পরিবেশবন্ধু: কৌস্তুভ চক্রবর্তীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
শহরে একটি নতুন গ্যালারিতে কৌস্তুভ চক্রবর্তীর ‘ইকোটোন’ নামে একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি। গ্যালারির নাম বি-ক্যাফ— ‘ব্রিজিং কালচার অ্যান্ড আর্টস ফাউন্ডেশন।’ এই অলাভজনক সংস্থায় শিল্প সম্পর্কিত সব ধরনের বিষয় নিয়েই শিল্পীদের উৎসাহিত করা হবে, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থাকবে এবং চারুকলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে।
প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইকোটোন’, কারণ মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি এবং তার সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন শিল্পী। জীবের সঙ্গে তার পরিবেশের মধ্যকার সামগ্রিক সম্পর্ক এবং পরিস্থিতি নিয়েই প্রদর্শনীর সব ছবি।
কৌস্তুভ চক্রবর্তী সাহিত্যের ছাত্র এবং স্বশিক্ষিত শিল্পী। বরাবরই তাঁর কাজে পরিবেশ দূষণ ছাড়াও বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তাঁর শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পরিবেশ সচেতনতা। ‘জলাদর্শ কালেক্টিভ’ নামে একটি সংস্থার যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতা কৌস্তুভ। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে তাঁর আদর্শগত বিশ্বাস, শৈল্পিক ধ্যানধারণা এবং ওই জলাদর্শ কালেক্টিভের মূল কথাটি তুলে ধরা হয়েছে, শিল্পীর সৃজনশীলতার প্রকাশকে সঙ্গী করে।
পরিবেশবন্ধু: কৌস্তুভ চক্রবর্তীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
মানুষের প্রতি ভালবাসা, জীবজগতের প্রতি সহানুভূতি, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা এবং মানুষের মধ্যে পরিবেশ-চেতনা জাগিয়ে তোলা, সর্বোপরি শিল্পের মাধ্যমে সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করে থাকেন কৌস্তুভ। এই শিল্পীর আধুনিকতার সঙ্গে সে রকম হৃদ্যতা নেই। ডিজিটাল দুনিয়া থেকে তিনি বহু দূরে অবস্থান করেন। তাঁর হাতে স্মার্টফোন নেই। তবে তিনি কী ভাবে কাজ করেন? মাটি ও মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে বাস করেন এই শিল্পী, সজাগ এক মন নিয়ে। শিল্পমাধ্যম অবলম্বন করে তাদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান।
কী ভাবে মাটি এবং জল একত্রে নিজেদের সমৃদ্ধ করে, তা দেখা গেল এই প্রদর্শনীর কাজে। সেখানেই পশুপাখি, কীটপতঙ্গ কিংবা পাহাড় ও ঘাসজমির সহজাত একত্রবাস। কৌশিকের ‘দ্য রিভার’ ছবিটিতে দেখা গেল স্বচ্ছন্দে বইছে নদী। সেখানে নানা রকম কার্যকলাপ চলছে, যেমন মাছ ধরা, নৌকা বেয়ে চলে যাওয়া, দূরে ছোট ছোট টিলা, আকাশে মেঘ। একেবারে সামনে গাছের সারি এবং ফুল ফুটে আছে। মিশ্র মাধ্যমে করা একটি শান্তিপূর্ণ ছবি, যেখানে শিল্পী পেন, ইঙ্ক, সফ্ট প্যাস্টেল এবং অ্যাক্রিলিক রং ব্যবহার করেছেন রঙিন কাগজে। মোটামুটি পুরো ছবিতে একই কালার টোন রেখেছেন। হয়তো বোঝাতে চাইছেন যে এরা সকলে একই সূত্রে বাঁধা।
