ছোটবেলায় এত দুষ্টু ছিলেন যে বাড়ির বড়রা ডাকতেন বোম্বেটে।
পোষা লালরঙের মাছগুলি দেখে মনে হয়েছিল ওদের লাল জলেই থাকা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে লাল রং এনে গুলে দিলেন জলে! সব মাছ মরে ভেসে উঠল।
বাটালি দিয়ে লুকিয়ে কাঠের কাজ করতে গিয়ে আঙুল কেটে রক্তারক্তি। সেই কাটা দাগ আজীবন বইতে হয়েছে তাঁকে।
এই মানুষটিই কিনা অবনঠাকুর!!
বাড়ির শিখ দারোয়ানের দাড়ি টেনে পালানো থেকে খাঁচায় পোষা পাখি ছেড়ে দিয়ে পালানো— সব দুষ্টুমির পান্ডা!!
বড় বয়েসে নাটকের দল গড়েছিলেন। নাম ছিল ড্রামাটিক ক্লাব। সেই ক্লাব যখন উঠে গেল, জমানো চাঁদার টাকায় ক্লাবের শ্রাদ্ধ করেছিলেন, নামী হোটেলের এলাহি ভোজ দিয়ে। ভেতরে ভেতরে এতটাই রসিক ছিলেন তিনি।
এমন মানুষের জীবনে একেবারে অন্য ছবিও দেখুন।
কলকাতায় তখন প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছে। সেই মারির হাওয়া কেড়ে নিল তাঁর আদরের ছোট মেয়েটিকে।
সন্তান হারানো শোকে পাগলপ্রায় স্ত্রীর মন ভুলিয়ে রাখবার জন্য তাঁকে অনেক রকম পাখি কিনে দিতেন অবনীন্দ্রনাথ।
বাচ্চা টিয়া, চন্দনা, ময়না...! তাদের অতি যত্নে মুসুর ডাল সিদ্ধ, ছাতু খাইয়ে বড় করতেন। এর পর ওরা যখন খেতে শিখত, ডানা মেলে উড়তে পারত, তখন আকাশে উড়িয়ে দিতেন।
কোনও পাখির অসুখ হলে বইপত্র ঘেঁটে ওষুধ বার করে, খাইয়ে পাখিকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপাত করতেন। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে বসে থাকতেন স্থিরভাবে।
পাখির সঙ্গে তাঁর বোধ হয় কোথায় একটা মনের যোগ ছিল। নইলে নিজে পরে যখন কৃষ্ণলীলার ছবি আঁকছেন, তখন অমন কাণ্ড ঘটাবেন কেন?— বাড়ির বাগানে নানা রকমের পাখি এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যাতে মনের ভেতরে ছবির ‘মুড’ তৈরি হয়।
এই অবনীন্দ্রনাথ আবার লিখছেন, ‘‘রবিকা বলতেন অবন একটা পাগলা। সেকথা সত্যি। রবিকা যে বৈকুণ্ঠের খাতায় তিনকড়ির মুখ দিয়ে আমায় বলিয়েছিলেন, জন্মে অবধি আমার জন্যে কেউ ভাবেনি। আমিও কারো জন্য ভাবতে শিখিনি। এই হচ্ছে আমার সত্যি কারের রূপ। রবিকা আমাকে ঠিক ধরেছিলেন। আমি নিজের মনে নিজে থাকতেই ভালবাসি।’’
কিন্তু সত্যি কি তাই?
উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এগোনো যাক অবনঠাকুরের অন্দরে।
রবিকার বড় আদরের ভাইপো অবনঠাকুর। শিল্পাচার্য। অসামান্য এক মাস্টারমশাই। ওস্তাদ সারেঙ্গি বাদক। চমৎকার অভিনেতা।
শিশির ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীরা নিয়মিত তাঁর কাছে আসতেন অভিনয়ের পরামর্শ নিতে। বিশেষ করে কমিক চরিত্রে এত ভাল অভিনয় করতেন যে রবিঠাকুর স্রেফ তাঁর কথা ভেবেই অনেক নাটকে একটি করে কমিক চরিত্র রাখতেন।
এর সঙ্গে অতুলনীয় সাহিত্য রচনা তো ছিলই। কিন্তু এই সব সত্যি পরিচয়গুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে যদি মানুষটার মনের ভেতর একটু বেশি উঁকি দিই, আজ এত বছর পরেও আমাদের দু’চোখ ভরে যায় ওই মানুষটার মনের আশ্চর্য নরম আলোতে।
‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে রবীন্দ্রনাথের কন্যাসমা রানী চন্দকে কী যেন বলেছিলেন অবনঠাকুর, নিজেকে ছাড়া তিনি কারও জন্য ভাবতে শেখেননি?
