‘সহরে ঢি ঢি হয়ে গেছে, আজ রাত্রে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পুজোর হাফ-আখড়াই হবে। কি ইয়ার গোচের স্কুল বয়, কি বাহাত্তুরে ‘ইনভেলিড’, সকলেই হাফ-আখড়াই শুন্তে পাগল। বাজার গরম হয়ে উঠলো।’ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বিনে মাঝ-উনিশ শতকীয় কলকাতার ব্যাখ্যান কঠিন। নকশা-জবানে, সে মুলুকে তখন গিজগিজ কচ্চে টম্টমে চড়া বাবু, কালীঘাটের দেহপসারিণী, হাফ আখড়াই, চড়ক আর দিশি যাত্রাপালায়। সেই গ্যাটম্যাট ইংরিজি আউড়াবার আর হুইস্কি-সোডা মুর্গি-মটনের কালে, বঙ্গ রেনেসাঁর রঙ্গমঞ্চে গিরিশচন্দ্র ঘোষের আবির্ভাব। সেই সময়ে ধর্মাচরণ, বিদ্যাচর্চা, সমাজ-সংস্কৃতি এমনকি ভাষা ব্যবহারেও বাঙালির জীবনে বইছিল পরস্পরবিরোধী দু’টি স্রোত। এই দ্বন্দ্ব থেকেই নতুন বিকাশের সম্ভাবনা চয়ন করেছিল গিরিশ-মানস। নাটক রচনা ও রচিত নাটকের মঞ্চায়নের যে বিশাল বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া, অন্তত বঙ্গ নাট্যালয়ের সেই উভয় রাজ্যের গিরিশই কারিগর, তিনিই রাজামশাই। বাংলায় নাটক রচনার ক্ষেত্রে তবুও মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা দীনবন্ধু মিত্রকে তাঁর অগ্রপথিক রূপে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু নাটক প্রয়োগ এবং অভিনয়ে গিরিশচন্দ্রের সামনে নজির কই? আপন প্রতিভার কুঠারে কেটে পথ সৃষ্টি করে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সে কারণেই তাঁর অব্যবহিত উত্তরসূরি অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অমোঘ উক্তি, ‘গিরিশচন্দ্র এ দেশের নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন... অন্ন দিয়া ইহার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন... আর এইজন্যই গিরিশচন্দ্র Father of the Native Stage— ইহার খুড়া জ্যাঠা আর কেহ কোনদিন ছিল না।’
অষ্টম গর্ভ
সাল ১৮৪৪। বাঙালির থিয়েটারের ইতিহাসে দু’টি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। রাজা রাধাকান্ত দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে দু’টি ইংরেজি নাটক অভিনীত হল। এবং সেই বছরেরই ২৮ ফেব্রুয়ারি, বাগবাজারের বোসপাড়ায়, নীলকমল ঘোষ ও রাইমণি দেবীর পুত্র গিরিশচন্দ্রের জন্ম। সম্ভ্রান্তজাত নীলকমল পেশায় ছিলেন প্রসিদ্ধ বুককিপার, মেধার আকর। যে পিতৃহীন যুবাটিকে তিনি চাকরি খুঁজে দিয়েছেন, সে মাছ ধরে বেড়ায় বলে তার কাজে জবাব হয়েছে। নীলকমল বিন্দুমাত্র না চটে নিজের মূলধনে যুবাটিকে কতকগুলি পুকুর জমা করে দেন। যুবকের উৎসাহ দ্বিগুণ, তার দুঃখও ঘুচে গেল। আবার এক পানদোষাক্রান্ত গৃহস্থকে নীলকমল মেয়ের বিয়ের জন্য কড়া শর্তে চড়া সুদে টাকা ধার দিলেন। পরে গৃহস্থ তা শোধও করেন। এর কিছু দিন পরে তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়। নীলকমলবাবু তখন লোকটির সুদে-আসলে শোধ করা গোটা টাকাটাই দুর্ভাগা পরিবারের হাতে তুলে দিলেন। নীলকমলের এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা, লোকচরিত্রজ্ঞান এবং পরাক্রান্ত স্বভাব সঞ্চারিত হয়েছিল পুত্র গিরিশের মধ্যে। আর সিমলার মাতৃকুল থেকে গিরিশের আহরণ কাব্যানুরাগ এবং ভক্তিবৃত্তি। এখানে আর এক জনের কথা বলা প্রয়োজন। গিরিশের জ্যাঠামশাই রামনারায়ণবাবু। যেমন দয়াবৎসল, অমায়িক, তেমনই আমুদে ও মাদকপ্রিয়। সব ক’টি গুণ গিরিশের চরিত্রে ষোলো আনা বর্তেছিল।
ঘোষেদের সংসারে ছয় কন্যা, গিরিশ তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র, অষ্টম গর্ভের সন্তান। তবু সে কাছে এলেই রাইমণি দূর দূর করে তাড়াতেন। জনান্তিকে কারণ দর্শিয়েছিলেন, প্রথম পুত্রসন্তান নিত্যগোপালের সদ্য যুবাবস্থায় মৃত্যু। বলতেন, ‘এটী অষ্টমগর্ভের ছেলে, পাছে আমার দৃষ্টিতে কোন অমঙ্গল হয়, তাই আমি একে কাছে আসতে দিতুম না...’ কিন্তু মায়ের অনাদর শিশু গিরিশের মর্মে শেলের আঘাত হেনেছিল। তাঁদের সংসারে শোকতাপ ছিল নিত্যসঙ্গী। দাদার মৃত্যু গোটা বাড়ি অন্ধকার করে রেখেছিল, তার রেশ থাকতেই মৃতা কন্যা প্রসব করে রাইমণিও বিদায় নিলেন। দূরদর্শী নীলকমল সময়ের আয়নায় নিজের ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে সতর্ক হলেন। গঙ্গায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে নৌকাভ্রমণে বেরিয়েছেন। হঠাৎ ঝড়। তখন হেয়ার স্কুলের শিক্ষকমহলে গিরিশের গুণগানে বাবা তাঁর প্রতি বিশেষ সদয়। গিরিশ প্রিয়তম পিতার হাতখানি চেপে ধরল। ঝড় থামলে অপরিচিত স্বরে নীলকমলবাবু বললেন, ‘যদি নৌকা ডুবত— আমি হাত ছাড়িয়ে নিতুম— যেমন করে পারি নিজেকেই বাঁচাতুম।’ সে দিন বাবার দেওয়া তেতো ওষুধ গিলে কেঁদে ভাসিয়েছিল গিরিশ। ওইটুকু বয়সে বুঝেছিল, ব্যথা তার ছায়াসঙ্গী। আশঙ্কা সত্যি করে চোদ্দো বছর বয়সে বাবাকে হারাল। বোনেদের মৃত্যুও দেখতে হল। মা-ছেলের এই কান্নাভেজা সম্পর্ক, পিতার প্রতি আকুল দরদ, ছেলেবেলার বিরহস্মৃতি পরবর্তীতে সজল করেছে নাট্যাচার্যের কালি ও কলম। তখনও শমন বারবার নিয়ে গিয়েছে তাঁর আপনজনদের। ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’— এই অমর সংলাপ তাঁর শোকসন্তপ্ত লেখনীরই দীর্ঘনিঃশ্বাস।
ঐতিহাসিক শখ
বাবা গত হলে গিরিশ এন্ট্রান্সে ফেল করলেন, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দিলেন আর ভাইয়ের মতি ফেরাতে দিদি তাঁর বিয়ে দিলেন শ্যামপুকুরের নবীনচন্দ্র দেব সরকারের মেয়ে প্রমোদিনীর সঙ্গে। গিরিশ তখন পনেরো, পাড়ার পরোপকারী অথচ ‘বয়াটে’ দলের নেতা। উচ্ছৃঙ্খলতায় ভয় পেয়ে শ্বশুরমশাই তাঁকে সাহেবি কোম্পানিতে বুককিপারের শিক্ষানবিশি চাকরি জুটিয়ে দিলেন। সে কাজ পলকে করেন গিরিশ। সঙ্গে আগ্রহ ইংরেজি সাহিত্যে। এবং আসক্তি নেশাভাঙে।
সেই ‘গোলাপে কণ্টক উঠিবার’ দিনগুলিতে বঙ্গ রঙ্গালয়েও ভোর হয় হয়। রুশ পর্যটক লেবেডেফ প্রথম বার ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ দেখিয়েছিলেন ১৭৯৫-৯৬ সালে। তখনই টিকিট কেটে ‘থ্যাটার’ দেখার সূচনা। কিন্তু তার পরেই নাটক ঢুকে পড়েছিল বড়লোকের বাড়িতে। সেই শখের থিয়েটারে যখন অভিজাতরা মজে, তখন সাধারণ বাঙালির বিনোদন বলতে ছিল যাত্রা, পাঁচালি, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, কাঠ-গান। আর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মহা উৎসাহ শেক্সপিয়রের নাটকগুলি অভিনয়ে। গিরিশেরও প্রদর্শশিল্পে গূঢ় অনুরাগ। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্মান দেখে তাঁরও গান বাঁধতে বড় সাধ। আর প্রতিবেশীরা কাঠখড় পুড়িয়ে অভিজাত বাড়ি থেকে ফ্রি টিকিট এনে থিয়েটার দেখে যেমন জাঁক করেন, গিরিশের তেমন করে অভিনয় দেখার বদলে এমন একখান থিয়েটার করার ইচ্ছেটাই বেশি।
কিন্তু নাটক তো প্রকাণ্ড ব্যয়সাপেক্ষ। তাই ১৮৬৭ সালে গিরিশচন্দ্র, রাধামাধব কর, ধর্মদাস সুর... বন্ধুরা মিলে বাগবাজারে শখের যাত্রাদল তৈরি করলেন। তাঁদের প্রথম পালা মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’। বন্ধুদের হতবাক করে চকিতে গিরিশ লিখলেন যযাতির বিস্ময়গীত— ‘...মায়া কি মানবী/ ছলনা করে বুঝি বনদেবী!’ মুহুর্মুহু গান বাঁধার আর এক রাত্তিরে নাটক লেখার আশ্চর্য গুণ সেই প্রথম প্রকাশ্যে। ১৮৬৮-র দুর্গাসপ্তমীতে গিরিশের নেতৃত্বে পুরোদস্তুর থিয়েটারি কেতায় বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার মঞ্চস্থ করল দীনবন্ধু মিত্রের শ্লেষাত্মক সামাজিক প্রহসন ‘সধবার একাদশী’। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক মাতাল নিমচাঁদের ভূমিকায় প্রথম অভিনেতা রূপে মঞ্চপ্রকাশ গিরিশের। সমঝদারেরা একমত— এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। গিরিশের জীবনান্তে ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকা স্মৃতিচারণে লিখেছিল, ‘...গিরিশচন্দ্র অ্যাপিয়ার্ড ইন দ্য রোল অব নিমচাঁদ ইন ‘‘সধবার একাদশী’’ অ্যান্ড হোয়েন হি অ্যায়োক দ্য নেক্সট মর্নিং হি ফাউন্ড হিমসেলফ অ্যান অ্যাক্টর।’ এই নাটকেই সম্প্রদায়ে এলেন নটচূড়ামণি অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। গিরিশ সে কালে সকালে অফিস করতেন, সন্ধের পরে এসে অভিনয় শিক্ষা দিতেন। তবে অর্ধেন্দুবাবু সারাক্ষণই মহলায় থাকতেন ও অভিনয় তুলতে সাহায্য করতেন।
পরের নাটক ‘লীলাবতী’ অভিনয়ের জন্য সম্প্রদায়টিকে আর কোনও ভালমানুষের চকমেলানো উঠোনের তোয়াক্কা করতে হল না। শ্যামবাজারে রাজেন্দ্রলাল পালের বাড়িতে স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ করে অভিনয় শুরু হল। এই নাটক নিয়েই ন্যাসান্যাল থিয়েটার-এর সূচনা। ‘সধবার একাদশী’ ও ‘লীলাবতী’— এ দু’টি নাটক বিদগ্ধ মহলকে মুগ্ধ করল। গিরিশকে নিয়ে সাড়া পড়ে গেল। অবশেষে মধ্যবিত্ত বাঙালি থিয়েটারের চাঁদটি হাতে পেল।
স্টার ও থিয়েটার
বাংলা থিয়েটারে পেশাদারি পর্যায় শুরু হতে দেখা দিল বেশ কিছু নাট্যদল। গিরিশ তাঁর প্রায় চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে অন্তত ষোলো বার নাটকের দল বদলেছেন। কখনও গ্রেট ন্যাশনাল, কখনও এমারেল্ড, কখনও মিনার্ভা, কখনও ক্লাসিক বা কোহিনুর। তাঁর উদ্যোগে স্টার থিয়েটার তৈরি হয়েছে, নিজের বাড়িও পেয়েছে। শোনা যায়, স্টার থিয়েটারের প্রথম প্রহরে তিনি এমারেল্ড থিয়েটারের কর্মচারী। কথিত, নতুন থিয়েটারের ভিত শক্ত করতে বেনামে, ছদ্মবেশে, মাথায় ঘোমটা টেনে এক গুদামঘরে বসে লিখে দিয়েছিলেন ‘নসীরাম’। স্টারের জন্য অকাতরে দিয়ে দিয়েছিলেন নিজের বোনাসের টাকাটুকুও। কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারকে এনে দিয়েছিলেন ‘বিনোদিনী’ নামের আনকোরা প্রতিভা। অর্থাৎ তাঁর এ মঞ্চ সে মঞ্চ গতায়াতে লাভবান হয়েছে বাংলা থিয়েটার। অথচ উপচে পড়েছে গিরিশের বেদনা ও কলঙ্কভার। তখন বাংলা নাটকের রশিটি প্রতাপচন্দ্র জহুরি, গুর্মুখ রায় প্রমুখ ব্যবসায়ীদের রাশে। আবেগী গিরিশ হিসেবখাতার এই মৌরসিপাট্টাও সইতে পারতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্বের ঝাঁজটিও সহনটদের হজম হত না। উদাহরণরূপে, শুরুর সেই ন্যাশনাল থিয়েটারের নামকরণ ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর মত, ‘‘আমাদের রঙ্গমঞ্চ, দৃশ্যপট ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম এখনও এরূপ উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে নাই, যাহাতে ‘‘ন্যাসান্যাল থিয়েটার’’ নামকরণপূর্ব্বক টিকিট বিক্রয় করিয়া সাধারণের সম্মুখে বাহির হওয়া যায়।’’ এই কঠিন নিদানে সম্প্রদায়ের বাকিরা উত্তেজিত হলে চিরস্বাধীন গিরিশ তখনই দল ছাড়েন।
তাঁকে বুঝে ফেলা বড় শক্ত কাজ। তিনি যে নানা রঙের আধার। প্রথমে অভিনেতা, তার পরে মঞ্চাধ্যক্ষ (পরিচালক ভাবনাটি তখনও বিকশিত নয়) এবং তার পরে নাট্যকার। একই সঙ্গে কবিবর, সাঙ্গীতিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক। কিন্তু তাঁর নাট্যকার পরিচিতির হিমালয়ে বহু সত্তা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। অভিনয়-শিল্পী গিরিশচন্দ্রের মহত্তম চরিত্রগুলি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে শোকোন্মাদ ভীমসিংহ বলছেন, ‘মানসিংহ— তাকে এখনই নষ্ট করব।’ গিরিশের ‘মানসিংহ’ গর্জনে কয়েক জন দর্শক বিহ্বল হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। গিরিশের চৌকো গাল দু’টির প্রতিটি পেশি তাঁর কথা শুনত। ‘জনা’ নাটকে তিনি বিদূষকের ভূমিকায় সিরিয়ো-কমিক শৈলীর সঙ্গে বঙ্গমঞ্চের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট দর্শক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, জগাই-মাধাই চরিত্রে গিরিশ-মুস্তাফীর অভিনয়ের কথা। ‘মুখে গালি। অথচ পা দুটো খোলের তালে নাচতে শুরু করেছে।’ এ তো অভিনয়ের শ্রেষ্ঠ শৃঙ্গ, ব্রেখট স্বীকৃত ‘এপিক অ্যাক্টিং’। যখন নটের শরীরের দুই অংশ দু’টি আলাদা ভঙ্গিতে কথা বলছে। আর এক বিশিষ্ট দর্শক গিরিশকে চাক্ষুষ করার স্মৃতিকথা শুনিয়েছেন এক তরুণ অভিনয়-শিক্ষার্থীকে। ‘শিবাজী’ নাটকে ‘আওরংজেব’-এর চরিত্রে গিরিশ। বাদশার দরবারে শিবাজি তীব্র প্রতিবাদ করছেন। সভা চঞ্চল। ঔরঙ্গজেব তিন রকম ভাবে তাকালেন। শিবাজির দিকে, হিন্দু রাজপুরুষদের দিকে (তাদের প্রতিক্রিয়া দেখতে) আর এক বার মুসলমানদের দিকে চাইলেন (যাতে তারা প্রস্তুত থাকে)। তার পরে আস্তে আস্তে বললেন, ‘ছত্রপতির শরীর বোধকরি অসুস্থ। ওঁকে হাকিমের কাছে নিয়ে যাও।’ এই চাউনি, সংযম, স্বরপ্রয়োগ— সবই ‘বিরাট অভিনয়’। তিনি স্টেজের সঙ্গে অন্য জগতের যোগ স্থাপন করে ফেলতেন। ডেভিড গ্যারিক-সহ পৃথিবীর তাবড় নটদের মধ্যে এই মঞ্চ পার হয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বের বিচ্ছুরণ দেখা যায়। এ কাহিনি যে বিশেষ মানুষ শুনিয়েছেন, তিনি হলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। আর তাঁর মনোযোগী শ্রোতার নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ইতিহাস সাক্ষী, তিনি কোন দরের অভিনয় শিক্ষক ছিলেন। সমকালে পাশ্চাত্য মঞ্চ, সেখানকার অভিনয় প্রণালী ও নাট্য সমালোচনার প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি যে সম্যক অবহিত ছিলেন, তা তাঁর অভিনয় বিষয়ক প্রবন্ধগুলি থেকে জানা যায়। পরে গিরিশ-অনুগত প্রাণ ছাত্রী নটী বিনোদিনী জানিয়েছেন, তাঁর মুখে শেক্সপিয়র, মিলটন, বায়রন, পোপের সাহিত্য আস্বাদনের আকর্ষণও কম ছিল না। শেখানোর আগে অনেক সময়েই গোটা নাটকটা পড়তেন গিরিশ। তখন সকল শ্রোতা নাটকীয় সব চরিত্রের ছবি, রূপ, কল্পনা— জলজ্যান্ত ছবির মতো দেখতে পেতেন। ‘লেডি ম্যাকবেথ’ স্বামীর চিঠি নিয়ে কী ভাবে রঙ্গমঞ্চে ঢুকবে, তা তিনি নাকি শত শত বার তিনকড়ি দাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। নাটক দেখে ইংরেজি সমালোচকবর্গ অক্ষরজ্ঞানশূন্য তিনকড়িকে পশ্চিমের অভিনেত্রীবর্গেরও অনেক উপরে স্থান দিয়েছিলেন।
চিতা, ডাইনি, রত্নাকর
বঙ্কিমচন্দ্র সে সময়ের নাটকগুলি দেখে ঠাট্টা করেছিলেন ‘না-টক, না-মিষ্টি’, বঙ্গসাহিত্যের সেই দীনতম শাখায় জীবন সঞ্চার করেছিলেন গিরিশ। নিয়মিত অভিনয় করলেও নাটক রচনায় তিনি প্রথম হাত দিলেন ১৮৭৭ সালে। গিরিশের নাটক লেখার কারণ, সে সময়ে মঞ্চায়ন-উপযুক্ত নাটকের অভাব। এর পরে প্রায় তিরিশ বছর ধরে অক্লান্ত লিখেছেন আশিটিরও বেশি পৌরাণিক, ভক্তিমূলক ও সামাজিক নাটক। গীতিনাট্য ও কৌতুক নকশায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মধুসূদন, নবীনচন্দ্র ও বঙ্কিমের বহু গদ্য ও কাব্যকে নাট্যরূপায়িত করেন। তৈরি করেন ‘গৈরিশী ছন্দ’ নামের অভিনব সংলাপ-রচনার ভঙ্গিমা। প্রথম পর্বে পৌরাণিক নাটক লেখার জন্য অনেকেই মনে করতেন, তিনি তখন যত্ন করেই জাতীয়তাবাদ থেকে পৃথক রেখেছেন তাঁর নাট্যবাণী। এ কি ব্রিটিশের কৌশলী ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ হতে সাবধানতা? গিরিশ বলেছেন, এগুলি জাতির হিতার্থেই লেখা। হয়তো কোথাও জমা হয়েছিল পরিতাপ। তাই তিনি দেশাত্মবোধক নাটক লিখতে শুরু করলেন এমন সময়ে, যখন বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত শুনে জাতি উত্তাল। ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’, ‘মীরকাসিম’— চিতার মতো ঝাঁপিয়ে গিরিশ সাহেবদের টুঁটি চেপে ধরেন প্রায়। নিষিদ্ধ হয়েছিল সেগুলি। এর মধ্যবর্তী সময়ে সামাজিক নাটক ‘প্রফুল্ল’, ‘বলিদান’, ‘আবু হোসেন’, ‘করমেতিবাঈ’-এ তিনি গ্যাসবাতির আলোয় যেন ঔপনিবেশিক কলকাতার অন্ত্র-ব্যবচ্ছেদ করলেন। এই সাংস্কৃতিক খাদ খননে তাঁর সমকক্ষ বুঝি বোদলেয়ারের ‘প্যারিস স্প্লিন’ কাব্যগ্রন্থ। ইংরেজি থিয়েটার থেকে বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের সময়ে তাঁকে সাঁকো পার হতে হত। সামাজিক নাটকে তিনি যে নরকদর্শন করান, তা বুঝি সেখানেই মিলেছিল। ভবিষ্যতে এই উত্তরাধিকার বয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ ও ঋত্বিক ঘটক। ভিন্ন মাধ্যমে।
গিরিশের সব কীর্তি এক দিকে, আর অন্য দিকে তাঁর ‘ম্যাকবেথ’ অনুবাদ। উজ্জ্বলতম সাহিত্যরত্নও অল্প বয়সে ‘ম্যাকবেথ’ অনুবাদ করেছিলেন সুঠাম পদ্যে। তা মনোহর হয়েছিল, কিন্তু রত্নাকর গিরিশের ‘ম্যাকবেথ’ হয়তো স্বয়ং শেক্সপিয়রকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। বহু পণ্ডিত সিদ্ধান্ত করেছিলেন, ‘ম্যাকবেথ’-এর বঙ্গানুবাদ যদি বা সম্ভব, ডাইনিদের ভাষার ধাত রক্ষা কখনওই সম্ভব নয়। গিরিশ চ্যালেঞ্জটা নিলেন। তিনি শেক্সপিয়রের জটিল বাগ্ধারা বজায় রেখে বাংলার নিজস্ব আমেজ জুড়তে নতুন ধাঁচের বাক্য সৃষ্টি করলেন। ভাষার ব্যঞ্জনার সঙ্গে মাথায় রাখলেন দৃশ্যের আবহ, অভিনেতাদের চলাচল। চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম দৃশ্যে ডাইনিরা কড়াইতে কুহক ছড়াচ্ছে। ‘Scale of dragon, tooth of wolf,/ Witches' mummy; maw, and gulf /Of the ravined salt-sea shark...’ গিরিশের অনুবাদে: ‘ছেড়ে দে নেক্ড়ে বাঘের দাঁত,/ সাপের এঁসো মিশিয়ে নে তার সাথ;/ শুঁট্কী করা ডাইনি মরা, /নোনা হাঙ্গর ক্ষিধেয় জরা...’ গোটা নাটকে যেখানে অনুবাদ সবচেয়ে শক্ত, সেখানেই তাঁর বিক্রম সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই রুদ্ররুধির বিলেতি নাটকে দর্শক গলল না। ক্ষুব্ধ গিরিশ বলতে বাধ্য হলেন, ‘নাটক দেখিবার যোগ্যতালাভে ইহাদের এখনও বহু বৎসর লাগিবে... পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠানে আমার যে আপত্তি ছিল— ইহাও তাহার একটা কারণ।’
জুড়াইতে চাই...
যে দিন গিরিশের নাটক দেখতে শ্রীরামকৃষ্ণ এলেন এবং বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন ‘চৈতন্য হোক’, সে দিন বুঝি উচ্চাঙ্গদের নাট্যবিরোধিতার বিষদাঁতটাই ভেঙে গেল। তখন বাইশ বোতল জীবনের গরল পান করে গিরিশ আরক্ত চোখে গঙ্গার ধারে পাহাড়ি পিলুতে খেমটা ধরেন, বারবণিতার দুয়ারও বেহেড মাতাল লোকটার সামনে বন্ধ হয়ে যায়। গিরিশ ডিক্টেশন দিতে দিতে অস্ফুটে বলেন, ‘সবাই অনুগামী, সহগামী কোথা?’ আর তাঁর সেক্রেটারি ধরতে না পেরে প্রশ্ন করলে তিনি খিঁচিয়ে ওঠেন, ‘দিলে তো চিন্তা ভেঙে’— সেই অশান্ত দিনে পরমহংস তাঁর সব যন্ত্রণায় মায়ের আঁচল বিছিয়ে দিলেন। একে একে সংসারের মায়া কাটিয়েছে গিরিশের ভাই-বোন, প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, শিশুকন্যারা। তাঁর শিশুপুত্র মৃত্যুপথযাত্রী, তাকে নিয়ে বায়ু পরিবর্তনে গিয়েছেন বলে গিরিশেরই কৃচ্ছ্রজাত ‘স্টার’ থিয়েটার তাঁকে বরখাস্ত করল! নাট্য সম্রাট রকের ধুলোয় বসে থাকেন আর তাঁর জ্বালার চোখে চোখ পড়ে প্রাণের ঠাকুরের। বিদ্যুৎ ঝাপট মারে। গিরিশ গালি দেন, ঠাকুর হাসেন। গিরিশ ঢের রাতে মন্দিরে চলে আসেন। তাঁর কাতর ডাকে বেরিয়ে ঠাকুর বলেন, ‘মদ খেয়েছিস তো কি, আমিও মদ খেয়েছি। ‘সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে, মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে’।’’ গিরিশের হাত ধরে ঠাকুরের ভাবোন্মাদ নাচে মা কালীর ত্রিনেত্র খুলে যায়। লোকে ছিছি করে।
দর্শকাসন থেকে হল কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন ঠাকুর। ‘ওই গাধাটা কে রে? নামিয়ে দে ওটাকে স্টেজ থেকে।’ ‘দক্ষ’রূপী গিরিশের চরিত্রাঙ্কনে ঠাকুরও বাস্তব বিস্মৃত। গিরিশও তাঁকে ঘিরেই নাটক লেখেন। তাঁর নাটকে ভগবৎচিন্তা, সংলাপে ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’। গিরিশকে ঠাকুর বলেন, ‘তুমি যা কচ্চো, তাই করো। ওতেও লোককল্যাণ হবে। শুধু সকাল-বিকাল ওঁর স্মরণ-মননটা রেখো।’ তা তো পারবেন না গিরিশ। খাওয়া-শোয়ার আগেই বা নাম করেন কেমনে? তাঁর তো ও দুটোর ঠিকানাই নেই। তখন শ্রীরামকৃষ্ণ সাগরের গভীর থেকে হাঁক দিলেন, ‘তবে আমায় বকলমা দে।’ গিরিশ বুঝলেন, ঠাকুরই তাঁর মন থেকে সকল ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।
ঠাকুর বললেন, ‘ওর দোষ হবে না। ওর ভৈরবের অংশে জন্ম। ওকে মা কালীর মন্দিরে দেখেছি— উলঙ্গ অবস্থা, ঝাঁকড়া চুল, বগলে বোতল— নাচতে নাচতে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে মিশিয়ে গেল!’
ঠাকুরের পরেও সারদা দেবী, সিস্টার নিবেদিতার মধ্যে গিরিশ খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নাট্যশালার আপনজনদের। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর অসমবয়সি বন্ধুভ্রাতা। দুই রসালাপীর কূট তর্ক বাধিয়ে খিলখিল করে হাসতেন ঠাকুর। বলতেন, ‘‘দুজনের থাক আলাদা। নরেন্দ্র-রাখালরা নতুন হাঁড়ি। গিরিশ তবে দইপাতা হাঁড়ি। ...ওর ভোগও আছে, যোগও আছে।’’
তিরস্কার-পুরস্কার
ও দিকে পাড়াময় লোকে রাষ্ট্র করল, গিরিশের বকলমা নিলেন ঠাকুর, সঙ্গে তার পাপের হলাহলও, তাই তো তাঁকে কর্কট দংশাল! অহো ভাগ্য! দুই মহাজাগতিক তারার আকর্ষণ-বিকর্ষণের তেজস্ক্রিয়তা কি এমন ভোঁতা যুক্তিতে মেপে ফেলা যায়! সে দাঁড়িপাল্লায় তো শুধু সংসারের পেঁয়াজ-রসুন ওঠে। তাই কেউ বলে না, অচ্ছুৎকন্যাদের কতখানি সম্মানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাগবাজারের গিরিশ ঘোষ। তিনি মনেপ্রাণে এক শ্রেণিহীন সমাজের কথা ভাবতেন, যেখানে মানুষ অনায়াসে এঁদের সঙ্গে মিশতে পারবেন। কিন্তু লোকে শুধু কুৎসিত ইঙ্গিত করে। বলে, তিনকড়ির বাবু গিরিশ ঘোষকে খুন করতে লোক লাগিয়েছিল গো। উপন্যাসে লেখে, বিনোদিনী গিরিশের সজীব প্রতিমা। তাঁর কাছে নাকি সব গ্রন্থি আলগা করে দিত ‘আদরের বিনি’। গিরিশচন্দ্র মদ্যপান করতে রাতে বিনোদিনীর বাড়ি যাচ্ছেন, কিন্তু বিনোদিনী তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। কারণ ঘরে তাঁর প্রেমাস্পদ আছেন। এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে রসরাজ অমৃতলাল বসুর ‘অমৃত-মদিরা’ আবৃত্তি করা হয়— ‘আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার।/ বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার’। এবং ‘গিরিশের পদাবলী রোম্যান্সের মেলা।/ কবিতা লিখাবে তাই বিনি করে খেলা।।’ তার পরে দেখানো হয় বিনোদিনীর মাত্র ২৩ বছরে থিয়েটার ত্যাগের প্রসঙ্গ। সেখানেও নাকি মূল কুশীলব গিরিশচন্দ্র! শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর মেলে না। হাঁপানি-ক্লিষ্ট গিরিশ রামকৃষ্ণলোকে বিলীন হলে (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২), অগণিত জ্ঞানীগুণীর নীরস স্মৃতিচারণার থেকে অনেক তীব্র ভাবে কেন বেজেছিল বারাঙ্গনাদের হাহাকার! গিরিশের মহৎ বৃহৎ শোকসভায় তাঁরা ব্রাত্য। বহু কষ্টে অভিনেত্রীরা একটি আলাদা স্মরণসভার আয়োজন করেন। সেখানে তাঁরা হৃদয়পুষ্পে গিরিশের অর্চনা করেন। গিরিশের অন্য কোনও ছাত্র শিষ্য তাঁদের স্মরণে বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে কখনওই সেই সততার ধারপাশও ঘেঁষেননি। গিরিশের মৃত্যুর পরে পুত্র দানীবাবুকেও (সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ) তির্যক মন্তব্য সইতে হয়েছে। বাবার মতো তাঁরও অভিনয় দেখতে আসেননি নবজাগরণ কালপর্বের চন্দ্রসূর্যরা। তাঁরা বলেছেন, মাথামুণ্ড বিরহিত কাণ্ড যত।
আর আজ? বাঙালি তাঁকে বিন্দুমাত্র ভোলেনি। এত গিরিশ মঞ্চ, গিরিশ অ্যাভিনিউ, গিরিশ ভবন, গিরিশ পার্ক ইত্যকার তর্পণ মিলিয়েও, তাঁর জীবনের কালোটুকুই খুব ভাল করে মনে রেখেছে। যেন গিরিশ ঘোষ মানে শুধুই নারী আর সুরা! এ কি গিরিশের ভাগ্যের বিষ না কি আমাদের ভাবনার গরল? হয়তো এ প্রশ্নের উত্তরও রাখা আছে ভবিষ্যতের কোনও নবজাগরণে।
ঋণ: জীবনীগ্রন্থাবলি, দেশ ২ মার্চ ২০১৯, গিরিশ কথা: সম্পাদনা ব্রাত্য বসু ও সত্য ভাদুড়ি, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বাই-বারাঙ্গনা গাথা: সমন্বয় ও সম্পাদনা দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়