শিল্পী শানু লাহিড়ীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
আর পাঁচ বছর পরেই শতবর্ষ পূর্ণ হবে শানু লাহিড়ীর। যতটা পরিচিত হওয়ার কথা ছিল শিল্পীর, ততটা খ্যাতি হয়তো পাননি তিনি। সম্প্রতি গ্যালারি আর্ট ফ্রিকোয়েন্সিজ়ে আয়োজিত হয়েছিল ‘শানু লাহিড়ী: ট্রানজ়িশনস অ্যান্ড ইন্টারসেকশন’ নামে এক প্রদর্শনী।
শিল্পীর কাজের বিষয়ে বলার আগে নতুন প্রজন্মের জন্য তাঁর সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নেওয়া দরকার। শিল্পীর ছোটবেলা কেটেছে গ্রামবাংলায়। সেখানে মাটির সরার গায়ে ছবি আঁকা দেখে শিখে, পটচিত্র নির্মাণের সেই রং নিজের হাতে মেখে বড় হয়েছেন। কলকাতায় এসে তাঁর প্রথাগত শিল্পশিক্ষা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে। অতুল বসু তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আর্ট কলেজের পাঠ শেষ করার কয়েক বছরের মধ্যেই শানুর প্যারিসযাত্রা।
দু’বছর প্যারিসে থেকে, আধুনিক শিল্পীদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে শানু দেশে ফিরলেন। প্যারিসে থাকাকালীন রিয়ালিজ়ম থেকে অ্যাবস্ট্র্যাকশন, কিউবিজ়ম, ইম্প্রেশনিজ়ম, এক্সপ্রেশনিজ়ম... ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বিশেষ করে পরিচয় হল রুসো, পিকাসো, মাতিস, শাগালের মতো শিল্পীদের সঙ্গে। প্যারিস থেকে ফেরার পরে কয়েক বছরের মধ্যেই শিল্পী খুঁজে পেলেন তাঁর নিজস্ব পোস্ট-মডার্ন এক ভাষ্য।
গ্যালারি আর্ট ফ্রিকোয়েন্সিজ়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর কাজের মধ্যে যে বিষয়টি দর্শককে প্রধানত আকর্ষণ করবে, সেটি তাঁর বলিষ্ঠ রেখা এবং সীমিত রঙের ব্যবহার। একটি বেশ বড় মাপের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা এক তাঁতির অবয়ব দেখা গেল। সুস্পষ্ট, অথচ স্বল্প লাইনের কাজ। গাঢ় ধূসর এবং ইয়ালো অকারের ব্যবহার আছে। ঝুড়ি বুনতে বুনতে তাঁতির চোখ চলে গিয়েছে অন্য জায়গায়। সে ভাবেই কিছু একটা দেখছে সেই ব্যক্তি। চোখের অভিব্যক্তিটি চমৎকার!
আর একটি ছবিতে এ যুগের কৃষ্ণ, বাঁশি হাতে। আশপাশে তিনজন রমণী। প্রথম নারী তার বুকের উপরে আড়াআড়ি ভাবে দু’হাত রেখেছে, কিছুটা আত্মরক্ষাত্মক ভঙ্গিতে, যেন কৃষ্ণের আকর্ষণকে ঠেকাতে চাইছে সে। আর বাকি দুই রমণী কৃষ্ণপ্রেমে বিহ্বল। বেশ বড় ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা। রেখা ও রং পরস্পরের পরিপূরক এখানে। কোনও আতিশয্য নেই। আধুনিক ভাবে আঁকা, কিন্তু মুখাবয়বের অভিব্যক্তি মর্মস্পর্শী। কৃষ্ণকে রেখেছেন আলো-আঁধারে। ক্যানভাসের উপর তেলরঙে করা আরও একটি কাজ উল্লেখযোগ্য। রিকশায় বসে চলেছে একটি মেয়ে। পিছনে ঘুরে কিছু দেখছে। উড়ছে চুল, উড়ছে শাড়ির আঁচল। আর বিশেষ কিছু বলা নেই ছবিতে, কিন্তু গতিটা ধরেছেন কয়েকটি রেখায়, আর এক ছোপ হলুদ রঙে।
শানু লাহিড়ীর মতো জোরালো রেখা এবং অন্য রকমের রঙের ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না। অত বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসক সবে দেশ ছেড়েছে, সেই সময়কার ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে সুজা, রাজা বা হোসেনের মতো শিল্পীরা নিজেদের স্বাক্ষর রেখেছিলেন ছবিতে। তার আগে আমাদের বাংলায় যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেজের মতো শিল্পীরা আধুনিকতার দরজা খুলে দিয়েছেন। সেই রকম সমসাময়িক আরও কিছু শিল্পীর মতো শানু লাহিড়ীও খুব অল্প সময়েই ছবির মাধ্যমে নিজের এক বিশিষ্ট ভাষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিজের শিল্পবোধ ও শিল্প সম্পর্কিত ধারণায় অত্যাধুনিক ছিলেন এই শিল্পী।
প্রদর্শনীতে ছিল এক অত্যাশ্চর্য বিড়ালের ছবি। তার শরীরের গঠন একেবারেই ভেঙে ফেলেছেন শিল্পী। লম্বা হাঁসের মতো গলা বাঁকিয়ে পিছনে দেখছে সেই বিড়াল। মুখে তার মাছের কাঁটা। সতর্ক, সাবধানী দুটো চোখের আকর্ষণ অনবদ্য। উজ্জ্বল হলুদ রঙের ব্যবহার ও ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা লালের সামান্য ছোঁয়ায় ধূসর রং নজর কাড়ে।
আর একটি ছোট ছবিতে মোটা তুলি দিয়ে আঁকা গাছ এবং বাড়ি। বাড়ির ছাদের উপরের রূপরেখাটি কালো। বাড়ি দু’টির রং ধূসর। ছাইরঙা আকাশে উজ্জ্বল কমলা রঙের সূর্য। সূর্যের আলোর অল্প প্রতিবিম্ব বাড়ির গায়ে। খুব অল্প পোশাকেই ক্যানভাস সাজানোর ক্ষমতা ছিল শানু লাহিড়ীর।
কালি এবং কন্টি পেন্সিলে করা কাগজের একটি ছোট কাজ ‘কম্পোজ়িশন’। সত্যিই অসাধারণ এই ছবিটির বিন্যাস। কালো কালি দিয়ে করা নিকষ কালো জল এবং তার উপরে কন্টি পেন্সিলে ভয়াবহ এক কুমির এবং একটি মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। হয়তো সে জলে নামবে ভেবেছিল কারণ সে বস্ত্রহীন, কিন্তু কুমির দেখে উদ্ভ্রান্ত। আরও একটি ছবিতে অ্যাক্রিলিকে একটি মেয়ের মুখাবয়ব দেখা গেল। শুধু কয়েকটি চকলেট ব্রাউন রঙের টানে করা কাজ এবং মুখে কিছু বার্নট সিয়েনার ছোপ। এক্সপ্রেশনিস্টিক কাজ, অনুভবপ্রধান ছবি।
মোট ২৪টি ছবিতে সাজানো শানু লাহিড়ীর এই প্রদর্শনী। এ ছাড়াও রাখা আছে ছোট ছোট ন’টি ফোটোগ্রাফ, যার মধ্যে একটি ছোট ফোটোগ্ৰাফ হল ‘দ্য গ্রুপ’। মহিলা শিল্পীদের এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন শানু। করুণা সাহা, মীরা মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ রোহতাগি, শ্যামশ্রী বসু এবং শানু লাহিড়ীকে এক ফ্রেমে দেখার দুর্লভ সুযোগ রয়েছে সেই ছবিটিতে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন বিনায়ক পসরিচা। তরুণ এই কিউরেটর খুবই যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন শানু লাহিড়ীর শিল্পকর্ম। তবে প্রদর্শনীর উপস্থাপনা একটি নির্দিষ্ট কালক্রম মেনে করলে হয়তো তা দর্শকের পক্ষে আরও একটু সুবিধেজনক হতে পারত।