ইলাহাবাদের জানকীবাই ছপ্পনছুরি।
ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজশাসিত রেওয়া স্টেটে তখন সাজো সাজো রব। এক উৎসব উপলক্ষে আলোকমালায় সেজেছে রাজপ্রাসাদ। রাজকীয় ঐশ্বর্যে, ঠাঁটবাটে সব কিছুতেই নজরকাড়া আভিজাত্যের প্রকাশ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নিমন্ত্রিত হয়েছেন রাজা, মহারাজা, গণ্যমান্য অতিথিরা। তাঁদের জন্য যেমন রয়েছে এলাহি ভোজের আয়োজন, তেমনই মনোরঞ্জনের জন্য আছে ধ্রুপদী রাগ সঙ্গীতের আসর। সেই আসরের মূল আকর্ষণ ইলাহাবাদের জানকীবাই ছপ্পনছুরি।
রেওয়ার মহারাজা বেঙ্কটরমন রামানুজ প্রসাদ সিংহ জিউ দেও বাহাদুরের নিমন্ত্রণে ইলাহাবাদ থেকে রেওয়ায় এসে পৌঁছলেন জানকী। রাজার বিশেষ অতিথিশালায় তাঁর থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এমন রুচিশীল, সুসজ্জিত অতিথিশালা জানকী আগে কখনও দেখেননি। তাঁর দেখাশোনার জন্য একজন পরিচারিকাও ছিলেন সেখানে। পরের দিন মেহফিল, তা নিয়েই ভাবছিলেন জানকী। হঠাৎই তাঁর ঘরের দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেন। দরজা খুলতেই সামনে দেখলেন এক অভিজাত সুপুরুষকে। করজোড়ে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি রেওয়া রাজ্যের রাজকুমার কুন্দন সিংহ বাঘেল। জানকীকে দেখেই তিনি কেমন যেন চমকে উঠলেন। যদিও সম্ভ্রম বজায় রেখে সৌজন্য বিনিময়টুকু সেরেই দ্রুত চলে গেলেন। তাঁর চোখে মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তি ও হতাশা জানকী যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন। রাজকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঘরের বাইরে ফিসফিস করে কারা যেন জটলা করছিল। এক অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধল জানকীর মনে।
আধঘণ্টার মধ্যেই আবারও তাঁর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেন জানকী। এ বার এক বয়স্ক ভদ্রলোক, পরনে ধুতি ও কোট। তিনি রেওয়া স্টেটের মুনশি মনোহর প্রসাদ। তিনি জানকীকে বললেন, মেহফিলের সব দায়িত্ব তাঁর। কিন্তু একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, যার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু কথাটা কী ভাবে বলবেন, কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। জানকী অভয় দিয়ে তাঁকে বললেন, যা বলার আছে নির্ভয়ে বলতে। এর পরে মুনশি মনোহর প্রসাদ বললেন, মহারাজা সঙ্গীতের এক সমঝদার শ্রোতা, কিন্তু সৌন্দর্য বিষয়ে বড়ই সচেতন। আর গানের মেহফিলে আপনি যদি... কথা শেষ করার আগেই জানকী বললেন, ‘‘সমস্যা আমার চেহারা নিয়ে, তাই তো?’’ কাঁপাকাঁপা গলায় মনোহর প্রসাদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই জানকী স্মিত হেসে বলে উঠলেন, ‘‘কোনও মন্ত্রবলে আমার মুখ আর চেহারাটা তো বদলাতে পারব না।’’ মনোহর প্রসাদ অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে এ বার মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার পরে তিনি বিনীত ভাবে জানকীকে অনুরোধ করে বললেন সমস্যার সমাধানে কিছু একটা করতে। আসলে মনোহর প্রসাদ ভয় পেয়েছিলেন, জানকীকে দেখে মহারাজা হয়তো বিরক্ত হবেন কিংবা নিমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে রাজপরিবারের সম্মানহানি ঘটতে পারে।
কিছুক্ষণ ভেবে জানকী বললেন একটি উপায়ের কথা। তিনি আসরে গাইবেন, তবে প্রকাশ্যে নয়, পর্দার আড়ালে। মনোহর প্রসাদকে তিনি বললেন মহারাজাকে বলতে যে, তিনি পর্দানসিন। তাই প্রকাশ্যে কারও সামনে গান করেন না। যদি মহারাজ তাতে রাজি থাকেন, তবেই তিনি আসরে গাইবেন। কিছুক্ষণ পরে মনোহর প্রসাদ এসে জানালেন, রাজা তাতে রাজি হয়েছেন।
পরের দিন সন্ধ্যায় জ্বলে উঠল কয়েকশো বেলজিয়াম কাচের ঝাড়বাতি, ফানুস আর দেওয়ালগিরি। আসরে মসলিনের পর্দা ঢাকা একটি জায়গায় বসে গান শুরু করলেন জানকী। তাঁর পাশেই ছিলেন তবলা, সারেঙ্গি ও হারমোনিয়াম বাদক। প্রথমেই শ্রীরাগে একটি খেয়াল ধরলেন জানকী। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রোতাদের মনে হল, তাঁরা যেন এক অপার্থিব সুরলোকে বিরাজ করছেন। সে দিন তাঁর গান শুনতে শুনতে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। এর পরে শুদ্ধ কল্যাণ, একটি ঝিনঝোতি ঠুমরি গাওয়ার পরে জানকী দেখেন শ্রোতারা বেশ উপভোগ করছেন। এ বার তিনি কাফিতে একটি বন্দিশ, দরবারি কানাড়া, মালকোষ গেয়ে ভোররাতে ভৈরবী দিয়ে মেহফিল শেষ করেছিলেন। আসরশেষে নাকি রাজার চোখেও জল দেখা গিয়েছিল। জানকীর গায়কিতে মুগ্ধ রাজা করজোড়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন প্রকাশ্যে আসতে। তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে যথাসাধ্য সম্মানে, উপহারে জানকীকে সমাদৃত করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, পরের দিন জানকীর ফিরে আসার কথা থাকলেও মহারানির নিমন্ত্রণে তাঁকে আরও কয়েকটা দিন থেকে আসতে হয়েছিল।
গান রেকর্ড করছেন জানকীবাই
বাইজি মানেই এক অপূর্ব সুন্দরী, কিন্নরীকণ্ঠী, যাঁর রূপ এবং শারীরিক আকর্ষণ শ্রোতাদের মোহিত করে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই ধারণাকে যে ক’জন ভেঙেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জানকী। রূপ তাঁর ছিল না। জানকী শ্রোতাদের বশ করতেন কণ্ঠের জাদুতে। এমন দরাজ অথচ সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী খুব কম বাইজিই ছিলেন সে কালে। তখন বেশির ভাগ বাইজি কিছুটা নাকিসুরে গান গাইলেও জানকী ছিলেন তার বিপরীত। তাঁর গায়কিতে একাধারে ছিল বলিষ্ঠতা এবং সুরের মাদকতা। খাদে হোক বা চড়ায়— আকাশের মুক্ত বিহঙ্গের মতো তাঁর কণ্ঠস্বর খেলে বেড়াত। সে কারণেই তাঁর গায়কির সঙ্গে আগ্রার মুস্তুরি বাইয়ের গায়কির তুলনা করেছেন অনেকেই।
১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে ইলাহাবাদে এক মেহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। এই মেহফিলের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য তাঁর সামনে তুলে ধরা। সেই উপলক্ষে জানকীবাই এবং গওহরজান নিমন্ত্রিত হয়ে একটি দ্বৈতসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। গানটি ছিল ‘ইয়ে জলসা তাজপোসি কা মুবারক হো’। উপহার হিসেবে গওহর এবং জানকী দু’জনকেই একশোটি করে সোনার গিনি উপহার দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা লিখেছিলেন, সে দিন গওহরের চেয়ে জানকী ভাল গেয়েছিলেন। এর পর থেকেই জানকীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ জুড়ে। বেতিয়ার মহারাজার অন্যতম প্রিয় শিল্পী ছিলেন জানকী। তিনি জানকীকে ‘বুলবুল’ বলে ডাকতেন।
জানকী থেকে ‘ছপ্পনছুরি’ হয়ে ওঠার নেপথ্যে একাধিক কাহিনি শোনা যায়। একবার বারাণসীর মহারানি এক মেহফিলের আয়োজন করেছিলেন। তাতে জানকী সে কালের প্রখ্যাত এক শিল্পীকে গানের প্রতিযোগিতায় হারিয়েছিলেন। রাগে, হিংসায় উন্মত্ত সেই শিল্পী জানকীকে ছুরি দিয়ে নাকি কুপিয়েছিলেন। অন্য এক কাহিনি অনুসারে, মানকীর কোঠায় রঘুনন্দন দুবে নামে এক সেপাই আসতেন। তখন জানকী সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন। জানকীর প্রেমে পাগল হয়ে রঘুনন্দন তাঁকে পাওয়ার জন্য নানা উপহার দিয়ে মন ভোলাতে চেয়েছিলেন। তবে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জানকী তাতে প্রভাবিত না হয়ে রঘুনন্দনকে প্রত্যাখ্যান করেন। রাগে, অপমানে রঘুনন্দন ছুরি দিয়ে তাঁকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। তবে আরও একটি কাহিনি বহুল প্রচলিত।
জানকীর জন্ম ১৮৭৫ সালে মতান্তরে ১৮৮০ সালে, বারাণসীর বর্না কা পুল মহল্লায়। ছোট থেকেই গানের প্রতি জানকীর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। যে কোনও গান এক বার শুনলেই হুবহু তা গাইতে পারতেন। শোনা যায়, কোনও এক উৎসবে বারাণসীর মহারানি জানকীর গান শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর বাবা শিববালকরাম এবং মা মানকীর আরও তিন সন্তান ছিল। দুই মেয়ে মহাদেবী ও অবকাশী এবং পুত্র বেণীপ্রসাদ। শিববালকরামের দুধের ব্যবসা এবং একটি মিষ্টির দোকান ছিল। তিনি ছিলেন একজন কুস্তিগির। প্রত্যেক দিন বিকেলে শিববালকরাম গঙ্গাতীরে অনুশীলন করতেন। হঠাৎ এমনই একদিন এক মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলেন তিনি। দেখলেন, সদ্যোজাতকে নিয়ে এক মহিলা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছেন। তাঁকে বাঁচাতে শিববালকরামও গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। সেই মহিলাকে বাঁচানো গেলেও সদ্যোজাতটিকে বাঁচানো যায়নি। মহিলাটির নাম লক্ষ্মী। এর পরে তাঁর ঠাঁই হয় শিববালকরামের বাড়িতে। সেই থেকেই মানকী ও শিববালকরামের সুখের সংসারে যেন যবনিকা পতন ঘটেছিল।
কিছু দিনের মধ্যেই লক্ষ্মীর রূপে আসক্ত হয়ে শিববালকরাম তাঁকে বিয়েও করেন। এই নিয়ে পরিবারে শুরু হয় প্রবল অশান্তি। মানকীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং দৈহিক নিগ্রহ শুরু করেন শিববালকরাম। শৈশব থেকে তাই বাবার প্রতি জানকীর মনে বিদ্বেষ তৈরি হয়। শিববালকরামের মিষ্টির দোকানে মাঝেমধ্যেই রঘুনন্দন দুবে নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের আনাগোনা ছিল। সেখানেই লক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। অল্প সময়েই দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং পরে গোপন প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। শিববালকরাম ও মানকীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই লক্ষ্মী এবং রঘুনন্দন গোপনে দেখা করতেন। একদিন ঘরে প্রবেশ করে জানকী তাঁদের দু’জনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন। জানকী এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বললেও, ব্যাপারটি জানাজানি হওয়ার ভয়ে জানকীর মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্য রঘুনন্দন সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কিছু দিনের মধ্যেই একদিন জানকীকে বাড়িতে একা পেয়ে রঘুনন্দন তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ছুরি দিয়ে তাঁর সারা শরীরে কোপাতে থাকেন উন্মত্ত অবস্থায়। যন্ত্রণায় অচিরেই জানকী জ্ঞান হারালে রঘুনন্দন তাঁকে মৃত মনে করে পালিয়ে যান।
গুরুতর আঘাত সত্ত্বেও দৈব কৃপায় বেঁচে গিয়েছিলেন জানকী। জনশ্রুতি, জানকীর সারা শরীরে নাকি ছাপ্পান্নটি আঘাতের চিহ্ন হয়েছিল। যা থেকে তার নাম হয়েছিল ‘ছপ্পনছুরি’। এর পরে লক্ষ্মী নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিলেও, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ার ভয়ে বাড়ি থেকে গয়না ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। আর শিববালকরামও গভীর অনুশোচনায় বাড়ি ছেড়ে চিরতরে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ান। রঘুনন্দন ধরা পড়লে তাঁর কারাবাস হয়। এমন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা মানকী ও জানকীর জীবনের তাৎপর্যটাই বদলে দিয়েছিল। পায়ের তলার মাটি আর মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও আর রইল না। তার উপরে চরম অর্থাভাব। এমনই এক সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন পার্বতী নামে তাঁদের পরিচিত এক মহিলা। তাঁর কথাতেই বারাণসীর পাট গুটিয়ে চিরতরে মানকী তাঁর সন্তানদের নিয়ে ইলাহাবাদে চলে আসেন। তবে এই দুঃসময়ে মানকী যাঁকে সবচেয়ে বিশ্বাস করেছিলেন, সেই পার্বতীই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পার্বতীর হাত ধরে বহু অসহায় মহিলা পৌঁছে যেতেন বিভিন্ন শহরের নিষিদ্ধ পল্লি এবং কোঠায়। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল মানকীর সঙ্গেও।
ইলাহাবাদে শুরু হয় মানকীর জীবনসংগ্রাম। অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছিল শুধু মাত্র তাঁর সন্তানদের বড় করে তুলতে। সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ থাকায় জানকীর তালিমের ব্যবস্থা করা হয় লখনউ এবং গ্বালিয়রের প্রসিদ্ধ হস্সু খান সাহেবের কাছে। এর আগে অবশ্য জানকী বারাণসীর কৈদল মহারাজের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। শোনা যায়, হস্সু খান নাকি এক বছর শুধু সরগম শিখিয়েছিলেন। এর পরে একে একে বিভিন্ন রাগের তালিম দেন। অন্য দিকে বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে জানকী ইংরেজি, সংস্কৃত এবং ফারসি শিখেছিলেন।
সঙ্গীতের তালিম শেষ হলে জানকী বিভিন্ন আসরে গান গাওয়া শুরু করলেন। ইলাহাবাদের এমনই এক আসরে ছিলেন সে কালের সঙ্গীতরসিক রামচন্দ্র দাস। তাঁর প্রশংসা পাওয়ার পরে জানকীকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ইলাহাবাদ ছাড়িয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। তাঁর গানের মেহফিলে ভিড় করতেন নানা বয়সের মানুষ। জনশ্রুতি, এমনই এক আসরে বহু সম্ভ্রান্ত, ধনী শ্রোতা এসেছিলেন। জানকীর গানে তাঁরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে ছিলেন যে, আসরশেষে জানকী পেয়েছিলেন চোদ্দো হাজার সত্তরটি রুপোর মুদ্রা!
সে কালের আর এক প্রবাদপ্রতিম গওহরজানের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। গওহর ইলাহাবাদে গেলে জানকীর বাড়িতেই উঠতেন। তেমনই কলকাতায় এলে জানকীও চিৎপুর রোডে গওহর বিল্ডিংয়ে গওহরজানের অতিথি হয়েই থাকতেন। কলকাতার বিভিন্ন আসরে জানকী গান গাইলেও তার বেশির ভাগই কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। তেমনই এক আসরে একবার জানকীর সঙ্গে ছিলেন লখনউ ও বারাণসীর কয়েক জন বাইজি। তাঁরা প্রথমে ধ্রুপদ, খেয়াল গাইলেও শ্রোতারা ঠিক উপভোগ করছিলেন না। এমনটা দেখে জানকী শুরু করলেন লঘু চালের চৈতি, কাজরী। আসর জমে উঠলে তিনি শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত ঠুমরি, দাদরাগুলি।
গত শতকের গোড়ার দিকে বেশ কিছু রাজা, মহারাজা ও জমিদারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফোনোগ্রাফ যন্ত্রে মোমের সিলিন্ডার রেকর্ডে জানকীর গান রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৯০২ সালে লন্ডনের গ্রামোফোন কোম্পানি এ দেশে রেকর্ডের ব্যবসা শুরু করলেও কোনও এক অজানা কারণে প্রথম দিকে জানকীর গান রেকর্ড করা হয়নি। পরে ১৯০৭ সালে তাঁর গান রেকর্ড করা হয়। সে সময়ে রেকর্ডিস্ট ছিলেন উইলিয়াম কনরাড গেসবার্গ। তিনি জানকীর ২২টি গান রেকর্ড করেছিলেন। রেকর্ডগুলি বাজারে আসার পরে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করায়, পরের বছর নভেম্বর মাসে রেকর্ডিস্ট জর্জ ওয়াল্টার ডিলনাট তাঁর আরও ২৪টি গান রেকর্ড করেন। এর জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে জানকী পেয়েছিলেন ন’শো টাকা! তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়তে থাকায় আবারও ১৯১০ সালের ডিসেম্বরে জানকীর আরও ২২টি গান রেকর্ড করা হয়। আর এ বার তিনি পেয়েছিলেন আঠেরোশো টাকা!
এ ভাবেই কয়েক বছরের মধ্যে জানকী হয়ে উঠেছিলেন গ্রামোফোন সেলেব্রিটি। তিনি ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী, যাঁর সঙ্গে সে কালে কেবলমাত্র তুলনা করা হত ইন্ডিয়ান নাইটিঙ্গল গওহরজানের। ইতিমধ্যেই বাজারে আরও কয়েকটি রেকর্ড কোম্পানি এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানি। সেখান থেকে জানকীর প্রায় ৬০-৭০টি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে টিকে থাকার জন্য রেকর্ড কোম্পানিগুলি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য চুক্তিবদ্ধ ভাবে জনপ্রিয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করত। জানকীকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হলে, তিনি তা নাকচ করেন। পরে অবশ্য ১৯১১ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে জানকী গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য অসংখ্য গান রেকর্ড করেছিলেন। ১৯২৮ সালে বৈদ্যুতিন রেকর্ডিং সিস্টেম চালু হলে আধুনিক মাইক্রোফোনে তাঁর গান রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডে প্রতিটি গানের শেষে উচ্চগ্রামে তিনি নিজের নাম ঘোষণা করতেন ‘জানকী বাই ইলাহাবাদ’। তাঁর নতুন রেকর্ড বেরোলে ইলাহাবাদ, কলকাতা, বারাণসী কিংবা দিল্লির রেকর্ডের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকত। তাঁর কোনও কোনও রেকর্ড পঁচিশ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল।
রেকর্ডে এবং গানের আসরে জানকী ঠুমরি, দাদরা, চৈতি, কাজরি, ভজন গাইতেন। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে ‘মজা লে লে রসিয়া নহি ঝুলনি কা’, ‘ইয়ে জলসা তাজপোসি কা মুবারক হো’, ‘কেয়া তুমনে দিন লিয়া নহি’, ‘এক কাফির পর তাবিয়েত’, ‘ম্যায় ক্যায়সে রাখু প্রাণনাথ’, ‘শ্রীরামচন্দ্র কৃপালু’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মল্লার, দরবারি কানাড়া, ভৈরবী, তিলককামোদ, পিলু, সারঙ্গ, আশাবরীতে গাওয়া তাঁর দাদরা, ঠুমরির রেকর্ডগুলি দীর্ঘ সময় ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। নিজে কবিতাও লিখতেন জানকী। তাঁর সেই সব কবিতার সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দিওয়ান-এ-জনাকী’ নামে। শোনা যায় জানকী সে কালের বিখ্যাত কবি আকবর ইলাহাবাদীর শিষ্য ছিলেন। দু’জনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কবিতা, গান নিয়ে আলোচনাও হত।
সঙ্গীতজীবনের শীর্ষে থাকাকালীন একটি আসরে গান গাওয়ার জন্য তিনি দু’হাজার টাকা নিতেন। পরবর্তী কালে তা পাঁচ হাজার টাকা হয়েছিল! প্রচুর অর্থ উপার্জন করায় জানকী বিলাসী জীবনযাপন করতেন। বিভিন্ন জায়গায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিনেছিলেন। তার মধ্যে রসুলাবাদে মেহনদরিতে গঙ্গার তীরে একটি বড় বাড়ি ছিল। জানকী গ্রীষ্মের সময়ে এখানেই থাকতেন। বছরের অন্যান্য সময়ে থাকতেন ইলাহাবাদের সবজিমান্ডির বিলাসবহুল বাড়িতে। সেখানে ছিল সুসজ্জিত নাচঘর, বৈঠকখানা, ঘোড়াশাল ইত্যাদি। নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তিনি সব সময়ে অবগত থাকতেন। নিজস্ব ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতেন। জানকীর শখের সেই বাড়ি আজ আর আগের চেহারায় নেই। সেখানে বসবাস করেন কয়েক ঘর ভাড়াটে।
জানকীর জীবন ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সংসারী হতে চেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীতজীবনে তিনি যখন শীর্ষে, তখন ইলাহাবাদের এক আইনজীবী শেখ আব্দুল হকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমেই ভালবাসায় বদলালে জানকী ও হক সাহেব বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে তাঁদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী কিংবা সুখের হয়নি। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পর্কের তিক্ততার কারণে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সারা জীবন যুক্ত ছিলেন জানকী। তাঁর উপার্জিত অর্থ থেকে মন্দিরে, মসজিদে যেমন দান করতেন, তেমনই বিভিন্ন অনাথ আশ্রমেও অর্থ দান করতে কখনও কার্পণ্য করতেন না। তাঁর কাছে কেউ সাহায্যপ্রার্থী হলে কখনও ফেরাতেন না। দুঃস্থ এবং গরিবদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল চিরকাল। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে তাঁর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জানকী একটি ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন রাজাপুরের হাসমাতুল্লা সাহেবের সহযোগিতায়। বর্তমানে সেই ট্রাস্টের নাম ‘দ্য জানকীবাই ট্রাস্ট’। ১৯২১ সালে এটি গঠন করা হয়। সেই ট্রাস্টের উদ্যোগে দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি দান, দরিদ্র মানুষদের খাদ্য ও বস্ত্র দান, শীতকালে কম্বল বিতরণ করা হয়। বেশ কিছু মন্দির এবং মসজিদেও তিনি অর্থ দান করেছিলেন। সেই ট্রাস্ট আজও নানা সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত।
শেষ জীবনে হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন জানকী। তবু থেমে থাকেনি তাঁর গান। যদিও শেষের দিকে মুজরো এবং মেহফিলে গান গাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। জানকীর কাছে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন মহেশচন্দ্র ব্যাস। তিনি সাধ্য মতো জানকীর শেষ জীবনে দেখাশোনা করতেন। তবু নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্বে কেটেছিল জানকীর শেষের দিনগুলি। মৃত্যুকালেও তাঁর পাশে কেউই ছিল না। ১৮ মে ১৯৩৪ সালে জানকীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অন্য কেউ না এলেও মহেশচন্দ্র ব্যাস তাঁর অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। ইলাহাবাদের কালাডান্ডা কবরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পরে ট্রাস্টের উদ্যোগে তাঁর নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
জীবদ্দশায় কোনও যোগাযোগ না রাখলেও মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আব্দুল হক জানকীর সম্পত্তি এবং বহুমূল্য রত্ন অলঙ্কারের দাবি করেছিলেন। সোনা-রুপোর সুতোয় কাজ করা জানকীর বহুমূল্য সব পোশাক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল সোনা ও রুপোর জন্য। জনশ্রুতি, মৃত্যুর বেশ ক’বছর পরে কবরখানায় জানকীর সমাধির সামনে মাঝেমধ্যেই এক ফকিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। কয়েকটি ধূপ জ্বালিয়ে তিনি আপন মনে কী যেন প্রার্থনা করে যেতেন... ধূপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠতে উঠতে অচিরেই শূন্যে মিলিয়ে যেত। কত না বলা কথা হয়তো ধোঁয়া হয়ে জানকীর কাছেই পৌঁছে যেত। কে জানে!
ঋণ: রিকুইম ইন রাগা জানকী: নীলম শরণ গৌর,
বাজানামা: এএন শর্মা
দ্য গ্রামোফোন কোম্পানিজ ফার্স্ট ইন্ডিয়ান রেকর্ডিংস: মাইকেল কিনিয়ার