এই সিরিজ়ে আরও তিনটি ছবি দেখতে পাওয়া গেল। একটির নাম ‘দ্য ক্যানাল’। নদী তার রূপ পাল্টে শহরের ভিতরে খাল হয়ে অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে। এখানে দূরে একটু বড় বড় বাড়ি এবং একটি সেতু। কাছে ছোট বাড়ি, মানুষ। সকলে কর্মরত কিন্তু মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আবার সেই একই টোনে মিশ্র মাধ্যমে কাজ করেছেন কৌস্তুভ। সম্ভবত ছবিটাকে ভাল ভাবে বাঁধার জন্য।
পরিবেশবন্ধু: কৌস্তুভ চক্রবর্তীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
ঠিক একই ভাবে আরও দু’টি ছবি করেছেন তিনি। ‘দ্য ওশান’ এবং ‘দ্য পন্ড’। প্রথম ছবিটিতে বিশাল সমুদ্র, সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ ধরার নৌকা এবং দূরে একটি জাহাজ। সমস্তটাই খুব স্বাভাবিক। যতটুকু মানুষের প্রয়োজন, ততটাই। ‘দ্য পন্ড’ ছবিটিতে জলাশয় ছোট্ট হয়ে মানুষের কোলের কাছে ধরা দিয়েছে। বড় আরামদায়ক এই ছবিটি।
এর পরের ছবি ‘ব্রিদিং রুটস’। এখানে ম্যানগ্ৰোভ ধরনের গাছের ছবি এঁকেছেন শিল্পী। নোনা জলে বেঁচে থাকা ওই গাছগুলির শিকড়ের ছবি স্পষ্ট। ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের জন্য এই গাছের গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝাতেই এই ছবির অবতারণা।
আরও একটি ছবি উল্লেখ্য, যার নাম ‘দ্য টক্সিক সিলভার স্পুন অব সিভিলাইজ়েশন’। মানুষেরই সৃষ্ট মৃত্যু এবং ক্ষয় দেখানো হয়েছে, জন্ম ও পুনরুজ্জীবনের জায়গায়। এখান থেকে আশা হারাচ্ছেন শিল্পী। রঙিন কাগজে কালি-কলম, প্যাস্টেল এবং অ্যাক্রিলিকের ছবি।
অপর একটি ছবির নাম, ‘কনসায়েন্স ইন আ ব্রাউনফিল্ড সাইট’। বিবেক বা শুভবুদ্ধির কথা বলেছেন এখানে শিল্পী। খনি থেকে কয়লা বা খনিজ নিষ্কাশনের পর দেখা যাচ্ছে, সেখানে হাওয়া নেই, জল নেই, জীবন নেই। আছে শুধু মানুষের জন্মজন্মান্তরের লোভ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
‘দ্য পিন্সার্স অব এ ব্রিক কিলন’ ছবিতে কৌস্তুভ দেখাচ্ছেন যে, বসবাসের জমি গ্ৰাস করছে ইট ভাটা, ইটের পাঁজা। কোনও দিকে যেন তাকানোর ফুরসত নেই। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো পিষে ফেলছে সভ্যতার রসকষ। এই পর্যায়ে, পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে মানুষের সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি যেন কর্কট রোগের মতো— তাই-ই ধরা পড়েছে শিল্পীর কাজে।
কৌস্তুভ চক্রবর্তীর ছবির বিশেষত্ব হচ্ছে তাঁর ড্রয়িং। প্রথমে কলম এক ভাবে টেনে নিয়ে একটানে পাহাড়, বাড়িঘর, মানুষ, গাছ, নদী, পশুপাখি সব কিছু এঁকেছেন। ওই ভাবে ড্রয়িং করায় ছবিগুলো খুব স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে। তার পরে রং ফেলেছেন কাগজে।
গঙ্গার ধারে বেড়ে ওঠা, নদীতে মাছ ধরা, পুকুরে স্নান করা, বাল্যসঙ্গীদের সঙ্গে ছেলেবেলার সেই জীবন থেকে শুরু করে শেষে শহুরে জীবন দেখিয়ে সভ্যতার চরম সঙ্কট তুলে ধরেছেন কৌস্তুভ, তাঁর সৃষ্টিতে। ভবিষ্যতের জন্য তাঁর এই কাজ বিশেষ ছাপ রেখে যাবে।