Indian Classical Music Evening

সুরধ্বনিত এক স্মরণীয় সন্ধ্যা

দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রথম উপস্থাপনা চব্বিশটি তারবিশিষ্ট ‘চতুরঙ্গী’। এই যন্ত্রে তিনি পরিবেশন করলেন রাগ কেদার।

Advertisement

গৌরব দত্ত

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১৯
Share:

মঞ্চে উপস্থাপনায় শিল্পীরা।

সম্প্রতি অখিল ভারতীয় সঙ্গীত কলা রত্ন সভার উদ্যোগে, শোভাবাজার রাজবাড়ির ঐতিহ্যময় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক অনন্য সন্ধ্যা।‘দেব-তার’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় স্লাইড গিটার বিশারদ পণ্ডিত দেবাশিস ভট্টাচার্যনিজের উদ্ভাবিত স্লাইড গিটার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত চার ধরনের যন্ত্রে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত এবং উপমার্গসঙ্গীত পরিবেশনা করলেন। তাঁকে তবলায় সহযোগিতাকরলেন ভারতীয় তালবাদ্য জগতের আর এক দিকপালপণ্ডিত কুমার বসু।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রথম উপস্থাপনা চব্বিশটি তারবিশিষ্ট ‘চতুরঙ্গী’। এই যন্ত্রে তিনি পরিবেশন করলেন রাগ কেদার। সেতারের মিষ্টত্ব এবং রুদ্রবীণার গাম্ভীর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় স্পষ্ট ছিল তাঁর ধ্রুপদ আঙ্গিকে বাজানো আলাপ-জোড়-ঝালায়। মধ্যমের উপর ন্যাস করে শিল্পী যে ভাবে এই অংশের পরিসমাপ্তি করলেন, তা বেশ অপ্রচলিত এবং ততোধিকমধুর। এর পরে বিলম্বিত ত্রিতালের গৎ-এ সেনিয়া মাইহার ঘরানার বাজ, বিস্তার, লয়কারি এবং কুমার বসুর বাদ্যে সেই লয়কারি এগিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রতিটি আবর্তনের সমাপ্তি বড়ই রোমাঞ্চকর। চতুরঙ্গীতে শেষ পরিবেশনাছিল দ্রুত একতালের বন্দিশ‘এ নভেলি নার’-এর ছায়া অবলম্বিত একটি গৎ।

এর পরের যন্ত্র পুষ্পবীণা। চামড়ার ছাউনি দেওয়া ‘পেয়ালা’ বা ‘লাউ’ থাকার ফলে এই যন্ত্রটির সুর-ঝঙ্কারে পাওয়া যায় সরোদ এবং ব্যাঞ্জোর এক অসাধারণ মেলবন্ধন। এই যন্ত্রে দেবাশিস ভট্টাচার্য প্রথমে অল্প পরিসরে বাজান তারই সৃষ্ট রাগ ‘পলাশপ্রিয়া’। আশাবরী ঠাটের ছত্রচ্ছায়ায় তৈরি এই রাগে তিনি একটি গৎ বাজান দীপচণ্ডী তালে, সাথে কুমার বসুর সুললিত এবং পরিমিত সঙ্গত গতের মাধুর্য অটুট রেখেছিল। এর পরে বাদী স্বর মধ্যম স্থির রেখে দেবাশিস ভট্টাচার্য রাগ ভীমপলশ্রীতে একটি মধ্য লয় ঝাঁপতালের বন্দিশ ধরেন। বাদনশৈলীর দক্ষতা এবং সাঙ্গীতিক পাণ্ডিত্যের রেশ ধরে রেখে দু’জনেই চৌগুণে সাথ-সঙ্গের মাধ্যমে এই অংশের সমাপ্তি করেন এবং এরপর একই রাগে দ্রুত থেকে অতি-দ্রুত ত্রিতালে গিয়ে সওয়াল-জবাব এবং ঝালা বাজিয়ে পুষ্পবীণায় ভীমপলশ্রীর উপস্থাপনায় যবনিকা টানেন।

Advertisement

পুষ্পবীণার পরে মঞ্চে ডাক পড়ে দেবাশিস ভট্টাচার্যের নিজের কথায় তাঁর ‘দ্বিতীয় সন্তান’ গান্ধর্বীর। ১২ জোড়া তার সম্বলিত এই যন্ত্রটির উদ্ভাবনার অনুপ্রেরণা দক্ষিণ ভারতের প্রস্তর-খচিত মন্দিরগুলি। এর তারের ঝঙ্কারে যেমন রয়েছে পাথরের দৃঢ়তা, তেমনই রয়েছে তার শীতলতা। সমস্বরে বাঁধা একাধিক তারের ভাবনা আমরা পাই পাশ্চাত্যের ম্যান্ডোলিন, বা উত্তর ভারতীয় সন্তুরের মধ্যে, কিন্তু গান্ধর্বীতে শোনা যায় দু’টি ভিন্ন সপ্তকের সমমেল এবং সুষির বাদ্যের মতো অতিদীর্ঘ অনুরণন। এই যন্ত্রে প্রথম পরিবেশনা রাগ তিলক কামোদ। বাজালেন আদ্ধা তালে বাঁধা মাইহার ঘরানার অতি পরিচিত গৎ। তিলক কামোদের শৃঙ্গার রসের সঙ্গে পণ্ডিত কুমার বসুর বেনারস ঘরানার বীর রসের বাদনশৈলী মিশে বুনে চলেছিল কোন এক অপরূপ প্রেমগাথা। পুষ্পবীণায় দেবাশিসের দ্বিতীয় নিবেদন ছিল কর্নাটকি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আঙ্গিকে রাগ কলাবতীতে রচিত দ্রুত আদ্ধা তালে বাঁধা একটি গৎ। এর সাথে কুমার বসু বড় মুখের তবলায় মৃদঙ্গমের রূপ আনার যথাযথ প্রচেষ্টা করলেন।

‘দেব-তার’ পরিবারের চতুর্থ সদস্য ছিল আনন্দী। দেবাশিস ভট্টাচার্যের তৈরি এই যন্ত্রে মাত্র চারটি তার। বাকি তিনটি যন্ত্রের মতো চিকারি এবং তরফের তার না থাকায় এই যন্ত্রে রাগসঙ্গীতের ঠিক এবং সম্পূর্ণ উপস্থাপনা সম্ভব নয়, বরং উপমার্গসঙ্গীত অথবা লঘুসঙ্গীত বাজানোর জন্য আদর্শ এ যন্ত্র। হাওয়াইয়ান গিটার বা ইউকুলেলের মতো কিছুটা দেখতে এই যন্ত্রে দেবাশিস ভট্টাচার্য ধরলেন একটি ভাটিয়ালি ধুন। বাজানোর মাঝে মাঝে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কর্ডের ব্যবহার বেশ স্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছিল। ভাটিয়ালি সুর থেকে ক্রমে ভৈরব এবং অতঃপর ভৈরবীর রূপ দেখা যেতে থাকে। কুমার বসু তবলায় কাহারবা তালে ভজনী ঠেকার আঁট বন্ধন ধরে রাখেন। আনন্দীতে ভৈরবীর পরিবেশনে পূর্ণ দর্শকাসনে স্বতঃস্ফূর্ত করতালির রেশ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পজগতের বহু গুণিজন এবং শিল্পানুরাগীরা। তবলিয়া অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, হারমোনিয়াম শিল্পী জ্যোতি গোহ, চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ, নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের মতো বহু বিশিষ্ট মানুষ এ দিনের অনুষ্ঠান উপভোগ করলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement