বার বার চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে বৃষ্টির কথা
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে। ছোটবেলায় আকাশ মেঘলা করে এলেই খেলার ছলে এই কবিতাটি বলা শুরু হয়ে যেত। ঠিক যেন কবিতাটি শুনেই বৃষ্টি তাড়াতাড়ি নেমে আসবে! সে সব কবিতা শুনে বৃষ্টি কখনও তাড়াতাড়ি নেমে এসেছে কিনা জানা নেই। তবে রূপোলি পর্দায়, বৃষ্টি বার বার নেমে এসেছে ঠিক নায়কের মতো করে।
আসলে বাস্তব জীবনের জলছবি হল সিনেমা। সেকাল থেকে একাল, চলচ্চিত্রকারদের দৃশ্যকল্পে বৃষ্টির স্থান কখনও রোমান্টিকতায় ভরপুর, কখনও বা বিষাদে, কখনও বা অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে। বিভিন্ন ছবিতে দেখানো বৃষ্টিমুখর এমন বহু দৃশ্য রয়েছে, যেখানে বৃষ্টিই যেন সব না বলা কথা বলে দেয় অনায়াসে। সেই কারণেই বহু পরিচালক বহু সময় কোন সংলাপ ছাড়া শুধুমাত্র বৃষ্টির দৃশ্যের ব্যবহার করেই বানিয়ে ফেলেছেন অভাবনীয় কিছু দৃশ্য। এই বর্ষার মরসুমে চলুন সেরকমই কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলা যাক।
‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে বৃষ্টির দৃশ্য
‘পথের পাঁচালী’
সাদা কালো ফ্রেম, ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে এক দিদি তার ভাইয়ের মাথায় ঢাকা দিয়ে বলে চলেছে ‘নেবুর পাতায় করমচা, এই বৃষ্টি ধরে যা’। অপু-দুর্গার এই বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য বাংলা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম আইকনিক দৃশ্য। ১৯৫২ সালে সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ ছবির শুটিং শুরু করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত এই সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে বৃষ্টি ছিল নায়কের পরিপন্থী। প্রাকৃতিক বৃষ্টিতে শুটিং করার কারণে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। ছাতা মাথায় বসে থাকা এক ব্যক্তির মাথায় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়া, পুকুরের জলে বৃষ্টি পড়ার শব্দ আবার প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে দুই ভাই বোনের ভিজে চলা এই প্রতিটি দৃশ্যই যেন সিনেমার ইতিহাসে কালজয়ী দৃশ্য।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে বৃষ্টির দৃশ্য
‘মেঘে ঢাকা তারা’
বাংলা সিনেমার আরেক কালজয়ী সিনেমা 'মেঘে ঢাকা তারা'। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত এই ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে নীতা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে আর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাংর দাদা। সেদিনও ভীষণ বৃষ্টি। কোথাও কি নীতার মনের কোনে জমে থাকা দুঃখেরই বহিঃপ্রকাশ এই বৃষ্টি! নাকি সেই বৃষ্টি মেঘকে সরিয়ে আরও সুস্পষ্ট করে দিয়েছিল আকাশের তারাকে? এই দৃশ্য নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে বহু।
বৃষ্টি যেন স্মৃতির কথা বলে, ‘রেইনকোট’ ছবির দৃশ্য
‘রেইনকোট’
ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত এই ছবি এক বৃষ্টির দিনে দু’জন মানুষের স্মৃতি রোমন্থনের কথা বলে। ব্যবসার কাজে কলকাতা শহরে এসে বিনোদ এক বৃষ্টির দিনে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা নীরজার সঙ্গে দেখা করতে যান। বাইরে বৃষ্টি আর দু’জনে ওল্টাতে থাকে একের পর এক স্মৃতির পাতা। ও হেনরির ‘দ্য গিফট অফ ম্যাজাই’ অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমায় বৃষ্টি যেন রূপকের ভূমিকা পালন করেছে। আর সেই অনুভূতিকেই আরও জোরদার করেছে এই ছবির গান।
‘গয়নার বাক্স’ ছবির দৃশ্য
‘গয়নার বাক্স’
খানিক মজা, খানিক রসবোধ, এই দুইয়ের মোড়কে তৈরি এই সিনেমার একটি দৃশ্য আজও রয়ে গেছে দর্শকদের মনে। ব্যবসার কাজে বহুদিন বাইরে সোমলতার স্বামী। এই সময় এক দিন এক অচেনা অজানা মানুষের মুখোমুখি হয় সে। সোমলতা বুঝতে পারে মানুষটি তাঁকে ভালোবাসে। কিন্তু সমাজের বন্ধন, স্বামীর প্রতি কর্তব্য এসবই হয়ে ওঠে দুজনের মাঝখানের পর্দা । কিন্তু তবু প্রেম আসে নিঃশব্দ চয়নে। বাইরে উথাল পাথাল হওয়া আর সঙ্গে ঝোড়ো বৃষ্টি। এরই মাঝে সেই মানুষ সোমলতার দরজার বাইরে রেখে যায় একটি লাল গোলাপ। পরিচালক অপর্ণা সেন এই বৃষ্টির দৃশ্যের মাধ্যমে সোমলতার মনের মধ্যে ওঠা ঝড়কেই যেন বোঝাতে চেয়েছিলেন।
‘উনিশে এপ্রিল’ ছবির একটি দৃশ্য
‘উনিশে এপ্রিল’
ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই বৃষ্টির বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’। মায়ের প্রতি মেয়ের অভিমান, রাগ, দুঃখ সবটাই বেরিয়ে আসে এক ঝড়ের রাতে। বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। বাড়িতে সকলের অনুপস্থিতির সুযোগে রাগে অভিমানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে অদিতি। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি আর ঝড়ের কারণেই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন সরোজিনী। আর সেই রাতেই বৃষ্টির জলের সঙ্গেই ধুয়ে যায় মা ও মেয়ের মধ্যে তৈরি হওয়া সমস্ত ক্লেশ।
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং 'আষাঢ়ের গল্প' ফিচারের অংশ