এ দিকে তাঁর বড় মেয়ে উমাদেবী ‘বাবার কথা’ বইতে লিখেছেন, তিনি যেমন স্নেহশীল বাবা, তেমনি কর্তব্যপরায়ণ সন্তান, পত্নীগতপ্রাণ স্বামী এবং পরিবার পরিজন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা মস্ত বড় মনের একজন মানুষ।
কেউ যে কোনও বিপদে আপদে — সে বাড়ির দাস-দাসী, আমলা-সরকার, আত্মীয়-পরিজন যেই হোন না কেন, সবার আগে তিনিই গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। আবার অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলন ও রাখিবন্ধন উৎসবেরও অন্যতম সঙ্গী শুধু নয়, উদ্যোক্তাও তিনি।
রবীন্দ্রনাথ একের পর এক জাতীয় ও স্বদেশী সঙ্গীতগুলি লিখে যেতেন আর রং তুলিতে সেই ছবির রূপ দিতেন অবনঠাকুর।
ব্যক্তিজীবনে এই মানুষই যখন সব চেয়ে বড় শোক পেলেন— মেয়েকে হারালেন— কী করলেন?
কারও কাছে শোক প্রকাশ করেননি, পাছে অন্যরা তাঁর জন্য কষ্ট পায়। শুধু চেপে রাখা দুঃখ উজাড় করেছিলেন অনেক দিন পর ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ ছবিটিতে।
নিজেই বলেছেন, ‘‘এই ছবিটি এত ভাল হয়েছে কী সাধে? মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। শাহজাহানের মৃত্যু- প্রতীক্ষাতে যত আমার বুকের ব্যথা, সব উজাড় করে দিলুম।’’
সন্তান-পরিবার-পরিজনের জন্য তাঁর যে কী কোমল মন ছিল, তার প্রকাশ ঘটেছে বারবার। এক বারের কথা যেমন। মেয়ে উমাকে বলেছিলেন, ‘‘জানিস, কোথা থেকে না আমন্ত্রণ পেয়েছি। দিল্লী, লাহোর, জয়পুর, বম্বে, মাদ্রাজ, মহীশূর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন সব জায়গা থেকে আমায় ডেকেছে। কেন যাইনি জানিস? তোর মাকে একলা রেখে যেতে হবে বলে। বড়ো ভীতু ছিল সে।’’
এই মন তো শুধুমাত্র পৃথিবীবিখ্যাত, শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের নয়, এ তো আমাদের খুব চেনা, আটপৌরে, নেহাত ছাপোষা এক বাঙালি হৃদয়ের।
পরিবার ছেড়ে যদি তাঁর ছাত্রদের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখব একই কাণ্ড।
প্রিয় শিষ্য নন্দলাল(বসু) উমার তপস্যা নামে একটি ছবি এঁকে এনে দেখাল। দেখে বললেন, ‘‘এত রং কম কেন? আর কিছু না করো উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দাও।’’
শিষ্য ফিরে গেল। এদিকে গুরুর সারারাত্তির ঘুম হয় না। কেন বললাম আমি নন্দকে? ও হয়তো উমাকে সেইভাবে দেখেনি। দেখতে চায়নি। আর তপস্যায় বিভোর উমা কেনই বা চন্দন ফুলে সাজবে? আমারই ভুল। আমি কেন জোর করে চাপালাম আমার মত।
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর হতেই ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। ছাত্র নন্দলাল তখন সেই ছবিখানি সামনে রেখে উমাকে নতুন করে সাজানোর জন্য রং তুলি হাতে ভাবছে।— ‘‘আহা করো কী করো কী নন্দ থামো থামো। তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না। আর একটু হলেই ভাল ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কী!’’
