রাজভক্ত হয়েও দেশপ্রেমিক

সময়টা বৈশাখ মাস। কিন্তু সেই প্রবল গরমে কলকাতার স্পেনশাস হোটেলের একটি ঘরে ঠকঠক করে কাঁপছেন ইংরেজ জজসাহেব। কাঁপছেন ভয়ে। তাঁর কাছে খবর এসেছে পাওনাদারেরা তাঁকে জেলে দেবার বন্দোবস্ত করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

শুরুতেই চমক

Advertisement

সময়টা বৈশাখ মাস। কিন্তু সেই প্রবল গরমে কলকাতার স্পেনশাস হোটেলের একটি ঘরে ঠকঠক করে কাঁপছেন ইংরেজ জজসাহেব। কাঁপছেন ভয়ে। তাঁর কাছে খবর এসেছে পাওনাদারেরা তাঁকে জেলে দেবার বন্দোবস্ত করেছে। ঘটনা হল জজসাহেব অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন ছুটি নিয়ে দেশে (অর্থাৎ বিলাতে) ফিরে যাবার আয়োজন করছেন। কিন্তু তিনি যে ফিরে আসবেন এই কথায় ভরসা রাখতে না পেরে পাওনাদারেরা তাঁর বিলেত যাওয়া বন্ধ করে তাঁকে ১ নং চৌরঙ্গিতে বন্দি করে রাখতে বাধ্য করবে—সেই চেষ্টা চলছে। পাওনাদারদের কাছে তাঁর ধারের পরিমাণ ১ লক্ষ টাকা। এই বিপজ্জনক অবস্থায় একজনের কথা সাহেবের মনে পড়ল। যদিও তাঁকে জজসাহেব চেনেন না—তবু নাম শুনেছেন, বিপদে পড়ে তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। জজসাহেব তাঁর শরণাপন্ন হয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁকে চিঠি লিখলেন। আর অপ্রত্যাশিত ভাবে ক’দিনের মধ্যেই উত্তর এসে গেল। জজসাহেবের উত্তমর্ণদের ১ লাখ টাকা পরিশোধ করে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির দলিলপত্র ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনি। সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে জজসাহেবের সঙ্গে দেখা করে দলিলপত্রগুলি তাঁর হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন জজসাহেব এখন নিশ্চিন্তে বিলাতে যাত্রা করতে পারেন।

Advertisement

সাহিত্য চর্চা ও ভাষা শেখা

কৃতজ্ঞতায় জজসাহের কেঁদে ফেললেন। জজসাহেব কিন্তু আবার ভারতবর্ষে ফিরে এসেছিলেন এবং তাঁর ঋণ শোধ করেছিলেন। ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন উপযুক্ত সময় আসে, তখন আবির্ভাব হয় ঐতিহাসিক ব্যক্তির। মনুষ্য-জাতির কল্যাণের জন্য ভগবৎ প্রেরিত দূত হিসেবে এঁরা আসেন। সেই ভগবৎ প্রেরিত দূত ছিলেন দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথকে সাধারণ মানুষ চেনেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ হিসাবে অথবা ধনী অভিজাত এবং বিলাসী ‘প্রিপ্স’ হিসেবে। কিন্তু তাঁর জীবন খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে তিনি কত বড় প্রেমিক, কতটা দরিদ্রের বন্ধু।

দ্বারকানাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৪ সালে। পিতা রামময় ঠাকুর। শুধু ভাষা শেখা নয়, শুধু সাহিত্য চর্চাও নয় যাকে বলে আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠা শিক্ষক শেরবোর্ন সে ভাবেই তাঁকে রপ্ত করে তুললেন। শেরবোর্নের প্রতি দ্বারকানাথ এত শ্রদ্ধাসম্পন্ন ছিলেন, সে যতকাল তিনি বেঁচে ছিলেন, শিক্ষক শেরবোর্নকে পেনশন দিয়ে গিয়েছিলেন। অত্যাশ্চর্য একটি বৈপরীত্য দ্বারকানাথের মধ্যে। একদিকে ঐশ্বর্য এবং তীব্র মর্যাদা বোধ। মানুষের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য চূড়ান্ত বিলাসিতা, চূড়ান্ত অর্থব্যয়, অন্য দিকে তাঁর চিত্তলোক প্রসারিত—সেখানে মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা ও অতুলনীয় সহানুভূতি।

