বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল
মঙ্গলবার, ২০ জানুয়ারি। বেলা পৌনে বারোটা। বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের আউটডোর। সুনসান, পরপর সব ঘর তালাবন্ধ। সকাল ১০টা নাগাদ দু’জন চিকিৎসক এসেছিলেন। এক ঘণ্টা পরে আউটডোর বন্ধ করে চলে গিয়েছেন। এখানে ১০০ শয্যার মধ্যে মেরেকেটে ৩৫ জন ভর্তি।
একই হাল বিজয়গড় স্টেট জেনারেলে। ১০০ শয্যার হাসপাতালে এখন ১৫ জন রোগী ভর্তি। মঙ্গলবার দুপুর বারোটার মধ্যে আউটডোর বন্ধ। ধু-ধু ফাঁকা ইন্ডোরও।
গার্ডেনরিচ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে কোনও অ্যানেসথেসিস্ট ও সার্জন নেই বলে সমস্ত অস্ত্রোপচার বন্ধ। রয়েছেন দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, রোজ আউটডোর চালিয়ে ইন্ডোরে রোগী ভর্তি করা যাবে না। তাই নতুন রোগী ভর্তি কার্যত বন্ধ। আপাতত ভর্তি জনা পঁয়তাল্লিশ।
ছবিটা একই রকম বেহালার বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেলেও। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজতে না বাজতেই আউটডোর বন্ধ করে ডাক্তারেরা উধাও। অস্ত্রোপচার হয় কালেভদ্রে।
খাতায়কলমে ‘স্টেট জেনারেল হাসপাতাল’ হলেও ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই চার হাসপাতালই পড়ে বৃহত্তর কলকাতার মধ্যে। কাছাকাছি এসএসকেএম, এম আর বাঙুর হাসপাতালে যখন রোগীর চাপে নাভিঃশ্বাস ওঠার দশা, তখন এই হাসপাতালগুলি কার্যত খালি।
ওই চার হাসপাতালের কর্তারা গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য দফতরের এক বৈঠকে অভিযোগ জানিয়েছেন: সরকার ডাক্তার দেয় না, টেকনিশিয়ান দেয় না, কোনও পরিকাঠামো দেয় না। এমন উদাসীন থাকলে আর কিছু দিনের মধ্যে চারটি হাসপাতালই বন্ধ করতে হবে। সরকারের তরফে অবশ্য বক্তব্য, ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি নেই তাদের তরফে। টাকাও যথেষ্টই দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা মন দিয়ে কাজ করলেই ভাল ভাবে চালানো যায় হাসপাতাল। গাফিলতি ডাক্তারদেরই।
কেন এই হাল?
বিজয়গড় স্টেট জেনারেল
বাঘা যতীন স্টেট জেনারেলের সুপার রঞ্জন মজুমদারের বক্তব্য, “আমাদের কোনও সার্জন নেই। দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, এক জন চোখ ও এক জন কানের ডাক্তার। এই দিয়ে কখনও হাসপাতাল চলে?”
তাঁরও বক্তব্য, “কোনও সার্জন নেই। ১ জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আর তিন জন মেডিক্যাল অফিসারের লোকবলে কে আউটডোর চালাবে? রোগীরা কোন ভরসায় আসবেন? বিশেষ করে আরএসবিওয়াই-এর রোগীরা ভাল পরিষেবা পেতে কাছাকাছি এসএসকেএম বা বাঙুরে চলে যান।”
বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেলের সুপার উত্তম মজুমদার জানান, হাসপাতালে সার্জন নেই বলে অস্ত্রোপচার বন্ধ। বাকি মাত্র ৩ জন ডাক্তার। তাঁর কথায়, “স্বাস্থ্য দফতর ডাক্তার না দিলে এই পরিকাঠামোয় কোনও রোগী বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমার কার্ডধারী রোগীদের চিকিৎসা অসম্ভব।”
গার্ডেনরিচ স্টেট জেনারেলের কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, “সার্জন-অ্যানেসথেসিস্ট না থাকলে অস্ত্রোপচার হবে কী করে? মেডিসিন আর স্ত্রীরোগের ডাক্তারের যা হাল, রোগী ভর্তি নিয়ে পরিষেবা না দিতে পারলে আমরা মার খাব। তখন কি স্বাস্থ্য দফতর আমাদের বাঁচাবে?”
হাসপাতাল কর্তারা জানিয়েছেন, জেনারেটর বা জলের পাম্প বিকল হলে তাঁরা ঠিক করাতে পারেন, কিন্তু ডাক্তার-টেকনিশিয়ানের অভাবে তো ইচ্ছেমতো নিয়োগ করতে পারেন না। সেই দায়িত্ব স্বাস্থ্য দফতরের। পরিকাঠামোর মূল জায়গাটাই বিকল। ঠিক সময়ে ওষুধ-ব্যান্ডেজ-ইঞ্জেকশন সরবরাহ না হলে রোগীরা পাবেন কী করে?
তাঁদের অভিযোগকে অবশ্য বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে ‘কাজ না করার ফিকির’ বলেছেন স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে। যুক্তি দিয়েছেন, “জেলায় জেলায় বিভিন্ন স্টেট জেনারেল আর মহকুমা হাসপাতালের ডাক্তারের সংখ্যা দেখলেই বুঝতে পারবেন কতটা ভিত্তিহীন এই অভিযোগ। ওই চার স্টেট জেনারেলের থেকে অনেক কম ডাক্তার-চিকিৎসাকর্মী নিয়ে তারা দিব্যি পরিষেবা দিচ্ছে। আসলে এই চারটি হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক ইচ্ছাকৃত ভাবে কাজ করছেন না।”
মলয়বাবুর আরও দাবি, পরিকাঠামোর পূর্ণ ব্যবহার এবং নিয়মিত আউটডোর করলে এর থেকে অনেক বেশি রোগী এখানে আসতেন। তখন আপনা থেকে চিকিৎসক ও কর্মী বাড়ানো হত। তাঁর কথায়, “আমরা জানতে পেরেছি, এখানকার বেশির ভাগ চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান কোনও মতে হাজিরা দিয়ে পালিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত হয়ে যান। তাই আউটডোর করতে চান না এবং রোগী ভর্তি নেন না। হাসপাতালগুলি রয়েছে খাস কলকাতায়, এটা তাঁদের বাড়তি সুবিধা।” স্বাস্থ্য সচিবের আরও অভিযোগ, “ডাক্তার থাকলেও আউটডোরে বসছেন না, অস্ত্রোপচার করছেন না। রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওষুধ থাকলেও দেওয়া হচ্ছে না, শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও রোগীকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা তদন্ত শুরু করেছি।”