এই হল মাস্টারমশাই। নিজের ছাত্রের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করতে যেমন এতটকু সংকোচ নেই, তেমনই মায়া ছাত্রদের কাজের প্রতি, তাদের ভাবনার প্রতি। নিজের ছেলের মতো দেখতেন তাদের।
একবার যখন মেয়ে উমা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘বাবা তুমি এত ছবি আঁকো, এগজিবিশনে দাও না কেন?’’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘‘ওরে, আমার ছবি দিলে ছাত্রদের ছবি বিক্রি হবে না যে।’’
আকাশের মতো বড় আর সমুদ্রের মতো গভীর এই মানুষটাই আবার শিশুর মতো সরল। আর সেই সারল্য ছিল তাঁর একেবারে শেষ বয়স অবধি। নইলে জীবনের প্রান্তবেলায় যখন ছবি আঁকা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁর রবিকা কিংবা মেয়ে উমা ছবি আঁকছ না কেন জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেন, ‘‘মনে আর রং ধরে না।’’
সেই তিনিই কি না তখন মাতলেন কাঠকুটো আরও সব ফেলনা জিনিস নিয়ে কুটুম-কাটাম তৈরিতে। একেবারে ছেলেমানুষদেরই খেলা!
কী যে মত্ত ছিলেন সেই খেলায় রানী চন্দের ‘ঘরোয়া’তে তার প্রমাণ মেলে। রানী লিখছেন, “সেবারে যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ছিলুম, আর দু-বেলা গল্প শুনতুম, তখন অবনীন্দ্রনাথ রোজই ভোর ছ’টায় এ বাড়িতে চলে আসতেন। দশটা সাড়ে দশটা অবধি নানা গল্প গুজব হত। একদিন সকালে ওঁর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবলুম বুঝি’বা শরীর খারাপ হয়েছে। ও বাড়িতে গিয়ে দেখি তিনি বাগানের এককোণে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আমাকে দেখে বললেন, ‘না ও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, একেবারে গর্তে পালিয়েছে।’ আমার একটু অবাক লাগল। বললুম, ‘কী খুঁজছেন আপনি?’ তিনি বললেন, ‘একটা ইঁদুর। জ্যান্ত হয়ে আমার হাত থেকে লাফিয়ে কোথায় যে পালালো! ও ঠিক গর্তে ঢুকে বসে আছে। কাল বিকেলে একটা ইঁদুর করলুম, কাঠের, এই এতটুকু। বেড়ে ইঁদুরটি হয়েছিল। কেবল লেজটুকু জুড়ে দেওয়া বাকি। ভাবলুম এটা শেষ করেই আজ উঠব। সন্ধে হয়ে এসেছে ভালো দেখতে পাচ্ছিলুম না।
চৌকিটা বারান্দার রেলিঙের পাশে টেনে নিয়ে ঐ যেটুকু আলো পাচ্ছি তাইতেই কোনওরকমে তারের একটি লেজ যেই না ইঁদুরের সঙ্গে জুড়ে দিতে একটু মোচড় দিয়েছি— টক করে হাত থেকে লেজ-সমেত ইঁদুরটি লাফিয়ে পড়ল। কোথায় গেল, এ দিকে খুঁজি ও দিকে খুঁজি। বাদশাকে বললুম, আলোটা আনতো একটু খুঁজে দেখি কোথায় পালালো। না, সে কোত্থাও নেই। রাত্রে ভালো ঘুম হল না— ভোর হতে না হতেই উঠে পড়লুম। ভাবলুম যদি নীচে বাগানে পড়ে গিয়ে থাকে। কিন্তু আমার ইঁদুরের সন্ধান আর মিলল না। ও জ্যান্ত হয়ে একেবারে মজা দেখছে।’
কিন্তু ওই অতটুকু তারের লেজের কাঠের ইঁদুর ওকে তিনদিন সমানে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরিয়েছে।
উপরে উঠতে নামতে একবার করে খানিকক্ষণ দোতলার বারান্দার ঠিক নীচের বাগানের খানিকটা জায়গা ঘুরে ঘুরে খুঁজতেন। বলতেন, দাঁড়া একবার ঘুরে দেখে যাই। যদি মিলে যায়।’’
রানী গুরুদেবকে সেই গল্প বললে আশি বছরের রবিকা তাঁর সত্তর বছরের ছোট্ট ভাইপোর কাণ্ড শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে বলতেন, ‘‘অবন চিরকালের পাগলা।’’
সত্যিই তো এমন কাণ্ড কোনও শিল্পাচার্যকে মানায়? যাঁর নাম শুনলে দেশবিদেশের নামী শিল্পী, সমালোচক থেকে বড় বড় গুণী মানুষ কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম জানান, যাঁর ছবি কেনার জন্য লর্ড কার্জন পর্যন্ত ছোটদের মতো নাছোড় হন, তাঁর কিনা এমন আচরণ?
কিন্তু এই ছেলেমানুষিটা চিরকাল মনের ভেতরে ছিল বলেই না ক্ষীরের পুতুল, নালক, বুড়ো আংলা কিংবা রাজকাহিনি পেয়েছি আমরা। রিদয়ের সঙ্গে গণেশ ঠাকুরের দেশে যেতে পেরেছি খোঁড়া হাঁসে চেপে।
আসলে নিজের ছেলেবেলাটাকে খুব সাবধানে আজীবন মনের ভেতর লালন করেছিলেন অবনঠাকুর, এতটুকু নষ্ট হতে দেননি।
শুধু তাই নয়, ছোটবেলার স্বপ্নগুলো যেন কারও হারিয়ে না যায়, বরং আরও বেশি বেশি করে স্বপ্ন দেখা যায় সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
কী রকম?
‘দক্ষিণের বারান্দা’য় মোহনলাল-এর একটি অংশ হুবহু তুলে দেওয়া যাক। আন্দাজ পাওয়া যাবে।
মোহনলাল লিখছেন, ‘‘লেখকদের সঙ্গে আর তাঁদের লেখার সঙ্গে পরিচয় আমাদের খুব ছেলেবেলা থেকেই। কত্তাবাবা (রবীন্দ্রনাথ), দাদামশায় (অবনীন্দ্রনাথ), বাবার (মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়) কথা ছেড়েই দিলুম, এ ছাড়া লেখক-সমাগম জোড়াসাঁকো-বাড়িতে কম হত না। আমাদেরও তাই শখ যেত লেখার। খুব ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু পারব কোত্থেকে? একে ছেলেমানুষ, তার উপর বিদ্যা-বুদ্ধির একান্তই অভাব।
দাদামশায়কে দুঃখের কথা জানালুম। গল্প লিখতে গেলে একটা প্লট দরকার। প্লট পাই কোথা থেকে? দাদামশায় বললেন, এর জন্যে ভাবছিস? কেন, স্বপ্ন দেখিস না? স্বপ্নগুলো লিখে ফেল, দেখবি গল্প আপনি এসে যাবে।
এ এক নতুন কথা শোনালেন আমাদের দাদামশায়। আমরা ভাবলুম, সত্যিই তো, স্বপ্নগুলো অনেক সময় গল্পের মতোই আসে। গল্পের চেয়েও ভাল কোনও কোনও সময়। শুধু লিখে ফেললেই হল।
দাদামশায় বললেন, কাল সকালে যে যে স্বপ্ন দেখবে, চলে আসবে আমার বারান্দায়। স্বপ্ন লিখে তারপর শুরু করবে লেখাপড়া।
পরদিন সকালে মাস্টারমশায় এসে দাদামশায়ের ব্যবস্থা দেখে তো থ। দু’তক্তা শ্রীরামপুরী কাগজ লম্বালম্বি চার টুকরোয় কেটে গঁদের আঠা দিয়ে জুড়ে রাখা হয়েছে। এতেই স্বপ্নের পর স্বপ্ন লেখা হবে। আর যেমন যেমন লেখা হবে তেমনি কোষ্ঠীর মতো গুটিয়ে রাখা হবে। জিনিসটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বপ্নের মোড়ক’।
আমরা সেদিন যে যা স্বপ্ন দেখেছি কেউ ভুলিনি। ঘুম-চোখেই চলে এসেছি এবং প্রাণপণে মনে রাখবার চেষ্টা করছি। স্বপ্নের তো প্রধান দোষই যে, ঘুম ভাঙলেই স্বপ্নটা পালিয়ে যায় আর মন থেকেও যায় মুছে। লেখাপড়ার আগেই স্বপ্ন লিখতে হবে, দাদামশায়ের হুকুম। লেখাপড়ার চেয়ে জিনিসটা অনেক ভাল, অনেক মজার। স্বপ্নের এখানটা-ওখানটা ভুলে গেলে বানিয়ে দিলেও চলবে, কেউ ধরতে পারবে না।
সত্তরতম জন্মদিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অবনঠাকুর, পাশে (ছবির ডান ধারে) নন্দলাল।
মাস্টারমশাই বই গুটিয়ে বসে রইলেন। আমাদের একজনের পর একজনের স্বপ্ন লেখা চলতে লাগল। প্রথম উৎসাহে সকলেই কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখেছিলুম নিশ্চয়, কারণ, স্বপ্নের স্রোত সেদিন যেন আর শেষ হতে চায় না।
অপটু লেখক সকলেই, বাংলা বানানই দুরস্ত হয়নি অনেকের। কাটাকুটি আর ঘন ঘন দোয়াতে কলম ডোবানো, পড়াশুনার বদলে এ-ই চলল সেদিন সকালে।
শেষে দাদামশাই বললেন, মাস্টারমশায়কে দিয়ে একটা স্বপ্ন লিখিয়ে নে।
আমরা ছাড়লুম না। স্বপ্নের মোড়কের প্রথম তারিখে মাস্টারমশায়কে দিয়ে লিখিয়ে নিলুম।
পড়ার ঘণ্টা শেষ হয়ে গেল। বই খোলা আর হল না। স্বপ্নে স্বপ্নে ভরে গেল আমাদের শ্রীরামপুরী কাগজ, আমাদের দক্ষিণের বারান্দা আর আমাদের পড়ার ঘণ্টা। এই ভাবে শুরু হয় আমাদের স্বপ্নের মোড়ক।
অনেক দিন চলেছিল সেই স্বপ্নের মোড়ক। দাদামশায়ও লিখেছিলেন তাতে। বড়রা অনেকে লিখেছিলেন। মাঝেমাঝে খুলে পড়া হত স্বপ্ন। দাদামশায়ের একটা স্বপ্ন ছিল ভারী সুন্দর।
দাদামশায় কোথা থেকে যেন একটা নতুন রকমের বীণা পেয়েছেন। সেই বীণাটা নিয়ে ছাদের এক কোণে বসে বাজাবার চেষ্টা করছেন। আকাশে কালো মেঘ। এলোমেলো হাওয়া। নৌকোর পালের মতো ফুলে ফুলে উঠছে মেঘ আর মাঝেমাঝে যাচ্ছে ছিঁড়ে। সেই ছেঁড়া মেঘের মধ্যে দিয়ে সোনার সুতোর মতো থেকে থেকে রোদ এসে পড়ছে দাদামশায়ের কোলে। আর ঠিক তখনই বীণা উঠছে বেজে।
বীণার তার থেকে সুর উঠছে, কী আলোর রশ্মি থেকে ঝংকার উঠছে বোঝা যাচ্ছে না। দাদামশায়ের কোলে বীণা। হাত উঠছে পড়ছে। কখনও বেজে উঠছে বীণা, কখনও নীরব।
মেঘে ঢাকা পড়েছে সূর্যের আলো। আবার বেরিয়ে পড়ছে ফুটো দিয়ে সোনার তরীর মতো। এই স্বপ্ন!
এ রকম স্বপ্ন আমরা কখনও দেখতুম না। এ যেন একেবারে কবিতা। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি দাদামশায়ের মতো স্বপ্ন দেখবার। কিন্তু পারিনি। পারব কোত্থেকে? স্বপ্ন কি আর চেষ্টা করে দেখা যায়!’’
আজীবন শিশুর মতোই স্বপ্ন দেখেছেন অবনঠাকুর, আর শিখিয়েছেন স্বপ্ন কী করে দেখতে হয়। ছোটদের জন্য এত ভাবনা ভাগ্যিস ভেবেছিলেন।
ছবি-লেখিয়ে অবনঠাকুরের কলম ধরার উদ্দেশ্যই ছোটদের মনের ভেতর হুশ করে ঢুকে যাওয়া, আর তাদের মনটি জয় করে নেওয়া। তাই আপন কথায় লিখছেন, “আমার ভাব ছোটোদের সঙ্গে-তাদেরই দিলেম এই লেখা। আর যারা কিনে নিতে চায় পয়সা দিয়ে আমার জীবন-ভরা সুখ দুঃখের কাহিনী, এবং সেটা ছাপিয়ে নিজেরাও কিছু সংস্থান করে নিতে চায় তাদের আমি দূর থেকে নমস্কার দিচ্ছি। যারা কেবল শুনতে চায় আপন কথা, থেকে থেকে যারা এসে বলে, গল্প বলো, সেই শিশু-জগতের সত্যিকার রাজা-রানী বাদশা-বেগম তাদেরই জন্যে আমার এই লেখা পাতা ক’খানা। শিশু-সাহিত্য সম্রাট যাঁরা এসেছেন এবং আসছেন তাঁদের জন্যে রইলো বাঁহাতে সেলাম, আর ডান হাতের কুর্ণিশ রইলো তাদের জন্যে যারা বসে শোনে গল্প রাজা বাদশার মতো, কিন্তু ছেঁড়া মাদুর নয়তো মাটিতে বসে, আর গল্পের মাঝে মাঝে থেকে থেকে যারা বকশিশ দিয়ে চলে একটু হাসি কিংবা একটু কান্না, মান-পত্রও নয়, সোনার পদকও নয়, হয় একটু দীর্ঘশ্বাস, নয় একটুখানি ঘুমে ঢোলা চোখের চাহনি। ঐ তারা-যারা আমার মনের সিংহাসন আলো করে সে বসে তাদেরই আদাব দিয়ে বলি, গরিব পরবৎ সেলামৎ-অব আগাজ কিসসেকা করতা হুঁ, জেরা কান দিয়ে কর শুনো।
উমাদেবী
বলে যাওয়া চলে তাদেরই কাছে নির্ভয়ে, মনের কথা বেচা কেনার ধার ধারে না যারা, যাত্রা করে বেরিয়েছে যারা, কেউ কাঠের ঘোড়ায় চড়ে, নানাভাবে নানা দিকে আলিবাবার গুহার সন্ধানে। ছোটো ছোটো হাতে ঠেলা দিয়ে যারা কপাট আগলে বসে আছে, যে দৈত্য সেটাকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, ওপুন চিসম-অর্থাৎ চশমা খোলো, গল্প বলো।’’
কত গল্প যে ছিল মানুষটার মধ্যে!
আবার যেমন ছিল তাঁর অগাধ পড়াশোনা তেমনই ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি শিল্পকলা সম্পর্কিত যে বক্তৃতাগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছিলেন তা তাঁর শান্ত গম্ভীর কন্ঠে ধীরে ধীরে বলার ভঙ্গিতে শ্রোতাদের এতটাই আপ্লুত করে রেখেছিল যে প্রত্যক্ষদর্শী উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘‘বক্তৃতা তো নয়। সে-ও এক ছবি দেখা। … চমক ভাঙে বক্তৃতা শেষে। মনে হয় স্বপ্নলোক থেকে আবার ফিরে আসি মর্তলোকে।’’
এই বক্তৃতাগুলিই ‘বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলী’ নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। শিল্প সম্পর্কে এমন গভীরতর দর্শন এত সহজ কথায় কজনই বা বলতে পেরেছেন?
ভাগ্যিস রবিকা তার ভাইপোকে লিখতে উৎসাহ আর সাহস দুই-ই জুগিয়েছিলেন। নইলে তাঁর লেখাই হত না হয়তো। ভাইপোকে বললেন, ‘‘অবন তুমি লেখো, তোমার যা মনে আসে তাই লেখো, আমি দেখে শুধরে দেব।’’
ব্যস, সেই উৎসাহেই লেখা শুরু। তবে শুধরাতে আর হয়নি। এমন মিষ্টি করে লেখা কথা যেন পাশে বসে গল্প করছেন, সেই লেখা আবার শোধরানো কী?
রানী চন্দকেও তাই বলেছিলেন কবি। অবন যেমনটি লিখেছে তেমনই থাক। নইলে ওই লেখার আসল স্বাদটাই নষ্ট হবে, তিনি জানতেন।
আর শেষমেশ তিনি আশ্চর্য এক রূপকথাময় মানুষ! জীবনে অনেক অনেক আঘাত পেয়েছেন, অনেক কষ্ট সয়েছেন কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তাই নিয়ে কারও কাছে অভিযোগ বা দুঃখ জানাতে বসেননি। আশ্চর্য দর্শনে নিজেই বলতেন, ‘‘শিল্পীর জীবন বড় দুঃখের।’’
বলেছেন, ‘‘এই হল শিল্পীর জীবনের ধারার একটু ইতিহাস। বসন্তে যখন জোয়ার আসে ফুল ফুটিয়ে ভরিয়ে দেয় দিক বিদিক। আবার ভাঁটার সময় তা ঝরিয়ে দিয়ে যায়। আমারও যাবার সময়ে যা দু’ধারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলুম। তোমরা তা দেখতে পাবে, জানতে পাবে, কত ঘাটে ঠেকেছি, কত পথে চলেছি, কী সংগ্রহ করেছি ও সংগ্রহের শেষে কী বকশিশ পেয়ে গেছি। এতকাল চলার পরে বকশিশ পেলুম আমি তিন রঙের তিন ফোঁটা মধু।’’
অবনঠাকুর ওই তিনফোঁটা মধু-র বকশিশটকুও যে আমাদের দিয়ে গেছেন!
কাহিনির নেপথ্যে কাহিনি
বীন্দ্রনাথের উৎসাহে প্রথম লেখা শুরু। শকুন্তলা লিখে তাঁর ‘রবিকা’র প্রশংসা পেয়ে পরপর লিখে ফেলেছিলেন ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা...।
তাঁর প্রায় প্রতিটি কাহিনির জন্মকথায় জড়িয়ে অদ্ভুত সব গল্প।
বুড়ো আংলা যেমন। কেমন করে লিখলেন সেটা? এর পিছনের গল্পটা ভারী মজার।
সেলমা লাগেরলফ নামে নামকরা এক লেখিকা ছিলেন সুইডেনে। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারস অব নিলস’ বইটি।
গল্পের নায়ক ছোট্ট নিলস। হাঁসের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ায়। বইটি পাঠকদের হৃদয় কেড়ে নিল। জনপ্রিয় হয়ে উঠল নিলস নামের ছোট্ট বালকটি। সুইডেনে বড় দিনের উৎসবের সময় নিলস ও তার হাঁসও খড়ের পুতুল হয়ে বিক্রি হতে লাগল দোকানে দোকানে। আঁদ্রে কার্পেলে নামে অবনীন্দ্রনাথের এক ফরাসি বান্ধবী ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথকে তিনিও পাঠিয়ে দিলেন নিলস ও হাঁসের খড়ের পুতুল। সেই পুতুল দেখেই সুন্দর একটা প্রচ্ছদ আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ। লিখে ফেললেন ‘বুড়ো আংলা’। প্রথম প্রকাশিত হল মৌচাক পত্রিকায়, আর বই আকারে ১৯৪১ সালে। এর পর আসি ‘ভূতপতরির দেশে’র কথায়। সপরিবার পুরী বেড়াতে গিয়ে অবনঠাকুরের শখ হল কোণারক দেখতে যাওয়ার। চন্দ্রভাগায় সূর্যোদয় দেখবেন।
ভাবমাত্র কাজ। রাত আটটায় গোটা পরিবার সমেত রওনা দিলেন। সারা রাত হুম হাম শব্দ করে চলল পালকি। পরদিন ভোর বেলা পৌঁছাল চন্দ্রভাগায়। গোটা রাত ধরে নির্জন সেই গা ছমছমে ভূতুড়ে যাত্রাপথের অনুভূতিই তাঁর কলমে এনেছিল ‘ভূতপতরির দেশে’।
রাজকাহিনির ‘শিলাদিত্য’ লিখেছিলেন সেই কোণারক মন্দির দর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে।
‘ক্ষীরের পুতুল’ লেখার কাহিনিটি আরও অদ্ভুত। রবিঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা খাতা যেটুকু রথীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়া গিয়েছিল, সেই খাতার রূপকথার গল্পের থেকেই নাকি ‘ক্ষীরের পুতুল’ লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন অবনঠাকুর।
ঋণ: অবনীন্দ্র রচনাবলী, জোড়াসাঁকোর ধারে,
দক্ষিণের বারান্দা, ঘরোয়া, বাবার কথা