ভল্টেয়ার-এর একটা উক্তি—মানুষ তার প্রতিভার দ্বারা জীবনে যতটা উন্নতি করতে পারে, তার চেয়ে বেশি পারে চরিত্রের দৃঢ়তার দ্বারা- দ্বারকানাথ যেন এই উক্তির মূর্ত বিগ্রহ। পিতৃব্য রামলোচনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে যে সব সম্পত্তি তাঁর হাতে আসে তার মধ্যে একটি হল পাবনা জেলার অন্তর্গত বিরাহিমপুরের জমিদারি। জমিদারি পরিচালনায় তিনি তুখোড় হয়ে ওঠেন। ব্যবসা শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি জমিদারি কিনে ফেললেন রাজসাহিতে কালীগ্রাম, পাবনায় শাহজাদপুর, রংপুর-এর স্বরূপপুর। যশোরে মহম্মদশাহী, কটকে শেরগড় এবং আরও কয়েকটি।

রামমোহনের আদর্শে

একটা প্রবাদ আছে ‘দুঃসাহস না করলে লাভ করা যায় না’ এটাই হয়ে উঠল দ্বারকানাথের মোটিভ। বলতে গেলে ‘বাণিজ্যেতে যাবই’ বাণিজ্যে লক্ষ্মীর অকৃপণ দাক্ষিণ্য তাঁর উপর ঝরে পড়েছিল। কিন্তু উপার্জন করেও তিনি কখনও ইন্দ্রিয় সম্ভোগে মত্ত হননি। বিলাসিতা দেখিয়েছেন, কিন্তু তারও একটা উদ্দ্যেশ্য ছিল ‘আমাকে সবার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। আবার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন করুণা ও সহানুভূতি। ১৮৩৫ খ্রিঃ ১ জুন মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই দ্বারকানাথের সাহায্যের হাত এর প্রতি প্রসারিত ছিল। তখনকার দিনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে ‘মর্গে’ বা শবব্যবচ্ছেদাগারে যাওয়ার ব্যাপারে এত আপত্তি ছিল যে সন্তানকে ডাক্তারি পড়তে দিতে তাঁরা সংকুচিত হতেন। সেই সময়ে মানুষের মনে এই সব কুসংস্কার দূর করবার জন্য দ্বারকানাথ প্রায় প্রতিদিন শবব্যবচ্ছেদাগারে উপস্থিত থাকতেন।

ঠাকুরদাদা নীলমণির মতো দ্বারকানাথ প্রথম জীবনে ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। পূজা হোম এ সব করতে ভালবাসতেন। কিন্তু রামমোহন রায়ের সংস্পর্শে এসে তাঁর মানবিকতার পরিবর্তন হল। ধ্যান ও উপাসনার মধ্য দিয়ে পূজা করতে লাগলেন তিনি। রামমোহন রায়ের প্রতি দ্বারকানাথের গভীর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ছিল। রামমোহনের প্রতিটি সমাজসংস্কারমূলক কাজে সক্রিয় ভাবে যোগ গিয়েছেন তিনি। তখনকার দিনে সমাজের প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সতীদাহ প্রথা নিবারণে রামমোহনের পাশে দাঁড়ালেন তিনি। রামমোহন ও দ্বারকানাথের যুগ্ম আবেদন এতই মর্মস্পর্শী হয়েছিল যে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কেঁদে ফেলেছিলেন। তখন সতীদাহ প্রথা দূর করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হল। প্রত্যেক সভ্য মানুষের মনে আজও এই স্মৃতি অম্লান।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দ্বারকানাথের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথাও মনে রাখতে হবে। বেঙ্গল হরকরা, জন বুল, ক্যালকাটা ক্যুরিয়র ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ভাবে নানা পত্রিকা তখনকার দিনে প্রকাশিত হতে লাগল। এই সব পত্রিকার প্রসারের জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা, কারণ দ্বারকানাথ এটা বিশ্বাস করতেন যে দেশের উন্নতির জন্য সংবাদপত্রের বিকাশ প্রয়োজন এবং সংবাদপত্রের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতাও প্রয়োজন। সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা যখন বাস্তবে রূপায়িত হল, তখন দ্বারকানাথ বললেন, ‘মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার পথে যে সমস্ত বাধা নিষেধ ছিল, সেগুলো দূর করার জন্য সব সময়ই আমি আগ্রহান্বিত—তাই মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমি অংশ নিয়েছি।’

দ্বারকানাথকে বলা হয় রাজভক্ত। সেটা সত্যি। কিন্তু তার পিছনে তখনকার দিনের সমাজ। দেশের মুক্তির জন্য প্রগতির জন্য এই সময়ে ইংরেজদের শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আবার যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হল, তখন তিনি ইংরেজদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন অকুণ্ঠ ও দৃঢ়ভাবে।

তাই বলে দ্বারকানাথের চরিত্র ত্রুটিমুক্ত নয়। নীল চাষ সমর্থন (দ্বারকানাথ নিজেই কিছুকাল নীল চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন), চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমর্থন—এগুলি যেমন তাঁর চরিত্রের ত্রুটি, তেমনই ব্যক্তি জীবনের উচ্চাশা, আড়ম্বর প্রিয়তা, অত্যন্ত বিলাসপ্রিয় জীবন, ‘সোসাইটি’র একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে ওঠার বাসনা এগুলোও তাঁর চরিত্রে অন্যতম ত্রুটি। তা সত্ত্বেও সমাজ বা ব্যক্তি মানুষের উন্নতি কামনায় যাঁরা ব্রতী ছিলেন, সেই সমস্ত মহৎ ব্যক্তিদের তালিকায় দ্বারকানাথকে একটি বিশিষ্ট স্থান দিতেই হবে। এ কথা বোঝা দরকার যে, যে সমস্ত প্রগতির চিহ্ন আজ আমাদের চারপাশে ছড়ানো দ্বারকানাথও ছিলেন তার পথিকৃৎ।

মনের পরিবর্তন

দুটো ঘটনায় তাঁর মনে পরিবর্তন এনে দিল। প্রথমটি দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে। দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথকে প্রথম থেকেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে ব্রতী হলেন। এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে একটি ছোট পদে নিযুক্ত করলেন। দেবেন্দ্রনাথের পারদর্শিতা সম্বন্ধে যখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন তখন তাকে একদিকে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর নিযুক্ত করলেন অপর দিকে কোম্পানির অন্যতম অংশীদার নিযুক্ত করলেন। কিন্তু হঠাৎ তখনই দেবেন্দ্রনাথের মনে চরম পরিবর্তন ঘটে গেল। শিল্প নয়, সংসার নয়, তাঁর মন গেল ঈশ্বরের চরণে। হতাশ দ্বারকানাথ খেদোক্তি করলেন ‘এখন সে ব্রহ্ম ব্রহ্ম করিয়া বিষয়কর্মে কিছুই মন দেয় না’ (আত্মজীবনী দেবেন্দ্রনাথ)।

দ্বারকনাথের জীবনে আর একটি মনস্তাপ স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর মানসিকতার আকাশ পাতাল ব্যবধান। মুখশ্রী অতিসুন্দর। কথিত আছে, জগদ্ধাত্রীর মূর্তি নির্মাণের সময় তাঁর মুখটি দিগম্বরী দেবীর আদলে গড়া হত। পতিভক্তি, পতিসেবা এই-ই তাঁর জীবনের আদর্শ। কিন্তু তিনি রক্ষণশীল। দ্বারকানাথ যে ভাবে সমাজের উচ্চশ্রেণির সুপ্রতিষ্ঠিত হবার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, স্ত্রী কাছে তা ‘ম্লেছ’দের সঙ্গে মেলামেশা বলে মনে হতে লাগল। স্ত্রী হয়ে এটা তিনি কী করে মেনে নেন? আবার বিদেশিদের জন্য দ্বারকানাথ যে বিজাতীয় পানীয় ও নিষিদ্ধ মাংস গ্রহণ করছেন, নিষ্ঠাবতী হিন্দু নারী হয়ে দিগম্বরী সেটাই বা মেনে নেন কী করে? সুতরাং সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ততায় পৌঁছল। জীবনাদর্শে দুজনে দু’প্রান্তে। প্রবৃত্তির সঙ্গে কর্তব্যের এই সংঘর্ষ লাগল দিগম্বরীর মনে। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা অথচ পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব। এ যেন—

‘এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালবাসে,

তবুও কাছে নাহি পায়।

দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,

বুঝাতে নারে আপনায়’।

এর পরেই ১৮৩৯ খ্রিঃ দিগম্বরী সংসার থেকে চিরজন্মের জন্য বিদায় নিলেন। মৃত্যুশোকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিলেন দ্বারকানাথ। যখন তিনি ফ্রান্স দর্শনে গিয়েছিলেন তখন তিনি সম্রাট লুই ফিলিপের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। একটি মজার ঘটনা—মহামান্য সম্রাট তাঁকে যে অভ্যর্থনা করেছেন এবং সম্মান দিয়েছেন, তাতে বিস্মিত বহু লোক পল্লি অঞ্চল থেকে তাঁকে দেখতে উৎসুক হল। রাজা যে অভিজাত ব্যক্তিটিকে এক সম্মান দেখাচ্ছে, তিনি কে? ফ্রান্সের বৈদেশিক দফতরের সেক্রেটারি মঁসিয়ে ফুরে বলে উঠলেন, ‘এই বিশিষ্ট আগন্তুকটি হলেন স্বার্গরাজ্যের রাজা’। এ কথা শুনে জনতা চিৎকার করে উঠল ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

দেশ ছেড়ে লন্ডনে

১৮৪৫ সালে ২৪ জুন দ্বারকনাথ লন্ডনে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র। দ্বারকানাথ রানির জন্য মূল্যবান উপহার দ্রব্য নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে থেকে রানি বেছে নিলেন কতকগুলি বিচিত্র ধরনের চিনা অলংকার এবং দিল্লিতে তৈরি কতকগুলি সোনার তাগা আর সোনার বালা। প্রিন্স অ্যালবার্ট গ্রহণ করলেন একটি সুন্দর শালের চোগা। বাকিংহাম প্যালেসে অভ্যর্থনা হল দ্বারকানাথের। তাঁকে উপহার দেওয়া হল অটোগ্রাফ করা মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি।

পরবর্ত়ীতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, ‘দ্বারকানাথের সর্বশুদ্ধ ১৭ জন অনুচর ছিল। তার মধ্যে দুই জন দেশীয় ভৃত্য। তাছাড়া একজন সেক্রেটারি, একজন ইন্টারপ্রিটার, সঙ্গীত উস্তাদ জার্মান একজন, চিকিৎসক ডা. মার্টিন এবং অপর একজন মিলে এই পঞ্চ সহচর সর্বদা কাছ থেকে তাঁর আবশ্যকমতো কাজকর্মে নিযুক্ত ছিল। আমার পিতামহের শরীর ভেঙে পড়ল। রোগের জ্বালায় বড় অশান্তি, ছটফটানি হয়েছিল। ৬টার সময়ে উঠে গাড়ি করে বেরিয়ে ফিরে এসে অল্প নিদ্রা যেতেন—তারপর আহার, তাঁর ভৃত্য হুলির তৈয়ারি কারি-ভাত আর একটু কমলালেবুর জেলি, এই মাত্র আহার। .....তাঁর শরীর ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ল, তিনি আপনার আসন্ন মৃত্যু আপনি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। কেমন আছেন কেহ জিজ্ঞাসা করলে গভীর স্বরে বলতেন ‘আমি শান্তিতে আছি।’ (আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস)। অবশেষে ১৮৪৬ এর ১ অগস্ট শনিবার বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর জীবন দীপ নির্বাপিত হল।

একজন হিন্দুর সৎকার কী ভাবে হবে তা নিয়ে সকলের ভিতরেই উদ্বেগের অন্ত নেই। একদিকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সকলকেই দাহ করা হয়েছে, আবার তাঁর বিশিষ্ট শ্রদ্ধার পাত্র রামমোহন রায়কে এখানেই সমাধি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পুত্র এবং ভাগ্নে দুজনেই অল্পবয়স্ক। তাঁরা বললেন যেটি যুক্তিযুক্ত সেটাই করা হোক। শবযাত্রায় পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নেয় নবীনচন্দ্র ছাড়াও যাঁরা অংশ নিলেন স্যার এডওয়ার্ড রিয়ান, মেজর হেন্ডারসন, মিস্টার প্লাউডেন ও আরও অনেকে। এ ছাড়া যে সমস্ত ছাত্র দ্বারকানাথের অর্থানুকূল্যে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করছিলেন তাঁরাও ছিলেন এই শবযাত্রায়। শবাধারের ঢাকনির উপর ছিল দুখানা রুপোর পাত। একখানিতে বাংলায় লেখা দ্বারকানাথের নাম পরিচয়। দ্বিতীয়টি একই বিষয় ইংরাজিতে লেখা।

মৃত্যুর পরে

কলকাতায় দ্বারকানাথের মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছল দেড়মাস পরে। দেবেন্দ্রনাথ পারলৌকিক ক্রিয়া করলেন ব্রাহ্মধর্ম মতে, আর তাঁর ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন হিন্দুতে। ইংল্যান্ডের একটি নির্জন পরিবেশে তিনি আজ নিদ্রিত, সে নিদ্রা কোনও দিন ভাঙবে না। ‘হয়তো তাঁর সমাধির উপরে বিশাল কোনও স্তম্ভ রচিত হয়নি, কিন্তু অদৃশ্য হাতে পিরামিডের থেকেও স্থানীয় এবং গভীর একটি স্তম্ভ সেখানে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। সে স্তম্ভটি হল ভারতের চিরকৃতজ্ঞ হৃদয়।’

ঋণ: hemoir of dwarkanath kishori chand mitra, In your blossming flower garden, ketaki kushari dyson

ঠাকুরবাড়ির কথা—হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement