘‘আমার সাক্ষাৎকার? সুনীল আসবে এত দূরে আমার বাড়িতে কথা বলতে? বিশ্বাস করতে পারছি না বাবা!’’

তার পরেই দীর্ঘশ্বাস!

‘‘কী হবে আমার কথা শুনে? আমার লেখা কেউ পড়ে নাকি? আমার পাঠক কোথায়?’’

পিকনিক গার্ডেন্সের গোটা এলাকা সে দিন অন্ধকার। দু’ধারের দোকান থেকে মোমবাতি-লণ্ঠনের আলো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় এসে পড়েছে।

পথ হাতড়ে হাতড়ে অনেকগুলো ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা তিনজন।

‘‘জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কোন বাড়িতে থাকেন? ব্লক এল-এ, ফ্ল্যাট ৪ কোনটি?’’

গ্রীষ্মের বিকেল গড়িয়ে সবে সন্ধে হয়েছে। হাওয়া নেই। আলো নেই।

ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের অনেকেই বাড়ি ছেড়ে রাস্তায়।

সামনেই এক ভদ্রমহিলা।

প্রায় অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে না পেরে তাঁকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম। এক লহমা তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘‘আরে আরে আসুন। আপনারাই তো সে দিন এসেছিলেন ওঁর কাছে। ... আর আপনি তো সুনীল গাঙ্গুলি। ... আসুন, সাবধানে পা দেবেন সিঁড়িতে। অন্ধকার তো।’’

অন্ধকার চোখে সয়ে যেতে আমরাও চিনে গেছি তাঁকে।

শ্রীমতী পারুল নন্দী।

দোতলায় ফ্ল্যাট। দরজা খোলাই ছিল। কথাবার্তা, জুতোর শব্দে অভিপ্রেত মানুষটি আগেভাগেই আন্দাজ করে বাতি হাতে দোরগড়ায় চলে এসেছেন।

পরনে লুঙ্গি। গায়ে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কোঁকড়ানো চুল।

‘‘এসে এসো সুনীল। কদ্দিন পরে দেখা। অ্যাঁ!’’

এক্কেবারে নিরাভরণ একটি ঘর। বুকসেলফ। ছোট্ট একটা চেয়ার। টেবিল। ইতস্তত ছড়ানো কিছু পত্রপত্রিকা। আর কিচ্ছুটি নেই।

একটু বাদে পারুলদেবী চা আনতে গেলেন। ওঁর যাওয়ার পথে নজর রাখতেই পাশের ঘরের আলোছায়ায় চোখে পড়ল একটা সেতার।

জিজ্ঞাসু চোখে চাইতেই পাশেই বসা ওঁদের ছেলে তীর্থঙ্কর বললেন, ‘‘মা বাজান।’’

শুরু হল আড্ডা।

সপরিবার

সুনীল: নস্যি নেন না আর?

জ্যোতিরিন্দ্র: না। বিড়িটা খাই।

সুনীল: শরীর তো বেশ খারাপ যাচ্ছে?

জ্যোতিরিন্দ্র: গ্যাসট্রিক। বুঝলে কি না.. টেবিল ওয়ার্ক একটুআধটু করতে পারি। কিন্তু...

সুনীল: লিখতে কী অসুবিধে হচ্ছে?

জ্যোতিরিন্দ্র: ভাবনাগুলো ঠিক মাথার মধ্যে খেলাতে পারছি না। আর কী হবে বলো..চার দিকে দুঃসংবাদ। বনফুল চলে গেলেন। কমলবাবু (কমলকুমার মজুমদার), দীপেন (বন্দ্যোপাধ্যায়)...। দীপেনের জন্য এক দিন বিকেলে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বয়স তো কিছুই হয়নি। কমলবাবুর কী অসুখ করেছিল?

সুনীল: শুনলুম কার্ডিয়াক-অ্যাজমা জাতীয়... আচ্ছা, জ্যোতিদা, সেই অষ্টমীর দিনের আড্ডাটা মনে প়ড়ে? কমলদা, সাগরদা (সাগরময় ঘোষ), আপনি, আমরাও কয়েক বার...

জ্যোতিরিন্দ্র: ভালই মনে আছে। শরীরের ওপর অত্যাচার তো হয়েইছে। নইলে... আচ্ছা, তোমাকে সব সময়ই সুস্থ দেখি। এত হুল্লোড়ে আছ, অথচ শরীরটা ঠিক রেখেছ...

সুনীল: একটুআধটু কী হয় না! আমার অ্যাসিডের ধাত। পাত্তা দিই না। জেলুসিল খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।

(পারুলদেবী চা-মিষ্টি নিয়ে এলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র বলে উঠলেন, ‘‘আমাদের আড্ডা তো দেখছি জেলুসিল আর নস্যি-বিড়ির দিকে চলে যাচ্ছে! তোমরা তো আবার সাহিত্যও চাও। তা বলো, সাহিত্যের কী জানতে চাও?)

সুনীল: আপনার প্রথম লেখা বোধ হয় ঢাকার কাগজেই?

জ্যোতিরিন্দ্র: হ্যাঁ। কলেজে ঢুকেই ঢাকায় সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’-তে একটা অনুবাদ গল্প পাঠাই। ছাপা হয়। তার পর থেকেই বুঝলে কিনা, একের পর এক গল্প লিখতে থাকি। ছাপা হতে থাকে। কলকাতার ‘নবশক্তি’-তে তখন সম্পাদক প্রেমেন মিত্র। সেখানেও...

সুনীল: কলকাতায় কখন আসেন?

জ্যোতিরিন্দ্র: সেটা বোধ হয় ১৯৩৭-৩৮। ’৩৬ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘রাইচরণের বাবরি’ নামে আমার একটা গল্প বেরয়। তার পরই চলে আসি। চাকরিবাকরি তো দরকার।

সুনীল: আচ্ছা, একজন লেখকের জীবিকা কী রকম হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

জ্যোতিরিন্দ্র: কোনও চাকরিই ভাল লাগেনি। তুমি কী বলো?

সুনীল: লেখকদের জন্য জীবনানন্দই (দাশ) তো বলেছেন, পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকরি।

জ্যোতিরিন্দ্র: তাই তো। গোটা দুই টিউশনি করতাম। আর সাহিত্য। সিনেমা, খেলাধুলো কিচ্ছু না। তবে এখন ভাবলে...বুঝলে ... খারাপই লাগে... কী ছেলেমানুষিই না করেছি! তার ঠেলা এখন সামলাতে হচ্ছে।

সুনীল: কখনও প্রচুর লিখতে ইচ্ছে করেছে?

জ্যোতিরিন্দ্র: না। একদম না। একটা গল্পও কয়েক মাস ধরে লিখেছি।

সুনীল: এখনকার লেখালেখি পড়েন?

জ্যোতিরিন্দ্র: পড়ি। ভাল অনেকেরই লাগে। কিন্তু ভাল হলেই তো আর সব হয়ে গেল না। স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো লেখা কই! আমাদের লেখা শুরুর সময় সে সব কী গল্প পড়তুম! বিভূতিবাবুর ‘পুঁইমাচা’, বুঝলে, হঠাৎ এক দিন একটা কাগজে গল্পটা পড়ে ফেলি। তার পর কী করি জানো? ব্লেড দিয়ে গল্পটা কাগজ থেকে কেটে নিয়ে মাথার বালিশের নীচে রাখি। মানে, প্রায়ই পড়ব আর কী! কই সেই উত্তেজনা তো এখন পাই না! ... আসলে কী জানো? আরও নিষ্ঠা চাই। আরে বাবা! তুমি এক জন লেখক। তা তোমার কাছে প্রেমিকা ছাড়া আর কিছু নেই? তোমার মা আছে, ভাই, বোন সব আছে। অথচ লিখতে গিয়ে শুধু প্রেমিকা আসছে কেন? মাকে নিয়েও তো লিখতে পারো। বুড়ো বাবা, ছোকরা বাবা... প্রেম তো তাদের সঙ্গেও হয়।

আমরা: আপনার লেখা শুরু করার সময় কাদের লেখা ভাল লাগত?

জ্যোতিরিন্দ্র: ‘কল্লোল’-এর লেখকদের। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু...

আমরা: মানিকবাবুর (বন্দ্যোপাধ্যায়) লেখা সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?

জ্যোতিরিন্দ্র: ওঁর বেশির ভাগ লেখাই ভাল লাগে না। ‘হলুদপোড়া’, ‘সরীসৃপ’ নিয়ে খুব হইচই হয়েছে, আমার তো তেমন ভাল লাগেনি বাপু! ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কিন্তু ভাল লেগেছিল। স্তব্ধ হয়ে যাই।

সুনীল: শরৎচন্দ্র?

জ্যোতিরিন্দ্র: একদম ভাল লাগে না। প্রথম দিকে ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ভাল লেগেছিল। এখন তো পড়ি না। তবে আমার ধারণা, এখন ভাল লাগবে না। তোমার?

সুনীল: আমি তো প্রায় পড়তেই পারি না। কিন্তু ভাবুন, রবীন্দ্রনাথের লেখা! কী প্রবন্ধ, কী উপন্যাস, গান...

জ্যোতিরিন্দ্র: তা বটে! ‘চতুরঙ্গ’, ‘চার অধ্যায়’ এখনও আমার ভাল লাগে। আচ্ছা, তুমি কমলকুমারের লেখা পছন্দ করো দেখেছি। কেন বলো তো? আমার তো ভাল লাগে না। বুঝতে পারি না। অত জটিল করে লেখেন!

সুনীল: আসলে কমলবাবুর ব্যাপারটা একটু আলাদা ভাবে ভেবে দেখা দরকার। একটা দেশে এ রকম লেখক এক-আধজনই থাকেন, যাঁরা খ্যাতি চান না। পাঠক নিয়ে ভাবেন না। পাঠকরা পরিশ্রমী না হলে এ সব লেখা নিতে পারা একটু কঠিন...

আমরা: আপনি তো একেবারে প্রথম দিকে কবিতা লিখতেন?

জ্যোতিরিন্দ্র: সে খুবই ছোটবেলায়। সেভেন-এইটে পড়ার সময়। আঁকতুমও। এক বার একটা হাতের লেখা কাগজ বার করেছিলাম। তাতে আঁকা, কবিতা দুই-ই ছিল। এখন ভাবলে হাসি পায়।

সুনীল: আপনার ‘প্রেমের চেয়ে বড়’-তে তো অনেক কবিতা ছিল। তা এখন কবিতা পড়েন?

জ্যোতিরিন্দ্র: মাঝে মাঝে। নীরেনবাবু (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) আর তোমার কবিতা বেশ ভাল লাগে। আর শক্তির (চট্টোপাধ্যায়) কবিতা... মনে হয়... বেশ ভাল হচ্ছে... কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি না। এ রকম কেন হয় বলো তো?

সুনীল: আসলে আমার কবিতা তো প্রায়ই স্বগতোক্তি। তাতে একটা কাহিনি বা দৃশ্য বা বর্ণনামূলক ব্যাপার থাকে। আর শক্তির কবিতা হল শব্দনির্ভর। তাই বোধ হয়...

আমরা: আপনার পরবর্তী কালের গদ্যলেখকদের সম্পর্কে...

জ্যোতিরিন্দ্র: সুনীলের লেখা তো ভাল লাগে, বলেছি। সমরেশ (বসু) একজন বড় লেখক। ওর ‘সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই। এ ছাড়া মতি (নন্দী), শীর্ষেন্দু (মুখোপাধ্যায়), দিব্যেন্দু. (পালিত).. আর সন্দীপনের (চট্টোপাধ্যায়) গদ্য ভাল লাগে।

আমরা: আপনার লেখকজীবনের দুটো একটা স্মৃতি বা ঘটনার কথা বলবেন?

জ্যোতিরিন্দ্র: স্মৃতি... ঘটনা... কী বলব ঠিক?...কী বলব সুনীল?

সুনীল: না মানে এত দিন ধরে লিখছেন। কত ব্যাপারই তো ঘটে।

জ্যোতিরিন্দ্র: আমার বাবার কথা মনে পড়ে। খুব ছোট থেকেই আমি মায়ের চেয়ে বাবার বেশি ভক্ত। বাবা চিরকালই আমাকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। ছোটবেলা থেকেই বই পড়া, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা প্রত্যেকটা ব্যাপারে এত উৎসাহ দিতেন...একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। শহরের নানা কাগজে তখন আমার লেখা বেরচ্ছে, এ দিকে বাবা এই ব্যাপারটা কেমন ভাবে নিচ্ছেন, ঠিক বুঝতে পারতুম না। বাবা কাছারি যাবার সময় আমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতেন আমি কেমন মনমরা হয়ে টেবিলে ঝুম মেরে বসে থাকতুম। কাছারি থেকে বাড়ি ফিরেও সেই একই ভাবে আমাকে বসে থাকতে দেখতেন। তা এক দিন কী হল, বাবা কাছারি থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢোকার আগে আমার ঘরে ঢুকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, ওই যে তুই লিখতিস-টিখতিস, তা এখন লিখিস তো? ওটা ছাড়িস না। লিখবি... লিখে যা। তোমাদের কী বলব সুনীল, বাবার ওই ডায়লগ আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। এর পর বললে বিশ্বাস করবে না, যত দিন গল্প লিখেছি, কেবলই মনে হয়েছে, টেবিলের পিছনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আর কেবলই বলছেন, ‘অ্যাই ওটা ঠিক হল না। কেটে দে। আবার লেখ।’ কেটেছি। আবার লিখেছি। ফাঁকি দিইনি একটুও।... কিন্তু কী হল বলো?

সুনীল: কী যে বলেন! আপনি বাংলা ভাষায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক...

জ্যোতিরিন্দ্র: আর বড় লেখক... এখন তো আমরা বুড়ো ঘোড়া। এই দেখো না, এখন তো আমার ছেলেই বলে, আমার লেখাতে নাকি বড় বেশি ডিটেল। আধুনিক নয়।

সুনীল: এ বার উঠব জ্যোতিদা, অনেক রাত হল। শেষে একটা অনুরোধ জানাচ্ছি, এ বার আত্মজীবনীমূলক একটা বড় লেখায় হাত দিন। আমার মনে হয়, এটা আপনার কাছ থেকে আমাদের পাওয়া দরকার।

এর মধ্যে আলো কখন এসে গেছে, খেয়ালই ছিল না! পারুলদেবী চা নিয়ে ঢুকলেন।

আমরা তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম।

রাত তখন দশটা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement