কোরপান শা
তাঁর মানসিক অসুখের চিকিৎসা চলছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আর এক মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে তাঁর প্রাণ গিয়েছে।
অসুস্থ মানুষটি কেন যে উলুবেড়িয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নীলরতন সরকার হাসপাতালের হস্টেলে এসেছিলেন, তা পরিষ্কার হয়নি এখনও। তবে কোরপান শা নামে নিহত ওই যুবক যে চোর নন তা এক বাক্যে বলছেন তাঁর পরিবার, পাড়াপড়শি, এমনকী স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পুলক রায়ও। কোরপানের পরিবার ও পড়শিদের বক্তব্য, মানসিক অসুস্থতার জন্যই তিনি মাঝেমধ্যে ঘরদোর ছেড়ে উধাও হয়ে যেতেন। আবার নিজেই ফিরে আসতেন।
একই ভাবে গত শুক্রবার ঘর থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন উলুবেড়িয়ার খৈজুরির বাসিন্দা ২৮ বছরের কোরপান। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এনআরএসের মর্গ থেকে বাড়ি ফিরল তাঁর মৃতদেহ। কোনও মতে পেট চালানো গরিবের সংসার। রবিবার ভোরে গণপ্রহারে খুন হওয়া দেহটার ছবি সোমবার রাতেই পড়শির টিভিতে দেখেছিলেন স্ত্রী আরবিনা। মন কু ডেকেছিল তখনই। এ দিন প্রতিবেশীরা মর্গে এসে দেহ শনাক্ত করে খবর দিতেই টালির চালের বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। চার সন্তানের মা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “মানুষটা আর যা-ই হোক চোর ছিল না। লোকটা ভালমানুষ, হাবাগোবা! তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যারা মেরে ফেলল, ওদের শাস্তি দিও!”
কিন্তু কে দেবে শাস্তি?
হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরেও সন্দেহভাজনদের এখনও চিহ্নিত করেই উঠতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারীরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্টেলের আবাসিক চিকিৎসক-ছাত্রদের নাম-ঠিকানার তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন সোমবার রাতে। এখনও সেই তালিকা দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের তরফে যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তার রিপোর্টও জমা পড়েনি।
এনআরএস-এরই এক চিকিৎসক বলছেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় ঠিক যেমন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কর্তৃপক্ষ, এখানেও সে রকমই হচ্ছে। তবে ওখানে ছাত্রদের প্রতিবাদ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এখানে প্রতিবাদ করার সাহস কেউ দেখাতে পারছেন না।”
কেন আড়াল করা হচ্ছে কোরপানের খুনিদের?
হাসপাতাল সূত্রের বক্তব্য, সামনেই এমবিবিএস পরীক্ষা। রোগী পরিষেবাও জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে নির্ভরশীল। এই সময়ে কোনও কড়া পদক্ষেপ করা হলে তার ধাক্কায় নানা সমস্যা হতে পারে। এ সব ভেবেই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খাতায়-কলমে অনুমতি না-আসায় আটঘাট বেঁধে তদন্তে নামতে দ্বিধা করছে পুলিশও। এনআরএস-এর অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেননি। নিরুত্তর লালবাজারের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষও।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, পুলিশ এসে হস্টেলে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই পড়ুয়াদের তা কলেজ কর্তৃপক্ষ বা হস্টেল সুপারকে জানাতে বলা হয়েছে। কড়া ব্যবস্থা নিলে যাদবপুরের মতো স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে ভেবেও দ্বিধায় রয়েছেন তদন্তকারীরা। যদিও প্রশাসনের অন্দরেই একটি অংশের বক্তব্য, যাদবপুরের সঙ্গে এনআরএসের ঘটনার তুলনা চলে না। বরং যাদবপুরে উপাচার্য প্রাণসংশয় হতে পারে বলে জানানো মাত্রই পুলিশ ছুটে গিয়ে ছাত্রদের পিটিয়ে এসেছিল। এনআরএসে এক জন জলজ্যান্ত মানুষ খুন হয়ে গেলেন, অথচ কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ কেউই এখনও তার কোনও কিনারা করতে পারলেন না। প্রাক্তন পুলিশ-কর্তারা সখেদে বলছেন, এক দিকে আলিপুর থানায় শাসক দলের দুর্বৃত্তদের তাণ্ডবের পরে রাস্তা থেকে নিরীহ লোক ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে! অন্য দিকে এনআরএসে কোনও পদক্ষেপই হচ্ছে না।
এখনও অবধি খুবই সন্তর্পণে হস্টেলের কয়েক জনের সঙ্গে দু’চার কথা বলে উঠতে পেরেছে পুলিশ। এঁদের মধ্যে জনাকয়েক চিকিৎসক-ছাত্রও রয়েছেন। মোটের উপরে যেটুকু জানা গিয়েছে, রবিবার সাতসকালে কেউ কেউ হস্টেলে একটি জটলা ও কোলাহল শুনতে পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘একটা মারামারি চলছিল’ এর বেশি নির্দিষ্ট তথ্য পুলিশের হাতে আসেনি।
হস্টেলে নিয়মিত যাতায়াত করেন যে অশিক্ষক কর্মচারীরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সাধারণ ভাবে খানিকটা ‘অশান্তিপ্রিয়’ বা ‘রগচটা’ বলে পরিচিত ডাক্তার-ছাত্রদের বিষয়ে খোঁজ করা হয়েছে। তবে গণপিটুনি ও খুনের তদন্তে সেই তথ্য এখনও তেমন আলো ফেলছে না বলে পুলিশের দাবি। এর মধ্যে ওই হস্টেলের কয়েক জন ছাত্র বাড়ি চলে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। তাঁদের ঠিকানা যেহেতু এখনও পুলিশের হাতে নেই, ফলে অন্ধকারে হাতড়ানোর স্তরেই আটকে রয়েছে তদন্ত।
বিতর্ক এড়াতে সে ভাবে মুখ না খুললেও গোটা ঘটনায় হতভম্ব রাজ্যের চিকিৎসক মহলের বড় অংশই। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁরা অনেকেই স্বীকার করছেন, এনআরএসের হত্যাকাণ্ড তাঁদের অপরিসীম লজ্জার মুখে দাঁড় করিয়েছে। প্রবীণ চিকিৎসকদের প্রশ্ন, যে সব মেধাবী ছাত্রেরা ডাক্তারি পাশ করে জীবন দানের পবিত্র পেশায় যুক্ত হবেন, তাদের অমানবিকতা এই পর্যায়ে পৌঁছয় কী করে? দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে এর শেষ কোথায়?