Swimmer

সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হয়েছিলেন যে বাঙালি

অসম্ভবের অভিযাত্রী, ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া প্রথম ভারতীয় নির্ভীক বেপরোয়া সাঁতারু মিহির সেনকে নিয়ে লিখেছেন সুদেষ্ণা বসু   কথায় বলে বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যেয়ো না। কিন্তু তবু চাঁদ যে ধরা যায়, তা মিহির সেন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ০১:১০
Share:

সাত সমুদ্র তেরো নদী সাঁতার কেটে পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তাই ব্যারিস্টার হবেন বলে বিলেতে গিয়েও হয়ে গিয়েছিলেন ‘দীর্ঘ পথের সাঁতারু’। মাত্র এক বছরে পার করেছিলেন পাঁচটি সমুদ্র। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে প্রবাদপ্রতিম এক বাঙালি সাঁতারুর জন্ম হতে দেখেছিল। তাঁর পূর্বসূরিদের কৃতিত্বকে টপকে তিনি যে স্বপ্নকে সত্যি করেছিলেন, চেয়েছিলেন বাঙালি ছেলেমেয়েদের মনেও সেই স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলে তাদেরও অসম্ভবের অভিযাত্রী করতে। তিনি সাঁতারু মিহির সেন।

Advertisement

কথায় বলে বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যেয়ো না। কিন্তু তবু চাঁদ যে ধরা যায়, তা মিহির সেন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর পুরুলিয়ার মানভূমে তাঁর জন্ম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মিহির ছিলেন বড়। বাবা ডাক্তার রমেশ সেনগুপ্ত ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। ডাক্তার হলেও তাঁর রোগীরা ছিলেন পুরুলিয়ার গ্রামের দরিদ্র মানুষ। তাই তাঁর ডাক্তারির ফি কখনওই বেশি হতে পারেনি। যা পেতেন সেই আয়ে সংসারের খরচ টানা যেত না। ফলে মিহিরের মা লীলাবতীকেও স্বামীর সঙ্গে হাত লাগাতে হয়েছিল সংসারে দুটো পয়সা আনার জন্য। বাড়িতে গরু, হাঁস, মুরগি পুষে গ্রামের লোকদের দুধ ও ডিম বিক্রি করতেন তিনি। মায়ের সেই জেদি, কর্মঠ স্বভাবের ছাপ পড়েছিল মিহিরের চরিত্রে।

বাড়ির বড় সন্তানকে ভাল ভাবে মানুষ করে তুলতে সেন পরিবার পুরুলিয়া ছেড়ে ওড়িশার কটক শহরে চলে আসেন। মিহিরের বয়স তখন আট। ছেলেবেলায় তিনি দুষ্টু ও দুরন্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন রমেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘মিহির, আমার সিরিঞ্জ নিয়ে পাকা আমের মধ্যে কুইনিন ঢুকিয়ে বোনেদের খেতে দিত।” তবে ছাত্র হিসেবে মিহির মেধাবীই ছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে মাধ্যমিক পাশ করে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত র্যাভেন শ কলেজ থেকে আইন নিয়ে পাশ করেন। মিহিরের ইচ্ছে হয়, বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার। কিন্তু তাঁর বাবার পক্ষে ছেলেকে বিলেত পাঠিয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করা অসম্ভব ছিল। ফলে মিহিরকেই চেষ্টা করতে হয় কোনও ভাবে অর্থ জোগাড় করার। তাঁর বয়স তখন সতেরো। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। প্রথমে তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেন। রাজনীতিবিদ, সিনেমার তারকা, বড় ব্যবসায়ী কাউকেই বাদ দেননি। কিন্তু সাড়া পাননি কারও কাছ থেকে। এমন সময়ে তিনি খবর পান, ওড়িশার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়ক রাজ্যের তরুণ ছেলেমেয়েদের নানা ভাবে সাহায্য করে থাকেন। মিহির সটান হাজির হয়ে যান তাঁর কাছে। কিন্তু প্রথমে তাঁকেও হতাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

মিহির হার মানার মানুষ তো ছিলেনই না, ছিলেন নাছোড়বান্দা। যেখানেই মুখ্যমন্ত্রী যান, সেখানেই দেখা যায় মিহির তাঁর আশপাশে ঘুরঘুর করছেন। শেষে বিরক্ত হয়ে বিজু পট্টনায়ক তাঁর বাড়িতে আসতে বলেন মিহিরকে। তাঁকে একটি সুটকেস, দশ পাউন্ড ও ইংল্যান্ডে যাওয়ার জাহাজের তৃতীয় শ্রেণির একটি টিকিট ধরিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। সালটা ১৯৫০, মিহিরের বয়স কুড়ি।

ইংল্যান্ডে পৌঁছে মিহিরের দরকার ছিল যে কোনও ধরনের একটি কাজ। রোজগার ছাড়া তাঁর পক্ষে ইংল্যান্ডে থাকাই অসম্ভব ছিল। অনেক খুঁজে একটি রেলস্টেশনে রাতের কুলি হিসেবে কাজ পান। কিন্তু সাত রাত হাড়ভাঙা খাটুনির পরে এক রাতে কাজের সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ফলে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। তিনি মরিয়া হয়ে আবার কাজ খুঁজতে শুরু করেন। খবর পান ভারতীয় দূতাবাস, ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এ লোক নেওয়া হচ্ছে।

স্যর বিলি বুটলিনের সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া বিভিন্ন দেশের সাঁতারুর সঙ্গে মিহির (প্রথম সারিতে বাঁ দিক থেকে প্রথম)

কৃষ্ণ মেনন তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সেখানে নিযুক্ত। অনেক চেষ্টায় মিহির তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু মেনন তাঁকে চাকরি দিতে রাজি হন না। এ বারও হাল না ছেড়ে লেগে পড়েন মিহির। বহু দৌড়ঝাঁপ, অনুরোধের পর ইন্ডিয়া হাউসে একটি চাকরি জোটে। দিনটা ছিল ২১ নভেম্বর ১৯৫১। এই চাকরিই অবশেষে তাঁকে স্বনামধন্য ‘অনারেবল সোসাইটি অব লিঙ্কন ইন’- এ যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। সারাদিন তিনি ইন্ডিয়া হাউসে কাজ করতেন আর রাতে পড়াশোনা। আইন কলেজের ক্লাসে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্যটুকুও তাঁর ছিল না। তাই তিনি লাইব্রেরি থেকে বই এনে বাড়িতেই পড়তেন।

ছাত্রজীবনের সেই কষ্টের দিনগুলোর মধ্যেই লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইউথ হস্টেলের এক নাচের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বেলা ওয়েনগার্টেনের। বেলা লিঙ্কন ইন-এর অফিসে টাইপিস্টের কাজ করতেন। পরবর্তী জীবনে বেলাকে তিনি বিয়ে করেন। ১৯৫৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মিহির সেন ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় পাশ করেন। সেই কুড়ি বছর থেকে অবিশ্রান্ত চেষ্টা ও সংগ্রামের পর ২৪ বছর বয়সে পৌঁছে তিনি যেন এই প্রথম একটু হাঁপ ফেলার ফুরসত পান। যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন তিনি কটক শহর ছেড়েছিলেন, সেই স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হয়। কিন্তু তাঁর জীবন তখনও তীরে ভিড়বার জন্য তৈরি ছিল না।

তখনই একদিন খবরের কাগজের একটি খবর তাঁকে আবার নতুন এক স্বপ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। খবরটা ছিল ফ্লরেন্স চ্যাডউইক নামের এক আমেরিকান সাঁতারুকে নিয়ে। ফ্লরেন্স হলেন প্রথম মহিলা যিনি ১৯৫০ সালে সাঁতারে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন। সে যুগে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়াকে জীবনের বিরাট এক সাফল্য বলে মনে করা হত। মিহিরের মনে হয়েছিল, তিনি ইংরেজ তথা সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবেন স্বাধীন ভারতের এক তরুণও এই কাজ করতে পারে। ঠিক করলেন তিনিও সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পার হবেন। পড়ে রইল ব্যারিস্টারি করার স্বপ্ন।

চেষ্টা করতে লাগলেন কী ভাবে এই অসাধ্য সাধন করবেন! এ দিকে তিনি তখনও ভাল করে সাঁতার কাটতেই জানেন না। বেলা লিখেছেন, তিনি মিহিরের এই পরিকল্পনার কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “চালচুলোহীন কেউ যে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার কথা ভাবতে পারে, তা আমি কল্পনাই করতে পারিনি।” যদিও তাঁর মন বলেছিল, মিহির পারবেন। আর মিহির প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বেলাকে বিয়ে করে দেশে ফিরবেন। তিনি লিখে গিয়েছেন, “আমি তখন তেমন সাঁতারও জানতাম না। শারীরিক এবং আর্থিকভাবেও অত্যন্ত দুর্বল। লন্ডন এমব্যাসিতে সপ্তাহে পাঁচ পাউন্ড মাইনের এক অস্থায়ী কেরানির কাজ করি। তার উপর আবার ব্যারিস্টারি পড়ার চাপ।’’

তিনি অর্থ সাহায্য চেয়ে সটান চিঠি লিখেছিলেন জওহরলাল নেহরুকে। ভাবেননি সেই চিঠি কোনও দিন প্রধানমন্ত্রীর সচিবের টেবিল অবধি পৌঁছবে! দীর্ঘ সমুদ্র-সাঁতার একা কোনও ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব হয় না। একজন সাঁতারুর সঙ্গে একদল কর্মী তাঁর পাশে পাশে সমুদ্রে ভেসে চলেন। এঁদের মধ্যে কেউ তাঁর ট্রেনার, একজন থাকেন যিনি মেগাফোন মুখে সাঁতারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে রাখতে চলেন। একজন সরকারি পর্যবেক্ষক টর্চ হাতে লক্ষ রাখেন সাঁতারু নিয়মানুযায়ী সাঁতার কাটছেন কি না। এঁরা সকলেই সাঁতারুর সঙ্গে চলা পাইলট বোটে থাকেন। এ ছাড়াও একটি ডিঙি নৌকায় একজন কর্মী সাঁতারুর পাশে পাশে বেয়ে চলেন, প্রয়োজনে সাঁতারুকে জল থেকে তুলে নেওয়ার জন্য। পুরো ব্যবস্থাটাই খরচ সাপেক্ষ।

মিহিরের চিঠি পৌঁছেছিল। নেহরু উৎসাহ দিয়ে অর্থ সাহায্যও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই যথেষ্ট ছিল না। জানা যায় মিহির সেনের লেখা থেকে, “সরকার থেকে টাকা পেলাম বটে, তা দিয়ে ট্রেনিংটুকু হল। কোনও ট্রেনার বা কোচ রাখা গেল না। বই পড়ে, অন্যদের সাঁতার কাটা দেখে আমেরিকার সাঁতার পদ্ধতি (আমেরিকান ক্রল) শিখতে চেষ্টা করতাম।”

শুরু হল লন্ডনের ওয়াইএমসিএ-তে সাঁতার শেখা। দিন নেই, রাত নেই। অনেকেই হয়তো তাঁকে পাগল ভেবেছিলেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন এক দেশের তরুণ ভাবছিলেন অন্য কথা। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যদি ইংলিশ চ্যানেল পার হতে পারেন, স্বাধীন ভারতের তরুণ সমাজের কাছে প্রমাণ হয়ে যাবে জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিস হল ঝুঁকি নিতে পারার সাহস। যে সাহস নতুন এক স্বাধীন দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

কিন্তু সদ্য সাঁতার শেখা মিহিরের পক্ষে কাজটা ছিল কঠিন। তিনি লিখেছেন, “সত্যি বলতে কী, ১৯৫৩ সালে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হব ঠিক করলেও আমি তার জন্য তৈরি ছিলাম না। মারাত্মক এক ঝুঁকি নিয়েছিলাম। বৃটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মত ছিল একজন ইউরোপীয় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মকালে চ্যানেলের প্রচণ্ড ঠান্ডা জলে খুব বেশি হলে পাঁচ ঘণ্টা টিকে থাকতে পারে। তারপরই সে ‘হাইপোথারমিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। আমার মধ্যে ইউরোপীয়দের শারীরিক শক্তির ছিটেফোঁটাও ছিল না। চ্যানেলের জলে অতক্ষণ টিকে থাকা অসম্ভব তা আমি ভাল করেই জানতাম।”

তবু কেবল ইচ্ছাশক্তির উপর ভর করে ১৯৫৫ সালের ১৫ অগস্ট ফ্রান্সের তীর থেকে ইংল্যান্ডের তীরের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করেন মিহির। কিন্তু সাড়ে এগারো ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর তাঁকে থেমে যেতে হয়। ওই বছরেরই পরের মাসে (১/৯/১৯৫৫) তিনি আবার চেষ্টা করেন। সাড়ে ছ’ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর তাঁকে আবারও রণে ভঙ্গ দিতে হয়। লিখেছেন, “বারো ঘণ্টা টানা সাঁতার কাটার পর আমি যখন ইংল্যান্ডের তীর থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরে এবং মনে হচ্ছে হয়তো পেরে যাব, তখন হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় উঠল আর চ্যানেলের জল খ্যাপা ষাঁড়ের মতন আচরণ করতে শুরু করল। আমি পারলাম না।”

মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের সঙ্গে মিহির সেন

তবু মিহির হাল ছাড়েননি। পরের বছর ১৯৫৬ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পনেরো দিনের ব্যবধানে দু’বার, ১৯৫৭ সালে আরও দু’বার চেষ্টা করেও ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা মজা করে তাঁকে ডাকতেন ‘প্লাকিয়েস্ট সুইমার’ বলে। ১৯৫৮ সালে আবার প্রস্তুতি নেন। সুবিধে ছিল তাঁর শরীরের চামড়ার নীচে ‘বডি ফ্যাট’-এর মোটা আস্তরণ। যা দীর্ঘপথের সাঁতারুদের সাঁতারের সময় সমুদ্রের জলের উষ্ণতা থেকে রক্ষা করে। শরীরকে চাঙ্গা রাখে আর শক্তি জোগায়।

এ দিকে আরও দুই বাঙালি ওই একই সময়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিলেন। এঁরা হলেন ব্রজেন দাশ ও বিমল চন্দ। এর কারণ মিহিরের এই প্রয়াসের খবর তখন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবরের কাগজেও তাঁর এই অভিনব চেষ্টার কথা ছাপা হচ্ছিল। ফলে আরও অনেকেই উৎসাহিত হয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার কথা। যদিও ইংলিশ চ্যানেল ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনও ধারণা তখন খুব বেশি লোকের ছিল না। বিমল চন্দ লিখেছেন, “ব্রজেন ও আমার তখন কৌতূহল, চ্যানেল ব্যাপারটা কী? অনেক খুঁজে ম্যাপ জোগাড় করে দেখলাম, এইটুকু সাঁতরানো কোনও ব্যাপারই না। সেই থেকে মনে মনে তৈরি হতে লাগলাম।”

এ বারে মিহির সেন ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের তীরে সাঁতার কেটে পৌঁছতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে পথ আরও শক্ত ছিল। তাঁর ভাষায়, “এতদিন আমি অপেক্ষাকৃত সহজ পথটিকে বেছে নিয়ে পার হতে চেষ্টা করছিলাম। ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। কিন্তু এবার আমি উলটো পথটা বেছে নিলাম। ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের তীরে পৌছনোটা বেশ কঠিন ছিল।” ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ। আড়াই ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর থেমে

যান মিহির। ঠিক তিন দিন পর ৯ তারিখ আবার জলে নামেন ও ফ্রান্সের তীরের কাছে সেন্ট মার্গারেট বে-এর থেকে মাত্র দু’ মাইল দূরে পৌঁছেও তাঁকে থামতে হয়। তীরে এসে তরী ডোবা আর কী! ফলে দ্বিগুণ প্রত্যয়ে মিহির ওই মাসেরই ২৭ তারিখ আবার ইংল্যান্ডের তীর থেকে আরও ৮০জন সাঁতারুর সঙ্গে চ্যানেলের জলে নামেন।

১৯৫৮র ২৭ সেপ্টেম্বর। সপ্তম বারের চেষ্টায় চোদ্দো ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সাঁতার কেটে ৮০ জনের মধ্যে ১৯ জন শেষ অবধি ফ্রান্সের তীরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মিহির সেন। সেই ভোরে ফ্রান্সের তীরে পৌঁছে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জলে ভেজা ভারতের জাতীয় পতাকা তুলে ধরে ইংলিশ চ্যানেলের গর্জন ছাপিয়ে গেয়ে উঠেছিলেন জাতীয় সঙ্গীত। তাঁর মনে পড়ছিল সদ্য স্বাধীন এক দেশের অগণিত তরুণ তরুণীর কথা আর বান্ধবী বেলা ওয়েনগার্টেনের কথা। যাঁর উৎসাহেই তিনি এই অসম্ভবের যাত্রায় শামিল ও সফল হয়েছিলেন।

যদিও ঠিক আগের মাসে (২৩ অগস্ট ১৯৫৮) ব্রজেন দাশ প্রথমবারের চেষ্টাতেই ফ্রান্সের দিক থেকে ইংল্যান্ডের তীরে এসে পৌঁছেছিলেন চোদ্দো ঘণ্টা বাহান্ন মিনিটে। পরবর্তী তিন বছর ধরে ছ’বার ইংলিশ চ্যানেল পার হন ব্রজেন। আর পরের বছর বিমল চন্দ ১৯৫৯ এর অগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসে (২৭/৮ অসফল ও ১০/৯ সফল) দু’বারের চেষ্টায় ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন। বিমলের সঙ্গে একই দিনে দু’বারের চেষ্টায় ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন আরতি সাহা (২৭/৮ অসফল ও ২৯/৯ সফল)। মিহির সেনের স্বপ্ন সার্থক হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের তরুণ সমাজের কাছে তাঁর উপমা যে কাজে এসেছিল তারই প্রমাণ ব্রজেন দাশ, বিমল চন্দ ও আরতি সাহার মতো দীর্ঘপথের ভারতীয় সমুদ্র সাঁতারুরা।

সি এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের অনুষ্ঠানে মিহির সেনকে সম্মানজ্ঞাপন

৯৫৯ সালে ভারত সরকার মিহির সেনকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। জওহরলাল নেহরু একজন ভারতীয়র এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের জন্য তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু অসম্ভবের অভিযাত্রী মিহির সেনের পক্ষে এখানেই থেমে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি তখন সাত সমুদ্র পার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। যার নাম দিয়েছিলেন ‘অপারেশন সেভেন সিজ়’। সেই স্বপ্নেরই ফল ১৯৬৬ সালে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যবর্তী জলপ্রণালী যা ‘পক স্ট্রেট’ নামে খ্যাত, সেই প্রণালী সাঁতরে পার হওয়া। এই অভিযানের জন্য নৌবাহিনীর একটি বোট ভাড়া করার অর্থের সবটাও মিহির জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তখন মরিয়া হয়ে যাত্রা শুরুর কয়েক দিন আগে তিনি ইন্দিরা গাঁধীকে অর্থসাহায্য চেয়ে চিঠি লেখেন। ইন্দিরা পত্রপাঠ সেই টাকা পাঠিয়ে দেন। ১৯৬৬র এপ্রিল মাসের ৫ ও ৬ তারিখ জুড়ে টানা পঁচিশ ঘণ্টা ছত্রিশ মিনিট সাঁতার কেটে তিনি পক স্ট্রেট পার হন।

এই সাফল্য মিহির সেনের মধ্যে যেন এক আসুরিক ক্ষমতার জন্ম দিয়েছিল। তিনি ওই বছরেরই অগস্টের ২৪ তারিখ ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী ‘স্ট্রেট অব জিব্রাল্টার’ বা জিব্রাল্টার প্রণালী পার হন আট ঘণ্টা এক মিনিট সাঁতার কেটে। মিহির হলেন প্রথম এশিয়াবাসী তথা ভারতীয়, যিনি এই সাফল্য পেয়েছেন। এর পর সেপ্টেম্বরে তিনি হাজির হন উত্তর-পশ্চিম তুরস্কের ‘ডারডেনেলস’- প্রাচীন জলপ্রণালীর তীরে। এই প্রণালী এশিয়া মাইনরের সেডুলবাহির ও ইউরোপের গাল্লিপোলি উপদ্বীপের এক প্রাকৃতিক জলপ্রণালী, যা এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল। চল্লিশ মাইল লম্বা এই প্রণালী মিহির পার হন ১৯৬৬র ১২ সেপ্টেম্বর, ১৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট সাঁতার কেটে।

ডারডেনেলসের উত্তরে ইস্তানবুলে ‘মারমারা সাগর’ ও ‘কৃষ্ণসাগরের’ সংযোগকারী ‘বসফোরাস জলপ্রণালী’ (স্ট্রেট অব বসফোরাস) পার হন চার ঘণ্টায়। আর ২৯ থেকে ৩১ অক্টোবর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরের সংযোগকারী ৫০ মাইল দীর্ঘ পানামা ক্যানাল তিন দিন অবিরাম সাঁতার কেটে পার হন। তাঁর এই পর্বের প্রতিটি অভিযান ছিল বিপদসঙ্কুল। সমুদ্রের জলে বিষধর সাপ বা হাঙরের আক্রমণ এড়িয়ে বরফের চেয়েও ঠান্ডা জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে সাঁতার কাটতে হয়েছে। তাঁর এই অবিশ্বাস্য সাফল্য গিনেস বুকে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান দেয়। তাঁর এই সাফল্যের কথা ‘অনারেবল সোসাইটি অব লিঙ্কন ইন’এর ‘ব্ল্যাক বুক’-এ আজও নথিভুক্ত হয়ে আছে। এ এক বিরল সম্মান।

মিহির সেন বলেছিলেন “আমি এইসব বিপজ্জনক সাঁতার অভিযান করেছিলাম খ্যাতি বা পুরস্কারের আশায় নয়। আমি কেবল পৃথিবীর মানুষকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমরা ভারতীয়রা আর ভীত নই, আমরাও পারি।” সদ্য স্বাধীন এক জাতির এক স্বাধীন নাগরিকের এই মননকে আজ বোঝা হয়তো সহজ হবে না।

১৯৬৬ সালে ‘অপারেশন সেভেন সিজে’র সাফল্যের পর মিহির হয়ে উঠেছিলেন দেশনায়ক। তাঁকে ভারতের যুব সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হত। রেডিয়োতে কুইজ় কনটেস্টে তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন থাকত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে নানা উদ্দীপক লেখা আজও খুঁজলে চোখে পড়বে। তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‘ব্লিৎজ়’ মিহিরকে নিয়ে দেশাত্মবোধক কবিতাও ছেপেছিল। যার নাম ছিল ‘স্করপিও’। যার প্রথম চরণটি হল, “আই সিং দ্য সং অব মিহির সেন/মিহির সেন, ম্যান অফ মেন/হু ব্রেভড দ্য ট্রেচারাস ওয়াটারলি বেলস” আর শেষ দুটি লাইন হল, “হোয়াট ফিয়ার হ্যাজ় মাদার ইন্ডিয়া, হোয়েন/শি ব্রিডস সনস লাইক মিহির সেন!”

চিন যুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর তাসখন্দে অকালপ্রয়াণে দিশেহারা এক জাতি মিহির সেনকে পেয়ে যেন বেঁচে গিয়েছিল। তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল নামত। মিহির নিজে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতেন। তিনি কলকাতায় গড়ে তোলেন ‘ সি এক্সপ্লোরারস ক্লাব’। তাঁর উদ্যোগেই এই ক্লাবের দুই সদস্য পিনাকী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও জর্জ অ্যালবার্ট ডিউক ১৯৬৯ সালে ‘কনৌজি আংরে’ নামের এক ডিঙি নৌকায় ভেসে পড়েছিলেন কেবল হাল বেয়ে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে আন্দামানে পৌঁছবেন বলে। গোটা দেশ তাঁদের এই অভিযানে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। মিহির সেনের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেয়েছিল।

