গ্লোবাল কোয়ালিশন এগেনস্ট চাইল্ড নিউমোনিয়া ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর দিনটিকে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রতি বছর ৮ লক্ষেরও বেশি শিশু প্রাণ হারায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের ১৫ শতাংশের মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর এই হিসেব ২০১৭ সালের। এই ৩ বছরে যদিও অবস্থার খুব একটা বদল হয়নি। বিশ্ব জুড়ে শিশু ও বয়স্ক মিলিয়ে ২০১৯ সালে এই রোগে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের। আজ ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসে এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে সামিল হয়েছে আমাদের দেশও। কোভিড অতিমারিতে মৃত্যুর মূল কারণও ফুসফুসের এই অসুখ। তাই কোনও পরিস্থিতেই নিউমোনিয়া নামক ফুসফুসের এই মারাত্মক অসুখটিকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয় বলে জানালেন পালমনোলজিস্ট অশোক সেনগুপ্ত, শিশুরোগের চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ এবং ইউনিসেফের আধিকারিক চিকিৎসক কনীনিকা মিত্র।
মূলত শিশুদের নিউমোনিয়ার কবল থেকে রক্ষা করতে গ্লোবাল কোয়ালিশন এগেনস্ট চাইল্ড নিউমোনিয়া ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর দিনটিকে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সময় বিশ্বে নিউমোনিয়ায় ৫ বছরের কম বয়সিদের বাৎসরিক মৃত্যু ছিল প্রায় ১২ লক্ষ। গত ১১ বছরে সচেতনতা কিছুটা বাড়ায় মৃত্যু হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা গেছে। কনীনিকা জানালেন যে, “আমাদের দেশে ৩০ লক্ষ শিশুর নিউমোনিয়া সিভিয়ার অর্থাৎ মারাত্মক ধরনের। প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৫ জন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ফুসফুসের এই অসুখে শিশু মৃত্যুর হার কমানোর উদ্দেশ্যে নিউমোনিয়া দিবস পালন করা হয়।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের লক্ষ্য এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে ২০২৫ সালে নিউমোনিয়ার কারণে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে তিনের নীচে নামিয়ে আনা। কনীনিকার মতে, “ফুসফুসের এই সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসায় মৃত্যু হার কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য শিশুর মা ও পরিবারের অন্যদের সচেতনতা বাড়ানো দরকার। বিশ্বে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ১৮ শতাংশের জন্য দায়ী নিউমোনিয়ায়।”
আরও পড়ুন: অগ্ন্যাশয়ে কি ক্যানসার? জবাব জিন-সিগনেচারে
এই সাংঘাতিক রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে সতর্ক থাকলে অনেকাংশেই রুখে দেওয়া যায় বলে জানালেন পালমোনলজিস্ট অশোক সেনগুপ্ত। শিশুদের এই ফুসফুসের অসুখ প্রতিরোধ করতে জন্মের পরে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে পরামর্শ দিলেন কনীনিকা। অর্থাৎ শিশুকে প্রথম ৬ মাস মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোনও খাবার দেওয়া চলবে না। যে সব বাচ্চা মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয় তাদের নিউমোনিয়া-সহ যে কোনও সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে অনেক কম বলে জানালেন তাঁরা। চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে ভিটামিন এ খাওয়াতে হবে। কেননা ভিটামিন এ ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে শিশুদের ক্ষেত্রে টিকার এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। হামের পর নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া ডিপথিরিয়া ও হিপ বি টিকা এবং নিউমোকক্কাল টিকা দিয়ে শিশুর রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
আরও পড়ুন: গলা ব্যথা আটকে দেয় মাস্ক আর হাত ধোয়া
আমাদের দেশের বেশ কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যেই নিউমোনিয়ার টিকা চালু হয়ে গিয়েছে। আশা করা যায় কিছু দিনের মধ্যে আমাদের রাজ্যেও এই টিকা দেওয়া শুরু হবে। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতা ও হাত ধোওয়ার মত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে জানালেন দুই চিকিৎসক। এ ছাড়া বাড়ির পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত বলেও জানালেন তাঁরা। বাড়িতে উনুন বা রান্নার ধোঁয়া, সিগারেটের ধোঁয়া, ধুলো ময়লা থেকেও ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া সহজে বোঝার উপায় চেস্ট ইনড্রইং। এ ক্ষেত্রে বুক ও পেটের মাঝখানের অংশ ভেতরে ঢুকে যায়। মায়েরা এই ব্যাপারে সতর্ক থাকলে এবং শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে অসুখ সারিয়ে তোলা যায়। অশোক সেনগুপ্ত জানালেন, “শুধু বাচ্চাদেরই নয়, বয়স্কদের ক্ষেত্রেও নিউমোনিয়া অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিউমোনিয়া কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ফুসফুসের সংক্রমণ ও ফুলে ওঠা। আমাদের ফুসফুস অনেকটা স্পঞ্জের মতো। এর কোষ ভর্তি থাকে হাওয়া দিয়ে। তাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফুসফুসকে গ্যাস ভর্তি বেলুনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। নিউমোনিয়া হলে ফুসফুস ক্রমশ কঠিন হয়ে শুরু করে। ডাক্তারি মতে একে বলা হয় কনসোলিডেশন। এক্স রে করলে সাদা দেখতে লাগে।”
তিনি জানালেন, “নিউমোনিয়া হলে তিনটি প্রধান সমস্যা দেখা যায়। জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। এর সঙ্গে বুকে ব্যথাও থাকতে পারে। একে বলা হয় প্লুরিটিক ব্যথা। জোরে শ্বাস টানলে বুকে ব্যথা করে। নিউমোনিয়ার শুরুতে শুকনো কাশি হয়। পরের দিকে কাশির সঙ্গে সর্দি বেরোয়। সর্দিতে রক্ত থাকতে পারে। অনেক সময় কালচে লাল ধরনের রক্ত বেরোয়।” নিউমোনিয়ার অন্যান্য উপসর্গ হিসেবে মাথার যন্ত্রণা, বমি বা বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, খিদে কমে যাওয়া, অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়া, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার মতো উপসর্গের কথা জানালেন তিনি।
অশোক জানালেন, “বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়ার মধ্যে আছে কমিউনিটি অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া, হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া, ভেন্টিলেটর অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া এবং অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া। এ ক্ষেত্রে খাওয়ার সময় সরাসরি ফুসফুসে খাবার গিয়ে বা জল-সহ অন্যান্য পানীয় ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশু হোক বা বয়স্ক, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধুয়ে মাস্ক পরে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার পাশাপাশি টিকা নেওয়া দরকার। কোভিড রোগীদের নিউমোনিয়া হলে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। কাশি, জ্বর ও নিঃশ্বাসের কষ্ট হলে ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ কিনে না খেয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রয়োজনে অক্সিজেন দিতে হয়। বয়স্ক বা বাচ্চা একই প্রোটোকল মেনে চিকিৎসা করা হয়।”