প্রতীচী-র মূল দরজাছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
থাকেন দো’তলায়।
দু’বেলা বার কয়েক ওপর-নীচ করেন সিঁড়ি ভেঙেই।
দুপুরবেলাও যে একটু বিশ্রাম নেন, তাও না। সারা দিনই কাজ, কাজ, শুধু কাজ।
কাকভোরে উঠে সেই যে দিন শুরু, শেষ হতে গভীর রাত।
অমর্ত্য সেন।
তিরাশি বছর ছোঁওয়া ‘নোবেল’-যুবক।
‘প্রতীচী’-র ভেতর-দরজার মুখে প্রথম দর্শনে শুধু বললেন, ‘‘এখন আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। চলুন ভেতরে গিয়ে বসে কথা বলি।’’
এর পর ওঁর অন্দরে ঢুকে সারা দিনের যে নকশা পাওয়া গেল, যে কোনও তরতাজা বাঙালি যুবককে তা চমকে দিতে পারে!
সকাল ৬টা-৬টা ৩০: মোটামুটি ওটাই তাঁর ঘুম থেকে উঠে পড়ার সময়। আগের রাতেই রানিকে বলে রাখেন, ‘‘তুমি ক’টায় উঠবে? ছ’টা কিংবা সাড়ে ছ’টা নাগাদ চা-টা দিয়ে দিয়ো।’’
রানি, সোম, মাকু, পাকু— ওঁরাই এখন সারা দিনের দেখভাল করেন ওঁর। সোম আর রানি স্বামী-স্ত্রী। রাতে দু’জনে ‘প্রতীচী’-তে থেকে যান। ফিরে যান মাকু-পাকু।
আর আছেন অরবিন্দ। এই মানুষটিও ওঁর আরেক ছায়াসঙ্গী। বাড়ি থেকে চলে আসেন সকাল দশটায়। বিকেল ৪টে নাগাদ একটু বাড়ি ফেরা। আবার চলে আসেন সন্ধে ৭টা। দরকার পড়লে কোনও কোনও দিন তারও আগে।
সকাল ৮টা কি সাড়ে ৮টা: ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটের মর্নিংওয়াকের শুরু তখনই। বাঁ ধারে ‘ডিয়ার পার্ক’-কে রেখে লাল বাঁধের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেখানেই তাঁকে আগে হাঁটতে দেখা যেত। এখন পিয়ারসন পল্লির ভেতর দিয়ে কালীগঞ্জের মুখ পর্যন্ত যান। তার পরে ফিরে আসেন। ইদানীং আর সাইকেল ব্যবহার করেন না।
প্রাতঃভ্রমণে ওঁর সঙ্গী হন সৌমিক, শান্তভানু, শিবাদিত্য। কখনওসখনও তন্ময়। এ সময় যে সঙ্গ পেতেই হবে, এমন নয়। তবে কেউ থাকতে চাইলে আপত্তি করেন না।
কিন্তু ‘দেহরক্ষী’ নৈব নৈব চ। সে আজ বলে নয়, কোনও কালেই না-পসন্দ।
সকাল-ভ্রমণ থেকে ফিরে: এ বার প্রাতরাশ। মুড়ি, একটু সর্ষের তেল। শশা-আদা-পেঁয়াজ কুঁচি। ভিজে ছোলা। বাদাম। কোনও সময় পাকা কলা কী পাকা পেঁপে। শীতে খেজুর-পাটালিও। গরমকালে পাকা আম। আম খুব পছন্দ করেন।
তার মাঝেই শুরু হয়ে যায় এক দফা কাগজ পড়া। ইংরেজি প্রায় সব ক’টিই। বাংলারও কয়েকটি। নীচের তলার দালানে বসে।
কাগজে মন দিলে আর কোনও কথা নয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া। তখন কেউ ঘেঁষেন না তাঁর কাছে।
ঘণ্টাখানেক পরে চলে যান ওপরে। তার পরও নিজের কাজ। স্নান।
মধ্যাহ্নভোজন: ১টা ৩০-এর কাছাকাছি। অল্প ভাত। শাক একটা চাই। পোনকা, লাল শাক কী মেথি। মশুর নয়তো মুগ ডাল। পাঁচমিশেলি তরকারি। মাছ হলে বড় মাছ।
কালেভদ্রে এক-দু’ টুকরো মুরগি কি পাঁঠার মাংস। তাও মেয়েরা এলে-টেলে। খুব পছন্দ টক দই।
মাঝে মধ্যে সকালে রুটিও খান। তবে যাই-ই হোক, ঝাল একদম নয়। খানও খুব হালকা।
কোনও কিছুতেই বাহুল্য পছন্দ নয়।
জামা সুতিরই পছন্দ করেন। তাতেও হালকা রং। হালকা নীলই বেশি পরেন। ট্রাউজার সুতির, নয়তো কর্ডের।
ঘড়ি বা চশমার কোনও শখ নেই। শখ নেই গাড়ি নিয়েও।
তবে গাড়িতে উঠে বসলে ‘সিট বেল্ট’ বাঁধা চাই-ই। সে পিছনের সিটে বসলেও।
দুপুরবেলা: ঘুমের কোনও প্রশ্নই নেই। খুব দরকার হলে বাইরের লোকজন বা ওঁর অফিসের লোকদের সঙ্গে দেখা করেন।
খাওয়া শেষে এক কাপ কফি দিতে বলেন রানিকে।
বাড়ির পিছন দিকে যে বাগান, সে দিকে যাওয়ার মুখেই দরজা।
সেই দরজা পেরোলেই লাল মেঝের রোয়াক। তার পর বড় বাগান। এক সময় এ দিকে একটা বাস্কেটবল কোর্ট করা হয়েছিল, ওঁর ছেলের জন্য। এখন শুধু গাছ আর গাছ।
‘প্রতীচী’-র মূল ফটক থেকেই নাক বরাবর তাকালে এই বাগানটা নজরে আসে। মাঝে পেরোতে হয় লোহার ছোট দরজা। সে বাধা গেলে একে একে আরও তিন কাঠের দরজা। বাগানে যাওয়ার ঠিক আগে বড় দালান মতো। তার এক দিকে রান্নাঘর। অন্য দিকে যে ঘর, সেখানে শেষ দিন অবধি কাটিয়ে গিয়েছেন ওঁর মা অমিতা সেন, বাবা আশুতোষ সেন।
বাগানে যাওয়ার দরজার পাশেই সিঁড়ি। দোতলায় ওঠার। ওপরে ওঁর ঘর ছাড়াও বড় একটি হল ঘর। তার পরের ঘরটিতে মেয়েরা এলে থাকেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এলে তাঁদের সঙ্গে ওখানেই কথা বলেন।
সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই চোখে পড়ে দেওয়ালজোড়া বইয়ের আলমারি। কম্পিউটার। ওঁর পড়ার জায়গা।
পাঁচিল ঘেরা প্রতীচী-র গোটা চৌহদ্দিতে কত যে গাছ! সব ওঁর বাবা ড. আশুতোষ সেনের লাগানো। নানা রকম আম। সবেদা, লিচু, গোলাপজাম, আমলকী, বেল, বকুল, জামরুল, তেজপাতা। পিছন দিকে প্রায় সবটাই সোনাঝুরি। দু’একটা কদম আর বকুল।
বাগানের দিকে লাল রোয়াকটাতে চেয়ারে বসে কাগজ পড়েন দুপুরবেলা। পাশে কফির কাপ রাখার টেবল। কাগজ বইপত্র রাখারও। সারা দিনে ডাকে যা চিঠিপত্র বা বইপত্র আসে, ওখানে বসেই সেটা দেখেন।
কাগজ পড়তে পড়তে ফোন এলে একটু কথাও বলে নেন।
বিকেল ৩টে কী ৪টে: এ সময় উঠে যান দোতলায়। এ বার নিজের কাজ। চলল তো চলল। ল্যাপটপে। বক্তৃতা তৈরি, ‘পেপার’ তৈরি, লেখালেখি, পড়াশোনা।
সন্ধেয় এক দফা হালকা খাওয়া। একটু মুড়ি। এক কাপ চা। চা বা কফি প্রতিবারই চিনি ছাড়া। কিন্তু দুধ দেওয়া।
সন্ধে নাগাদ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফোনও আসে। কথা বলেন। অন্যান্য জায়গা থেকেও অনেক ফোন আসে। সেগুলোও ধরে নেন।
বাগানে
রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা: রাতের খাবার। একেবারে সকালের মতোই। হালকা।
কোনও সময়ই রেস্তোরাঁয় যান না। খুব কাছের কোনও আত্মীয় হলে তবেই কখনওসখনও তাঁদের বাড়িতে নেমন্তন্নে যান।
রাতে খাবার সময় অরবিন্দ আর রানির সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা বলে নেন।
রাত-খাবারের শেষে: খাবার পরে হাতে সময় থাকলে অল্প একটু টিভি দেখেন। বেশির ভাগই খবরের চ্যানেল। বিদেশি। দেশি হলে সর্ব ভারতীয়।
মাঝেমধ্যে ক্রিকেট থাকলে খোঁজ নেন। অল্প দেখেনও।
তবে এ বাড়িতে তাঁকে গান শুনতে দেখেন না কেউই। রবীন্দ্রসঙ্গীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হয়তো তাঁর পছন্দের তালিকা দীর্ঘ। তবু, এখানে কেউ গানের অ্যালবাম উপহার দিয়ে গেলে সব নিয়ে যান বিদেশে।
এক বার অবশ্য কলকাতা থেকে একজন নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এসেছিলেন। তখন তিনি বসে বেশ কিছু গান শোনেন তাঁর গলায়।
রাতের খাবার শেষে চলে যান দোতলায়। নিজের কাজের টেবলে। কম করে একটা-দেড়টা অবধি। কোনও কোনও সময় তারও বেশি।
পর দিন আবার।
সেই একই রকম।
ওই একই রুটিন। আগের দিনের মতোই।
সকাল থেকে গভীর রাত।
তিনি যে অমর্ত্য সেন!