এই সময় মিহির সেনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক চিরঞ্জীব। তিনি কনৌজি আংরে অভিযানের বিস্তারিত খবর করতেন আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায়। তাঁর কথায়, “কলকাতায় এসে মিহির সেন ব্যারিস্টারি করার পাশাপাশি শুরু করেন সিল্ক রপ্তানির ব্যবসা। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘সুপ্রিয়া’ র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মেয়ে সুপ্রিয়ার নাম দিয়ে রাসেল স্ট্রিটে সিল্কবস্ত্রের একটি শো-রুমও চালু করেন। স্ত্রী বেলা তাঁদের তিন কন্যাকে নিয়ে সুন্দর সংসার গড়ে তুলেছিলেন। প্রায়ই যেতাম মিহিরবাবুর অফিসে। বাড়িতেও গিয়েছি। নানা গল্প হত। সুঠাম শরীর, হাসিমুখ, উজ্জ্বল উপস্থিতির মানুষটিকে আজও অনেকেই মনে রেখেছেন। তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষ। প্রথম দিকে থাকতেন থিয়েটার রোডের করনানি ম্যানসনে। পরে আলিপুরের জাজেস কোর্টের আবাসনে উঠে আসেন। কিন্তু মিহিরবাবুর জীবনে এ সবের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এগারো বছর।”

১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ে মিহির সেন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও জিততে পারেননি। তবে সেই রাজনৈতিক পালাবদল ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ মিহির সেনের জীবনে অভিশাপের মতো নেমে এসেছিল। এক দেশনায়ক ও সফল বাঙালি উদ্যোগপতির সোনার সংসার ও প্রতিষ্ঠান জ্বলে খাক হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিলেন। তৎকালীন বাম নেতৃবৃন্দ তাঁকে শ্রেণিশত্রু হিসেবেই কেবল চিনেছিলেন। ফলে জঙ্গি শ্রমিক ইউনিয়নের আন্দোলনের চাপে মিহির সেনের সিল্কের ব্যবসা লাটে উঠে গিয়েছিল।

ধ্বস্ত, রিক্ত, হতাশ মিহির সেন ক্রমশ অ্যালজ়াইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগটি সম্পর্কে তখনও এ দেশে তেমন কিছু জানা ছিল না। ফলে চিকিৎসাও সে ভাবে সম্ভব হয়নি। বেলা ও মেয়েরা তাঁকে কিছু দিনের জন্য আমেরিকা নিয়ে গেলেও কিছুই করা যায়নি।

এর পর থেকে আলিপুরের ফ্ল্যাটে স্মৃতি হারানো, বিভ্রমে আক্রান্ত মিহির সেনকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা চোখের জল আটকাতে পারেননি। দেখেছেন সেই বিস্মৃত, বিধ্বস্ত দেশনায়ককে নিয়ে স্ত্রী বেলার বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা। তাঁদের বড় কন্যা চন্দ্রার স্বামী আমেরিকা থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। অনেক আবেদন নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় সরকার মিহিরের জন্য মাসিক এক হাজার

টাকার পেনশনের বন্দোবস্ত করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জন্য এককালীন কিছু অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

শেষরক্ষা হয়নি। জীবনের শেষ সতেরো বছর মিহির সেন অ্যালজ়াইমার্স ও পার্কিনসন্স রোগে ভুগেছিলেন। অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। একদিন তাঁর শারীরিক অবনতির খবর পেয়ে আলিপুরের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন সমাজসেবী ডি কে শরাফ। তাঁর কথায়, “যখন আমি তাঁর বাড়ি পৌছলাম, দেখি তিনি বিছানায় পড়ে আছেন। সেবাযত্ন করার কেউ নেই। পাড়াতেও কেউ তাঁর খবরই রাখে না! মিহিরের স্ত্রী ও আপনজনেরা তাঁকে ফেলে রেখেছিলেন আর্থিক ও মানসিক চাপ সামাল দিতে না পারার কারণে। এ ছাড়া তাঁদের করারও কিছু ছিল না। তবে তৎকালীন রাজ্য সরকার যদি সাহায্য করতে এগিয়ে আসত তবে হয়তো কিছু হত।”

শরাফ মিহির সেনকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসায় ও সেবায় কিছুটা ভাল হয়ে উঠেছিলেন মিহির। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ১১ জুন ১৯৯৭, হৃদ্্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান বিস্মৃত এই ক্রীড়াবিদ মিহির সেন। তাঁর দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেলা সেনের মতবিরোধ দেখা দেয়। দু’ পক্ষই চায় দাহ করার অধিকার। শেষে যৌথ ভাবে মিহির সেনের দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সে দিন সেখানে মিহির সেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বাংলা তথা ভারতের ক্রীড়া জগতের কোনও সাঁতারু বা সরকারের তরফে একজনও হাজির ছিলেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement