‘বাবা’র সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খান
রবিশঙ্করের স্মৃতিকথা তখন শোনা ও লেখা হচ্ছে লন্ডনে। সাউথ কেনসিংটনের চেলসি ক্লয়েস্টার্স হোটেল অ্যাপার্টমেন্টে।
এক দিন একটু আগে আগেই যাওয়া হয়ে গিয়েছে, কেন কী ভাবে কে জানে! তখনও চানে যাননি উনি, হাতে জনপ্রিয় একটা মার্কিন ম্যাগাজিন নিয়ে বসে।
যেতেই বললেন, ‘‘আমি চানে যাই। ততক্ষণে এই লেখাটা পড়ে ফেলো।’’
দেখি সেন্টারস্প্রেড করে ছাপানো এক অসাধারণ বৈ়ঞ্জানিক বিস্ময়কে নিয়ে রচনা, যিনি দুরারোগ্য মোটর নিউরোন ডিজিজে আক্রান্ত। নিজের হুইলচেয়ারের বাইরে এক চুল নড়ার জো নেই, অথচ সেখানে স্থির হয়ে বসে ব্রহ্মাণ্ড রহস্য উদ্ধারে মেতে আছেন।
১৯৭৭-এর হেমন্তকাল সেটা। পদে পদে বিস্মিত হতে হতে প্রথম পড়লাম প্রফেসর স্টিফেন হকিংকে নিয়ে সেই লেখা।
পড়ে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলাম। টের পাইনি কখন রবিশঙ্কর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী বুঝলে?’’
কী আর বুঝব, ঘোরই কাটে না!
সামনের সোফাটায় এসে বসে রবিশঙ্কর বললেন, ‘‘লেখাটা পড়তে পড়তে আমার বাবার (আলাউদ্দিন খান সাহেব) কথা মনে আসছিল।’’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেন?’’
রবিশঙ্কর বললেন, ‘‘দ্যাখো, এই ছেলেটার শরীরটাই ওর বিরুদ্ধে। অথচ ওর মন ছুটছে গ্রহ উপগ্রহ তারার রাজ্যে। মনের এর চেয়ে বড় স্বাধীনতা আর কী হতে পারে বলো?
‘‘তেমনি দেখো বাবার জীবন। সেই ছোটর থেকে কী সাঙ্ঘাতিক পরিস্থিতির মধ্যে বাবা। অভাব, অনটন পেটের জোগান নেই, কিন্তু মন খুঁজে বেড়াচ্ছে গান। বারমুখো ছেলেকে সংসারী করতে বিয়েও দেওয়া হল। তবুও সে পাললো।
‘‘গুরুর থেকে গুরু, এ যন্ত্র থেকে ও যন্ত্র। কী খুঁজছেন, না রাগরহস্য! কোথায় জন্মালেন আর কোথায় না কোথায় ঘুরে মরলেন, শুধু গানের নেশায়। পুব বাংলার গ্রাম ছেড়ে এসে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নুলো গোপালের কাছে গান, স্বামীজির পরিবারের হাবু দত্ত কী লোবো মাস্টারেরর কাছে বেহালা, এক স্থানীয় আর্টিস্টের কাছে ক্ল্যারিনেট, ওস্তাদ হাজারি খানের কাছে সানাই, তারপর নানা জনের কাছে মৃদঙ্গ। এক সময় ওস্তাদ আহমেদ আলির সরোদ শুনে তাজ্জব হয়ে পণ করলেন ওঁর কাছেই সরোদ শিক্ষা করবেন। সেই পর্ব শেষে রামপুরের কিংবদন্তি ওস্তাদ উজির খানের কাছে সরোদ, সুরশৃঙ্গার আর রবাব। আর এই এত বাদ্যকারি, তন্ত্রকারির কী লক্ষ্য? রাগের রূপ ও রহস্য উন্মোচন করা।
‘‘আসলে লক্ষ্যটা এক। সুরলোক চেনা, নাদব্রহ্মে পৌঁছনো। এই যে এত বিগ ব্যাং থিওরির কথা শুনছি, সেও তো মহানাদই হল!’’
কথাগুলো টেপ করার উদোগ করছি দেখে রবিশঙ্কর জিভ কেটে বললেন, ‘‘না, না, বিজ্ঞান-টিজ্ঞানের ব্যাপারে আমার বলা সাজে না। আমি শুধু বাবার কথাই বলব।’’ বলে সুরশৃঙ্গারের কথায় চলে গেলেন।
উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর একটা কথা বারবার স্মরণ করাতেন। বলতেন, ‘‘বাবাকে নিয়ে এত গল্প রটে আছে জগতে যে, আমি চেষ্টা করি নিজের চোখে যা দেখেছি, সেটুকুই বলে যাবার। আর তাতেই অবাক হয়ে যাই এ সবও সত্যিই ঘটেছে!’’
এই প্রসঙ্গে আলি আকবর খান সাহেবের একটা কথা মনে আসছে। শান্তিনিকেতনের ট্যুরিস্ট লজের একটা ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। ওঁর বহু দিনের বন্ধু বিমান ঘোষ (তখন এইচ এম ভি-র এক কর্তা) বারবার বলছিলেন, ওঁকে বাংলায় একটা আত্মজীবনী করার জন্য।
এক সময় হুইস্কির গেলাসটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে কেমন একটা আত্মমগ্ন সুরে খান সাহেব বললেন, ‘‘যা সরোদে বলতে পারিনি, তা কি মুখে বলতে পারব?’’
অনেক রাতে খানসাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বিমানদা বলছিলেন, ‘‘আলু (আলি আকবর) ওই যে কথাটা বলল না, ওটা একেবারে ওর বাবার কথা।’’
বললাম, ‘‘তবু ওঁর বাবা তো শান্তিনিকেতনে শুভময় ঘোষকে নিজের জীবনের কথা কিছু শুনিয়েছিলেন।’’
বিমানদা বললেন, ‘‘ঠিকই। কিন্তু অত বড় জীবনের সে আর কতটুকু?’’
ঘটনাচক্রে বাবা আলাউদ্দিনের সেই আত্মকথার এক নতুন সংস্করণের ভূমিকা লেখাতে রবিশঙ্করের কাছে যেতে হয়েছিল মুম্বইয়ে ১৯৭৮-এ।
সেন্টোর হোটেলে তাঁর হাতে এক সন্ধেয় বইয়ের ফর্মা দিয়ে এলাম।
পরদিন সকালে যেতেই কোনও ভূমিকা না করেই ডিক্টেশন দেওয়া শুরু করলেন, ‘‘আমি সত্যি এত দিন জানতাম না যে, বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের মুখের কথার ওপর এমন একটা বই লেখা হয়েছিল।’’
এর পর রবিশঙ্কর বাবা বিষয়ে একটার পর একটা চাক্ষুষ করা ঘটনা বলে গেলেন।
সেরকম দুটো গল্প শুনিয়ে (অবশ্য ওঁর নিজস্ব কথায়) আলাউদ্দিন খান সাহেবের জীবন কথায় যাব। প্রথম বৃত্তান্ত ওঁর বাগান করা নিয়ে—
‘‘বাবার আর-একটা হবি ছিল বাগান চর্চা করা। ওঁর কথায় মাইহারের জমি ছিল ভয়ঙ্কর বেসুরো এবং বেতালা। তার ওপর জলকষ্ট। তা ছাড়া ওখানকার মাটিতে এবং জলে চুনের ভাগ অনেকখানি। মাইহার তো হল গিয়ে চুনের আড়ত, দুনিয়ার যত লাইম ফ্যাক্টরি সব ওখানেই। কাজেই ওখানে সবুজ বাগান পয়দা করা, বা ফুল-ফলের খেত করা দুষ্কর ব্যাপার। কিন্তু ছোটবেলার থেকেই তো বাবার ছিল সেই অসম্ভবকে লড়ে পাবার জেদ। উনি গোটা পরিবেশটাকেই একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখলেন এবং সেই মতন ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই অসম্ভব কাজটাই সম্ভব করে তুলতে। এবং কয় বছর মেহনত করে বাবা যে-বাগান সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল মাইহারের রাজবাড়ির বাগানের পরে সবচেয়ে দর্শনীয় বাগান।
‘‘তবে সে কী মেহনত! বাপরে! মালিটালি রাখার তো ধারই ধারতেন না। কাল্লু বলে একটা ওই অঞ্চলের একটা কোল-চাকর ছিল। যার প্রধান কাজ ছিল বাড়িতে এবং বাগানে জল সরবরাহ করা। কুয়োর থেকে তুলে তুলে। প্রত্যেক দিন চার-পাঁচ ঘণ্টা বাবা বাগানের সঙ্গে লড়াই করতেন। জল কম ঢাললে সেই কাল্লুকে তো বটেই সেই সঙ্গে বাবা গাছগুলোকে এবং জমিগুলোকে বকাবকি করতেন। একে ওঁর ওই রণমূর্তি— পরিশ্রম করে ঘেমে নেয়ে একাকার, গায়ে মাথায় মাটি— তার ওপর হাতে দা, কাস্তে, কোদাল কিছু না কিছু একটা। ভয়ে আমাদের পিলে চমকে যেত। ওঁর ত্রিসীমানা মাড়াতাম না।’’
রবিশঙ্করের বলা দ্বিতীয় বৃত্তান্তটা রাগের ঘটনা হলেও কিছুটা মজার ও মধুর। এবং তা ওঁদের দু’জনের সম্পর্কের ওপরও সুন্দর আলোকপাত করে। রবিশঙ্কর বলছেন—
‘‘শেখবার সময় কয়েক বার দেখেছি তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতাম বলে উনি খুব খুশি মেজাজই আমাকে শেখাতেন। কিন্তু যে দিন হয়তো ওঁর মেজাজটা আগে থেকেই খিঁচড়ে থাকত, ওঁর মুখটা মেঘাচ্ছন্ন দেখতাম, সে দিন আমারও মাথাটা কী জানি কীরকম ভোঁতা হয়ে যেত।
‘‘ওঁর শেখানো জিনিসগুলো তুলতে অযথা দেরি হয়ে যেত। মারধর বা গালি না জুটলেও বুঝতাম বাবার মেজাজ আরও বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এবং তা প্রকাশ পেত তাঁর গলার কর্কশতায় এবং আওয়াজের ভলিউমের তারতম্যে। এ রকম অবস্থায় প্রায়ই দেখতাম বেশ কড়া সুরে বলছেন, তুমি বাজাও। বলেই উঠে যেতেন।
‘‘আমার তো তখন বাজনা মাথায় চড়েছে। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসত। ভাবতাম মাথায় থাক বাজনা, আজকের বিকেলের ট্রেনেই এখান থেকে বিদেয় হব। যা হোক, এরকম পরিস্থিতি প্রায়ই দেখতাম। কিছু পরে উনি ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় আবার শেখাতে শুরু করতেন। অথবা বলতেন, যাও বাড়ি গিয়ে রেওয়াজ করো।
‘‘পরে জানতে পেরেছিলাম— এখন ভাবলে হাসি পায়— যে উনি আমার ওপরে রাগ পুরোপুরি প্রকাশ করতে না পেরে, ফ্রাসট্রেটেড হয় একেবারে বাইরে চলে যেতেন। যাকে পেতেন তার ওপরই চেঁচামেচি করে রাগটা খালাস করে দিতেন, আর তার বেশি হলে অন্য কোনও ছাত্রকে দু’ঘা মেরে অথবা কোনও পাড়ার কুকুরকে লাঠির বাড়ি মেরে নিজের রাগটুকু ঝরিয়ে দিতেন। এবং সে রকম কাথারসিস হয়ে গেলে আমাকে শেখাবার জন্য আবার ফিরে আসতেন।
*****
আলাউদ্দিন খান সাহেবের জীবন নিয়ে গল্পের অন্ত নেই। অথচ ওঁর জীবনের একটা বড় অংশের ঘটনাবলির কোনও সন-তারিখের বালাই নেই।
১৯৭২-এ ওঁর প্রয়াণ হলে ওঁর জন্মসন নিয়েও কম তোলপাড় হয়নি। দেখা গেল ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ যখন ওঁকে পদ্মভূষণ অর্পণ করলেন (১৯৭১-এ ওঁকে পদ্মবিভূষণও দেওয়া হয়) তখন পরিচয়-পত্রাদিতে ওঁর বয়স উল্লেখ করা হয় ৯২ বছর। সেক্ষেত্রে খান সাহেবের জন্মসন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল ১৮৬৬!
মাইহার থেকে ১৮ মে, ১৯৫৬-য় এক শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথকে লেখা চিঠিতে খান সাহেব তাঁর তখনকার বয়স জানিয়েছিলেন ৯০। তাতেও তাঁর জন্মসন দাঁড়াচ্ছিল ওই ১৮৬৬। তবে শেষ অবধি যে সনটি মান্যতা পেল, তা ১৮৮১; যে়টি হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং আরও কেউ কেউ অজস্র তত্ত্বতল্লাশি করে ধার্য করতে পেরেছেন।
গত শতাব্দীর গোড়ার থেকেই ইতিহাসের অলিন্দে ঘোরাফেরা আত্মভোলা আলাউদ্দিন খানের। তবে তারিখ দিয়ে তাঁর যে-সাড়াজাগানো বাজনার কথা নিয়ত চর্চায় আসে সেটা ১৯২৫-এর চতুর্থ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সের, যার ক্ষেত্র লখনউ।
সেখানে ১১ জানুয়ারি খান সাহেব আসর মাত করলেন বেহালায় কাফি ও তিলক কামোদ বাজিয়ে। তবলায় বারাণসীর বীরু মিশ্রকে নিয়ে সে নাকি এক অদ্ভুত প্রাণ উদ্বেল করা অভিজ্ঞতা ছিল।
বেহালা যন্ত্রকে তখন তখন তার বিলিতি নাম ভায়োলিন হিসেবে প্রচার করা হলেও খান সাহেব সেটির নিজস্ব নামকরণ চালু করলেন বাহুলীন, যেহেতু তা শিল্পীর বাহুতে লীন হয়ে থাকে।
কনফারেন্সের আরেক দিন আলাউদ্দিন নতুন এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেন খালিফা আবিদ হোসেনকে তবলাসঙ্গী করে গারা এবং দরবারি কানাড়া বাজিয়ে।
দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত এই আসরের চাঞ্চল্যের উপকরণ হয়েছিল আবিদ হোসেনের সঙ্গে খান সাহেবের তাল-লয়কারির মারপ্যাঁচ, দ্বন্দ্ব। শেষের দিকে সে-খেলা এমন পর্যায়ে চড়ে গিয়েছিল যে পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে এবং লখনউয়ের রাজা নবাব আলি ঠাকুরের মধ্যস্থতায় লড়াইয়ের ইতি টানতে হয়।
ফের ফিরে যাব কলকাতা মহানগরীতে আলাউদ্দিন খানের প্রথম দিককার দিনগুলোয়। যখন হাবু দত্তের কাছে ওঁর জটিল এবং উন্নত বেহালা শিক্ষা চলছে, শুধুই কি বেহালা? নানা যন্ত্রে আলমের (খান সাহেবকে এই ডাকা হচ্ছে তখন; ১৯৭৩-এ পিতার এই নামটিকেই কুর্নিশ করেছেন আলি আকবর ‘আলমগিরি’ নামে এক অনুপম রাগ রচনা করে) খোঁজ ও হাতযশ দেখে হাবু দত্ত ওঁকে হরেক যন্ত্র শিখতে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন, তারপর এক দিন ওঁর প্রবল অর্থকষ্টের কথা জেনে ওঁকে নিয়ে সরাসরি হাজির হলেন সে-যুগের সেরা নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে। উদ্দেশ্য মিনার্ভা থিয়েটারে আলমের একটা ব্যবস্থা করা।
আলমের কাজ হল নাটকের সঙ্গীত পরিচালকের সুরের কাজে সহযোগিতা করা আর থিয়েটারের তাবৎ সঙ্গীতযন্ত্রের দেখভাল। এই করতে করতে মঞ্চের জন্য সুরারোপের কাজও শেখা হয়ে গেল আলমের। যা দিব্যি নজরে এল গিরিশবাবুর। যিনি অচিরে ওঁকে নিজের নিকট বৃত্তে টেনে নিলেন। এবং এক নতুন নামও দিলেন— প্রসন্নকুমার বিশ্বাস।
একের পর এক এই যে গল্পের শুরু আলাউদ্দিন খাঁর জীবনে বাকি জীবনে তার আর ইতি হল না।
সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুর সন্ধানে ঘটানো ওঁর নানা কাণ্ড। বলা হয় যে, গান শিখবেন বলে ফুলশয্যার রাতে নববধূর গহনা নিয়ে নুলো গোপালের শরণে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলেন আলম। কিন্তু পাথুরিয়াঘাটায় পৌঁছে খবর পেলেন যে তার ক’দিন আগে কলেরায় প্রাণ হারিয়েছেন তাঁর গুরু। অগত্যা শরণাপন্ন হলেন হাবু দত্তের।
সরোদগুরু উস্তাদ আহমেদ আলির কাছে চার বছরের শিক্ষাকাল আলাউদ্দিন খানের কেটেছিল কার্যত রাঁধুনিগিরি করে। নিজে মাংস খান না, তাই ওস্তাদের জন্য রাঁধা মাংস যে তরিবত করে সব সময় পাকাতে পেরেছেন তাও নয়।
কাজেই একটু এ ধার-ও ধার হলেই কপালে বকুনি ছিল। কিন্তু আলম সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছেন, সকালে গুরুর রেওয়াজটুকু শুনবেন বলে। তার পর গুরু বাড়ির বাইরে গেলে গোপনে স্মৃতি থেকে সেই বাজনার রেওয়াজ করবেন বলে।
আহমেদ আলি আলমকে বিলম্বিত ও দ্রুত গতের বাইরে কিছু শেখাতে রাজি ছিলেন না। আলাপ তো নৈব নৈব চ। কিন্তু আলমের স্মৃতি ও ধ্যানে তিনি বেড়ি পরাতে পারেননি।
ফলে যা তিনি চর্চা করেছেন, তাই-ই শিক্ষা করে ফেলেছেন আলম। এমনকী তাঁর প্রিয়তম দরবারি গেড়ি রাগিণীটিও এক দিন হঠাৎ করে বাড়ি ফিরে শিষ্যকে ওই রাগিণীতে রেওয়াজ করতে শুনে খেপে আগুন সরোদ-ওস্তাদ।
আহমেদ আলির থেকে বিদায় নেওয়ার পর রামপুর মহারাজার প্রাসাদ দ্বারে টানা ছ’মাস হাজিরা দিয়েছেন আলম। উদ্দেশ্য সভাসঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ উজির খানের বীনের শিষ্যত্ব পাওয়া। কিন্তু রোজ তাঁকে ফেরত পাঠিয়েছেন দরোয়ানরা। শেষে মসজিদে গিয়ে আফিম খেয়ে মরার ছকও কষলেন।
এক মৌলবীর দাক্ষিণ্যে সে-যাত্রায় রক্ষে। মৌলবী দয়াপরাবশ হয়ে আলমের পরিস্থিতি চিঠি লিখে জানালেন স্বয়ং রামপুর নবাবকে। কিন্তু সে-চিঠি নবাবকে পৌঁছনো যাবে কী করে, আলম চিঠি নিয়ে তাই নবাব হামিদ আলির জুড়ি গাড়ির সামনে নিক্ষেপ করলেন নিজেকে। বাকিটুকু ইতিহাস।
সে-সময় খবর হয়েছিল যে এক বাঙালি যুবক বোমা মারতে এসেছিল নবাবের গাড়িতে। তা জেনে আলম বলেছিলেন, ‘‘বোমা ছিল ঠিকই, তবে বারুদের নয়, স্বরের।’’
নবাব হামিদ আলি নিজেও গুণী সঙ্গীতকার ছিলেন। আলমের সঙ্গীতে মুগ্ধ তিনি নিজে আয়োজন করেছিলেন উজির খানের কাছে ওঁর নাড়া বাঁধার।
উজির খানের শুধু একটি শর্ত ছিল: আলাউদ্দিনকে উনি সরোদ, সুরশৃঙ্গার ও রবাবে শিক্ষা দেবেন, কিন্তু বীণে নয়। আর তাতেই সম্মত ছিলেন আলাউদ্দিন খান।
রবিশঙ্কর তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, কী সৌভাগ্য আমাদের যে, বাবার মধ্যে এই বিচিত্র তন্ত্রকারির শিক্ষা আমরা এক জায়গায় পেলাম! সারা জীবনের শেখা বিদ্যা তিনি বাকি জীবন কাজে লাগালেন অন্যদের শেখাতে।
গুরুমহিমায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন বাবা আলাউদ্দিন যে গোটা জীবন নিজের সব গুরুদের বন্দনা গেয়ে গেছেন।
ওঁর শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথের সেতারিকন্যা অঞ্জনা রায় তাঁর আলাউদ্দিন-জীবনী ‘মিউজিসিয়ান ফর দ্য সোল’ বইতে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন।
উস্তাদ আলি আকবরের পিতা ও একমাত্র গুরু বাবা আলাউদ্দিন ছেলেকে নাড়া বাঁধিয়েছিলেন ওস্তাদ দবীর খানের কাছে।
কারণ? দবীর খান ছিলেন ওস্তাদ উজির খানের বংশধর। এভাবেই উজির খানকে সম্মান ও ভক্তি জানানোর সুযোগ নিয়েছিলেন ভারতের সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরু।
*****
বাবা আলাউদ্দিনের স্বভাব ও চরিত্রের দুটি সেরা শব্দচিত্র রেখে গেছেন রবিশঙ্কর আনন্দবাজার পূজাবার্ষিকীর জন্য লেখা ‘বেণীমাধবের ধ্বজা থেকে আইফেল টাওয়ার’ রচনায়।
সেখান থেকে দুটো ছবি তুলে দিচ্ছি। প্রথমটা উদয়শঙ্করের নৃত্যদলের সঙ্গে বাবার ইউরোপ যাত্রার প্রাকমুহূর্ত—
‘বোটে যখন উঠছে সবাই – মা, আমি আর বাবা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা তো মা’কে মা মা করতেন। রত্নগর্ভা, আপনার গর্ভে শিবশঙ্কর আইসে। দাদার কথা আর কী।
‘মা’র হঠাৎ কী যে হল premonition, perhaps she knew.আমার হাতটা বাবার হাতে দিয়ে বললেন, উনিও বাবাই বলতেন। বাবা, আপনাকে একটা কথা বলব? – ‘বলেন মা বলেন’, বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলেন— আদেশ করেন— ‘না, আপনি তো জানেন, এর বাবা মারা গেছেন— বড় দুরন্ত ছেলে, এখন তো কেউ নেই। আপনি একটু দেখবেন একে। ভুলটুল মাপ করে দেবেন। কারণ মাও তো বাবার মূর্তি দেখেছিলেন, উনি চাইতেনও যে আমি বাবার কাছে শিখি। আমিও চাইতাম, কিন্তু সাহস হত না। মা বলার সঙ্গে সঙ্গে, বাপরে! বাবাও highly emotional. একেবারে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন— মা আপনে বলসেন কী, আপনে রত্নগর্ভা — আজ থিক্যে আলি আকবর আমার ছোট ছেলে— রবু আমার বড়ো ছেলে। আপনায় কথা দেলাম।
মা আর বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কেন জানি না, ভেউ ভেউ করে কাঁদছি — বড় বিশ্রী পরিস্থিতি কান্নার মধ্যেই মা’কে আমি শেষ দেখছি। হাত নাড়ছি। মা দাঁড়িয়ে আছেন চশমা পরে। পরনে ঢাকাই শাড়ি, সেই শেষ দেখা।’
আর বাবার অন্য ছবিটা কেমন রবিশঙ্করের স্মৃতিতে? শুনুন ...
‘‘কয়েক মাস পরেই প্যারিসে খবর পেলাম— মা মারা গেছেন। বাবও কেমন যেন বদলে গেলেন— মানে আমার সম্পর্কে তাঁর মনোভাব। তবু উনি মাঝে মাঝে খুব রেগে যেতেন। কিন্তু আমাকে ঠিক বকতেন না। তখন আমরা প্যালেস্টাইনে ছিলাম (ইজরাইল হয়নি তখন)। তখন একটু একটু শেখাতে শুরু করেছেন আমাকে। গান শেখাচ্ছেন। গত শেখাচ্ছেন, আমাকে আর দুলালকে। আমরা ভাবলাম, বাবাকে একটা কিছু দেওয়া যাক। কী দেওয়া যায়?
‘‘বাবা হুঁকোটা খুব miss করতেন। কড়া সিগারেট খেতেন। আমি আর দুলাল খুব ভেবেচিন্তে, খুব ভাল পাইপ, একেবারে best available, আর ভাল টোবাকোর পাউচ নিয়ে গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে রাখলাম।
‘‘সেদিন ওঁর মুডটা কী কারণে যেন খারাপ ছিল। আর যায় কোথায়, দুর্দশা একেবারে – ‘আমার মুয়ে আগুন দিতে আইসে। কী ভাবস আমারে ঘুষ দিয়া শিখবা? আমি ওসব নিই না। আমি কারও পয়সা নিই না, আমি কারও পান খাই না।’
‘‘আমরা বুঝলাম এঁকে এসবেতে ফাঁসানো যাবে না। আর তার প্রয়োজনও ছিল না। উনি যে ভেতরে ভেতরে আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। বলতে গেলে he depended on me। আমার এক নতুন জীবন শুরু হল।’’