স্নায়ুকোষের মরণঘুমে বাঙালির দাওয়াই দারচিনি

পার্কিনসন্‌স রোগের অন্যতম দাওয়াই হতে পারে দারচিনি গুঁড়ো! ‘জার্নাল অব নিউরো ইমিউন ফার্মাকোলজি’-তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন শিকাগোর রাশ ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের স্নায়ুবিদ্যার গবেষক কালীপদ পাহান। ইঁদুরের উপরে তিন বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দারচিনির সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ডোপামিন নিঃসরণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি ওই প্রবাসী বাঙালি গবেষকের। মস্তিষ্কের এই ডোপামিন নিঃসরণকারী কোষগুলি মরে গেলেই পার্কিনসন্‌স-এ আক্রান্ত হয় মানুষ। দারচিনি ওই কোষগুলিকেই ফের মরণঘুম থেকে বাঁচিয়ে তোলে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৫৯
Share:

কালীপদ পাহান

পার্কিনসন্‌স রোগের অন্যতম দাওয়াই হতে পারে দারচিনি গুঁড়ো!

Advertisement

‘জার্নাল অব নিউরো ইমিউন ফার্মাকোলজি’-তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন শিকাগোর রাশ ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের স্নায়ুবিদ্যার গবেষক কালীপদ পাহান। ইঁদুরের উপরে তিন বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দারচিনির সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ডোপামিন নিঃসরণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি ওই প্রবাসী বাঙালি গবেষকের। মস্তিষ্কের এই ডোপামিন নিঃসরণকারী কোষগুলি মরে গেলেই পার্কিনসন্‌স-এ আক্রান্ত হয় মানুষ। দারচিনি ওই কোষগুলিকেই ফের মরণঘুম থেকে বাঁচিয়ে তোলে।

কালীপদবাবুর কথায়, “পার্কিনসন্‌স রোগের কোনও ওষুধ নেই। রোগটি কী ভাবে সারবে, তা এখনও অজানা। মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণ করা স্নায়ুকোষগুলির অধিকাংশ মরে গেলে এই রোগটি হয়। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করার সময় দারচিনি প্রয়োগ করে ওই মৃত কোষগুলিকে সাময়িক ভাবে অনেকটাই সক্রিয় করে তুলতে পেরেছি। যা ভবিষ্যতে পার্কিনসন্‌স রোগীদের কাছে সুসংবাদ নিয়ে আসতে পারে।” ওই জীববিজ্ঞানীর কথায়, “দারচিনি সারা বিশ্বেই মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লিভারে গিয়ে যে দারচিনি সোডিয়াম বেনজয়েট তৈরি করে, তা জানাই ছিল। ওই রাসায়নিক পদার্থটি লিভারের কোষের পক্ষে উপকারী। কিন্তু রাসায়নিকটি যে মস্তিষ্কের কোষেও প্রভাব ফেলে, তা এত দিন জানা ছিল না।”

Advertisement

স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০ কোটি স্নায়ুকোষ থাকে। তাদের মধ্যে ৪-৫ লক্ষ কোষ ডোপামিন নামে একটি প্রোটিন তৈরি করে। ২৫ বছর বয়সের পর থেকেই মানব মস্তিষ্কে বিভিন্ন স্নায়ুকোষ মরে যেতে শুরু করে। এর মধ্যে ডোপামিন নিঃসরণকারী কোষও রয়েছে। মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণকারী স্নায়ুকোষগুলির শতকরা ৬০ ভাগ মারা গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দেহে পার্কিনসন্‌স রোগের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। ডোপামিন নিঃসরণকারী স্নায়ুকোষ যত বেশি মারা যায়, ততই পেশীর সক্রিয়তা কমে যায়। রোগের উপসর্গ হিসেবে হাত ও পায়ের গতি শ্লথ হতে শুরু করে। মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে হাত-পা কাঁপা শুরু হয়। কালীপদবাবুর কথায়, “স্নায়ুকোষ মারা গেলে তাকে বাঁচিয়ে তোলার কোনও উপায় নেই। ডোপামিন তৈরি করা স্নায়ুকোষগুলি নিষ্ক্রিয় হওয়ার হার রোধ করাটাই একমাত্র দাওয়াই। সেটা করতে পারলে রোগের প্রকোপটাকে থামিয়ে দেওয়া যায়। সেই কাজেই সাহায্য করতে পারে দারচিনি গুঁড়ো।”

কী ভাবে? কালীপদবাবুর ব্যাখ্যা, “আমরা ইঁদুরের দেহে দারচিনি প্রবেশ করিয়ে দেখেছি তা তাদের শরীরের মধ্যে সোডিয়াম বেনজয়েটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। রাসায়নিকটি মস্তিষ্কের মৃতপ্রায় কোষগুলিতে পৌঁছলে সেগুলি থেকে ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। যা পেশী সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে। অর্থাত্‌ নিয়মিত দারচিনির জোগান দিয়ে গেলে মস্তিষ্কের ঝিমিয়ে থাকা কোষগুলি দীর্ঘসময় সক্রিয় থাকে।”

কালীপদবাবু এবং তাঁর সঙ্গী আর এক বাঙালি বিজ্ঞানী সৌরভ খাসনবিশ জানান, গবেষণাগারে তাঁরা ইঁদুরের শরীরে এমন এক ধরনের বিষ প্রয়োগ করেন, যা ওই প্রাণীগুলির মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণকারী কোষগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ফলে ইঁদুরের পেশি সঞ্চালন একেবারে শ্লথ হয়ে পড়ে। তারা নড়াচড়াও বন্ধ করে দেয়। কালীপদবাবু বলেন, “এর পরে আমরা ওই ইঁদুরগুলির কয়েকটির শরীরে নির্দিষ্ট মাত্রায় দারচিনি প্রবেশ করিয়ে দেখি ধীরে ধীরে তাদের পেশী সঞ্চালন ক্ষমতা ফিরে এসেছে। মস্তিষ্কের কোষগুলিকে পরীক্ষা করে দেখি সেগুলি ডোপামিন নিঃসরণ করতে শুরু করেছে। কিন্তু যে ইঁদুরগুলিকে দারচিনি খাওয়ানো হয়নি, তাদের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে।”

পার্কিনসন্‌স রোগের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে নিজেদের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান কালীপদবাবুরা। কিন্তু এই দেশের বিজ্ঞানীরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন এই গবেষণাকে? স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল দাসের কথায়, “দারচিনির গুঁড়ো থেকে যদি পার্কিনসন্‌সের চিকিত্‌সা শুরু হয়, তা মানুষের মনে আশা জাগাবে। যদিও এখনও অনেক ধাপ পেরোনো বাকি।” আর এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সীতাংশু নন্দীর কথায়, “বিশ্ব জুড়ে এ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। ইন্টারনেট মারফত আমরা নানা তথ্য জানতে পারি। কিন্তু, এই সব গবেষণার ফল মানব শরীরে প্রয়োগ করা যাবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত করে এখনও কিছু জানা যায়নি।”

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যা বিভাগের স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক তুষার ঘোষ মনে করেন, স্নায়ু-সংক্রান্ত নানা রোগ, ক্যানসারের যে হেতু নির্দিষ্ট ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। তাই বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। এই সব গবেষণায় ভারতীয় ভেষজ উপাদান, মশলাপাতির ব্যবহারও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তুষারবাবুর কথায়, “শুনেছি ক্যানসার আক্রান্তদের পালং শাকের রস, জাফরান খাইয়ে লাভ হচ্ছে। স্নায়ু-সংক্রান্ত রোগের ক্ষেত্রেও যদি এ রকম কিছু জানা যায় তা হলে ভালই হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement